ফাহমিদা শুনে মনে মনে খুশী হলেও রাগ দেখিয়ে বলল, এবার আমি যদি বলি, তোরাই তাকে ভালবাসিস? ঐ যে কথায় বলে, চোরের মন বোঁচকার দিকে।
রাহেলা বলল, আমরাতো শামীর দিকে চোরা চোখে তাকাই নি। আর সেও আমাদের দিকে তাকায় নি। তুই স্বীকার না করলেও আমাদের অনুমান সত্য।
ফাহমিদা কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ রইল।
জোবেদা বলল, কিরে চুপ করে আছিস কেন? মনে হচ্ছে জোকের মুখে নুন পড়েছে।
ফাহমিদা রেগে উঠে বলল, যে মূলো খায়, তার ঢেকুর থেকে মূলোরই গন্ধ বেরোয়।
জোবেদা বলল, তা ঠিক কথা। তবে তুই যাই বলিস না কেন, রাহেলা যা বলল, তা সত্য সত্য সত্য।
ফাহমিদা রেগে ছিল। জোবেদাকে তিন সত্য খেতে দেখে রাগের সঙ্গেই বলল, তোদেরকে আর ওকালতি করতে হবে না। এবার বকবকানি থামা। কান ঝালাপালা হয়ে গেল। তোদের কাছে হার মানছি।
রাহেলা বলল, ধরা যখন পড়েই গেলি তখন আর আমাদের কাছে কোনো কিছু গোপন করবি না। কিরে চিঠিপত্র দেয়া নেয়া হয়েছে নাকি? আমরা কথা দিচ্ছি, তোদের সবকিছু গোপন রাখব। দরকার হলে তোদেরকে সাহায্য করব।
ফাহমিদা হেসে ফেলে বলল, তোরা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস। ঐ যে লোকে বলে, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। তোদের হয়েছে সেই দশা। তোদের অনুমান কতটা সত্য জানি না। তবে এখনও চিঠি দেয়া নেয়া হয় নি।
জোবেদা বলল, সত্যি বলছিস?
ফাহমিদা বলল, সত্যি সত্যি সত্যি। হল তো?
জোবেদা বলল, আজ রাতেই একটা চিঠি লিখবি। তুই নিজে দিতে না পারলে আমি দেব।
রাহেলা বলল, জোবেদা ঠিক কথা বলেছে। চিঠি লিখে কাল স্কুলে নিয়ে আসবি। আমরাও পড়ব। আমাদের আবার যদি কোনো দিন কাউকে চিঠি দিতে হয়, তাই আগে থেকে শিখে রাখব। কিরে দেখাবি তো?
ফাহমিদা মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলল, আমি যেন কত প্রেম পত্র লিখেছি।
রাহেলা বলল, লিখিস নি তো কি হয়েছে? কেউ কি মায়ের পেট থেকে সব কিছু শিখে আসে? প্রয়োজনে সবাইকে সবকিছু শিখে নিতে হয়।
ফাহমিদা বলল, সে যদি আমার চিঠির উত্তর না দেয়? অথবা আমাকে বেহায়া মেয়ে ভেবে যা তা লিখে উত্তর দেয়, তখন কি হবে? অপমান তো আমি হব; তোরা তো হবি না।
জোবেদা বলল, শিকারী বিড়ালের গোঁফ দেখলে চেনা যায়। শামীর সঙ্গে এতবার দেখা হয়, কিন্তু একবারও আমার মুখের দিকে তাকায় না। অথচ তোর দিকে তাকায়।
জোবেদাকে থামিয়ে দিয়ে রাহেলা বলল, তোর কথা কারেক্ট। গ্রামের ছেলে সবারই সাথে প্রায় দেখা হবে। আমারও সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে একবারও কথা বলে নি। সামনা সামনি হলে মাথানিচু করে চলে যায়। আমিও বলছি, তুই চিঠি দিয়ে দেখ, আমাদের কথা সত্য না মিথ্যা।
তাদের কথা শুনে ফাহমিদা মনে মনে গর্ব অনুভব করল। সেই সঙ্গে আনন্দও কম হল না। তবু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ঠিক আছে, তোরা যখন এত করে বলছিস তখন একটা চিঠি না হয় দেব। কিন্তু যদি উল্টো এ্যাকশন হয়, তা হলে তোদেরকে আস্ত রাখব না।
রাহেলা বলল, তা না হয় না রাখলি। আর যদি তার বিপরীত হয়, তা হলে মিষ্টি খাওয়াবি বল?
