ফাহমিদা নিচের ক্লাস থেকে প্রতি বছর ফার্স্ট হয়। এবছরও তার ব্যতিক্রম হল না। সেই জন্যে তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করল না। কিন্তু শামী মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। তা ছাড়া দুবছর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। সে ফার্স্ট হয়ে ক্লাসে উঠতে গ্রামের লোকেরা তার সমালোচনা করে বলল, ছেলেটা ভবিষ্যতে খুব উন্নতি করবে।
বর্ষার সময় একদিন স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। ছুটির পরও থামার কোনো লক্ষণ নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলেই অপেক্ষা করতে লাগল। যখন ঝড় বৃষ্টি একটু কমল তখন তারা ভিজে ভিজে যে যার বাড়ির পথে রওয়ানা দিল। ফাহমিদাও ভিজে ভিজে যেতে লাগল।
শামী ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। তার কাছে ছাতা ছিল। কিছু দূর আসার পর দূর থেকে একটা মেয়েকে ভিজে ভিজে যেতে দেখে পা চালিয়ে এগিয়ে এসে বুঝতে পারল, মেয়েটি ফাহমিদা। আরো দ্রুত পা চালিয়ে একদম কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আপনি আমার ছাতাটা নিন।
ফাহমিদা সালামের উত্তর না দিয়ে শামীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমি তো ভিজেই গেছি। আমাকে ছাতা দিলে আপনিও ভিজে যাবেন।
শামী বলল, আমাদের বাড়ি কাছেই। এইটুকু পথ ভিজলে কিছু হবে না। আপনাকে অনেকটা পথ যেতে হবে। ঠাণ্ডা লেগে অসুখ বিসুখ হতে পারে। নিন ধরুন।
ফাহমিদা বলল, তারচেয়ে দুজনেই এক ছাতাতে যাই চলুন।
শামী আর কোনো কথা না বলে দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বলল, আপনার নামটা বলবেন?
ফাহমিদা। আপনার?
শামী।
আপনি তো মাদ্রাসায় পড়তেন, স্কুলে পড়তে অসুবিধে হচ্ছে না? শুনেছি আপনি ফার্স্ট হয়ে নাইনে উঠেছেন।
ঠিকই শুনেছেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস আগে ফণিভূষণ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে কিছুটা কভার করে ছিলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আপনিও তো মেয়েদের স্কুলে ফার্স্ট হয়ে নাইনে উঠেছেন।
আমি তো প্রত্যেক বছরই ফাস্ট হয়ে ক্লাসে উঠি।
আসলে তারা একে অপরকে চিনে। এমন কি উভয়ে উভয়ের ফ্যামিলীর সবকিছু। জানে। তবু তারা মনের আবেগে একে অপরের কাছে নতুন করে পরিচিত হল।
কিছুক্ষণ পর শামী বলল, এবার আপনি ছাতাটি নিয়ে যান, আমাদের বাড়ির কাছে। এসে গেছি। তারপর নিজেই তার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিল।
ফাহমিদা বলল, কিন্তু ফেরৎ দেব কি করে?
শামী বলল, আপনাদের চাকরের হাতে পাঠিয়ে দেবেন।
ফাহমিদার তখন খুব শীত করছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। এতক্ষণ শামীর পাশাপাশি হেঁটে আসতে তার খুব ভালো লাগছিল। তখন শীত লাগলেও পাশাপাশি হাঁটার আনন্দে তা অনুভব করতে পারেনি। এক হাতে বই খাতা বুকে চেপে ধরে অন্য হাতে ছাতা ধরে হাঁটতে লাগল। বাড়িতে এসে তাদের চাকরের হাতে ছাতাটা শামীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।
.
০২.
ফাহমিদার বাবা আবসার উদ্দিন বেশ পয়সাওয়ালা লোক। জমি জায়গা অনেক। বাড়ি ঘর সব পাকা। গ্রামে প্রতিপত্তিও আছে। ওনার তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কানাডায়। মেজ ছেলে লণ্ডনে। ছোট ছেলে হলে থেকে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। সবার ছোট ফাহমিদা। তাদের ফ্যামিলীর সবাই শিক্ষিত ও মডার্ণ। ফাহমিদা এক মেয়ে, তার উপর সবার ছোট। তাই সে খুব আদরে মানুষ হচ্ছে।
সেদিন বাড়িতে এসে ফাহমিদা শামীর কথা ভাবতে লাগল। সেও শুনেছিল, শামী মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে গ্রামের খারাপ ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। তখন তার সাথে পরিচয় না থাকলেও সে কথা শুনে ভেবেছিল, অমন আলেম লোকের ছেলে হয়ে খারাপ হয়ে গেল। তার এরকম ভাবার কারণ ছিল। ভালো ছেলে হিসেবে গ্রামে শামীর বেশ সুনাম ছিল। তারপর যে দিন রাহেলা ও জোবেদার সাথে স্কুলে যাওয়ার সময় শামী জামালকে তার কথা জিজ্ঞেস করে, সেদিন ফাহমিদা সেকথা শুনতে পেয়ে তার উপর খুব রেগে গিয়েছিল। পরে যখন শামী আড়াল থেকে তাকে দেখত তখন ফাহমিদা মনে মনে একটু আফশোষ করত এই কথা ভেবে যে, অত ভালো ছেলে হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিল। কিছুদিন পর তার চাচাতো ভাই হেমায়েতের মুখে শামী আবার স্কুলে পড়ছে শুনে মনে চমক খেয়েছিল। আজ এতটা পথ একসঙ্গে এসে এবং তার সঙ্গে কথা বলে ফাহমিদার তরুণী মনে কেমন যেন আনন্দ অনুভব হতে লাগল।
এরপর থেকে স্কুলে যাতায়াতের সময় তারা দেখা হলে সালাম বিনিময় করে। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে, একে অন্যের পড়াশোনার খবর নেয়। নোট অদল বদল। করে। যেদিন তার বান্ধবীরা সঙ্গে থাকে সেদিন কেউ কারো সাথে কথা বলে না। তবে চোরা চোখে দুজন দুজনকে দেখে।
ব্যাপারটা কিছু দিনের মধ্যে রাহেলা ও জোবেদা বুঝতে পারল। একদিন শামী পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর রাহেলা ফাহমিদাকে বলল, কি ব্যাপার বলতো, শামী যেমন তোকে চোরা চোখে দেখে, তুইও তেমনি শামীকে চোরা চোখে দেখিস?
সাথে সাথে জোবেদা বলে উঠল, আমিও এর আগে কয়েকবার লক্ষ্য করেছি। মনে হচ্ছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়।
এই কথায় তিন জনেই হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে ফাহমিদা বলল, তোদের কি মনে হয়?
রাহেলা বলল, কি আর মনে হবে? তবে তোদের দুজনের মধ্যে যে কিছু একটার শিকড় গজাচ্ছে, তা হলফ করে বলতে পারি।
ফাহমিদা বলল, কিসের শিকড়? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
জোবেদা বলল, অত আর ন্যাকামো করিস নি। ভাজা মাছ যেন উল্টে খেতে জানে না? রাহেলা বলতে না পারলেও আমি বলছি; তোদের মধ্যে ভালবাসার শিকড় গজাচ্ছে।