ফাহমিদা বলল, খাওয়াব।
ততক্ষণে ওরা বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। সালাম বিনিময় করে যে যার বাড়ির দিকে চলে গেল।
সেদিন সন্ধ্যের পর ফাহমিদা কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। শুধু রাহেলা ও জোবেদার কথা মনে পড়তে লাগল। শেষে কাগজ কলম নিয়ে শামীকে চিঠি লিখতে বসল। কিন্তু কিভাবে শুরু করবে এবং কি লিখবে ঠিক করতে না পেরে কাগজের উপর কলম ধরে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল। সে বড় ও মেজ ভাইকে মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে নিজের জন্য এটা সেটা পাঠাতে বলে। তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে চিঠি লিখেনি। এখন ভালবাসার পাত্রকে কিভাবে মনের কথা লিখবে ভেবে পেল না। অনেকক্ষণ চিন্তা করে লিখতে শুরু করল।
শামী ভাই,
প্রথমে আমার সালাম নেবেন। পরে জানাই যে, কিশোর বয়সে আব্বা-আম্মার মুখে আপনার সুনাম শুনতাম। একটু বড় হওয়ার পর আপনাকে দেখতে ইচ্ছা হত। তাই সাথীদের নিয়ে আপনাদের পাড়াতে মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতাম। কখনো দেখতে পেতাম আবার কখনো পেতাম না। তারপর যখন শুনলাম, আপনি মাদ্রাসার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আজে বাজে ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান তখন মনে একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। পরে আবার যখন শুনলাম, স্কুলে ভর্তি হয়েছেন তখন খুশী হলাম। কেন যে ঐরকম হত তখন বুঝতে পারতাম না। গত বছর বর্ষার সময় যেদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, সেই দিন হঠাৎ আপনি এসে আমাকে ছাতা দিতে চাইলে আমি আগের থেকে অনেক বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম। তাই সবকিছু জেনেও আপনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করি। তারপর থেকে আপনি সব সময় আমার চোখে ও মনে ভেসে বেড়াচ্ছেন। স্বপ্নেও আপনাকে সব সময় দেখি। আপনাকে বাস্তবে বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। মাঝে মধ্যে স্কুলের পথে হঠাৎ এক আধদিন অল্প সময়ের জন্য একাকি দেখা হলে কথা বলি। কিন্তু তাতে আমার মনের আশা মিটে না। ইচ্ছে করে সারাদিনরাত আপনার পাশে বসে গল্প করি। সে আশা কবে পূরণ হবে জানি না। যেদিন বান্ধবীরা আমার সঙ্গে থাকে সেদিন আপনাকে পাশ কেটে যেতে দেখে চোরা চাহনিতে দেখি। এর কারণ কি বলতে পারেন? আমার তো মনে হচ্ছে, আমি আপনাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসে ফেলেছি। মেয়ে হয়েও মনের তাগিদে নির্লজ্জের মতো বলে ফেললাম। আমার বিশ্বাস, আপনিও আমাকে ভালবাসেন। সেই বিশ্বাসের উপর। আস্থা রেখে এই পত্র লিখলাম। যদি এটা আমার অন্যায় হয়, তবে ক্ষমা করে দেবেন। আর ব্যাপারটা দয়া করে কাউকে জানাবেন না। নচেৎ আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তখন আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ থাকবে না। কোনো দিন কাউকে চিঠি লিখিনি। কেমন করে লিখতে হয় তাও জানিনি। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন। আর একবার আপনাকে সালাম জানিয়ে শেষ করছি।