আজ সকালে ডাক্তার শামীর আব্বাকে বলে দিয়েছেন, আপনার ছেলের কোনো সখ সাধ থাকলে মিটিয়ে দিন। তার অবস্থা ভালো নয়। আমরা তো যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। কিন্তু হায়াৎ মউতের ব্যাপার আল্লাহপাকের হাতে। আমরা বুঝতে পারছি। কয়েক ঘণ্টা তার আয়ু আছে। আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিন।
আব্দুস সাত্তার নিজেও তা বুঝতে পেরেছেন। ডাক্তারদের কথা শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়িতে গিয়ে সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তারা আর বাড়ি যায় নি।
রায়হান, জোবেদা ও ফাহমিদা তখনও হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছায় নি। শামী। একবার করে কাতর চোখে সবাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিরাশ হয়ে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। কিছু বলতে গিয়েও বলছে না।
মাসুমা বিবি তা বুঝতে পেরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছেলের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, তুমি কি কাউকে দেখতে চাচ্ছ?
শামী কোনো কথা না বলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আর তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
এমন সময় রায়হান ওদেরকে নিয়ে এসে বলল, চাচি আম্মা, আপনি একটু সরুন তো?
মাসুমা বিবি সোজা হয়ে পাশে সরে বসলেন। রায়হানের গল্প পেয়ে শামী তার দিকে তাকিয়ে বলল, দোস্ত চললাম, কোনো দোষত্রুটী করে থাকলে ক্ষমা করে দিস। তারপর মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোেমাদের নানান নালায়েক হেলে। তোমাদের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার চিকিৎসার জন্যে মেরা নিঃস্ব হয়ে গেছ। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে আমার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করো, তিনি যেন আমাকে নাজাত দেন। তারপর জোবেদাকে দেখে বলল, তোমার মনেও অনেক কষ্ট দিয়েছি। তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও।
ফাহমিদা এতক্ষণ জোবেদার পিছনে ছিল। তাকে শাম দেখতে পাই নি। সে আর থাকতে পারল না। শামীর কাছে এগিয়ে এসে দরবিগলিত সক্ষে কাল, গম, এই হতভাগী পাপিষ্ঠাকে ক্ষমা করে দাও। নচেৎ জাহান্নামেও আমার জায়গা হবে না। তুমি না ক্ষমা করলে ইহকালে ও পরকালে আমার নাজাতের কোনো উপায় নাই। জুম আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা পাওয়ার জন্য তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তোমাকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না। তারপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
ফাহমিদাকে দেখে ও তার কথা শুনে শামীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। কলল, তুমি সেই এলে, তবে বিদায় বেলায়। এখন যে আমি নিঃস্ব হয়ে পরপারের যাত্র। তোমাকে দেয়ার মতো আজ আমার কিছুই নেই। আছে শুধু ভগ্ন হৃদয়ের পূর্ণ ভালবাসা। তা কি গ্রহণ করবে? আর করেই বা কি হবে? যার আয়ু শেষ, তার ভালবাসার এক কানাকড়িও পৃথিবীর মানুষের কাছে মূল্য নেই। আত্মীয়-স্বজনেরা মৃত্যুর পর মাত্র কয়েকদিন মায়া কান্না কাঁদে। তারপর কালের পরিবর্তনে মানুষ বর্তমানের স্রোতে অতীতের সবকিছু ভুলে যায়।
ফাহমিদা বলল, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে এই পবিত্র পায়ে ঠাই দাও। নচেৎ আমার ধ্বংস অনিবার্য। এই কথা বলে সে শামীর দুপা জড়িয়ে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
শামী কিছুক্ষণ নিথর হয়ে থেকে বলল, ক্ষমা তুমি পেয়েছ। আল্লাহপাক তোমাকে যেন ক্ষমা করেন। এখন কান্না থামিয়ে উঠে বস। বিদায় বেলায় তোমার মুখের হাসি দেখতে চাই। তুমি আমাকে ভুল বুঝলেও আমি তোমাকে বুঝি নি। জানতাম, একদিন না একদিন তোমার ভুল ভাঙবে। সেদিন তুমি আবার আমার কাছে ছুটে আসবে। আজ আমার কি আনন্দ হচ্ছে। আল্লাহ আমার শেষ বাসনাটুকু পূরণ করলেন। দীলে দীলে আল্লাহকে জানিয়ে আসছিলাম, শেষ মুহূর্তে একবারের জন্য হলেও যেন তোমাকে দেখান। আল্লাহ এই নাদান গোনাহগার বান্দার সেই ইচ্ছা পূরণ করিয়ে আমাকে ধন্য করলেন। সে জন্যে তাঁর পাকদরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি। এবার মরে গিয়েও আমি শান্তি পাব। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল, দোস্ত, ফাহমিদা যদি কোনোদিন তোর কাছে কোন বিষয়ে সাহায্য চায়, তা হলে তাকে সাহায্য করবি।
শামীর কথা শুনতে শুনতে সকলের চোখ থেকে পানি পড়ছিল। তাই দেখে শামীর মুখে স্নান হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমরা আমার জন্যে কান্নাকাটি না করে আমার মাগফেরাতের জন্য দোয়া কর। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মা, আমাকে একটু পানি খাওয়াও তো, শেষবারের মতো তোমার হাতে পানি খেয়ে নিই।
মাসুমা বিবি তাড়াতাড়ি পানি এনে চামচে করে ছেলের মুখে দিলেন।
পানি খেয়ে শামী সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কলেমা শাহাদাৎ পড়তে পড়তে নিথর হয়ে গেল।
রায়হান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ডাক্তারকে ডেকে আনার জন্য ছুটে গেল।
ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন, উনি আর ইহজগতে নেই। ইন্নালিল্লাহে … রাজেউন।
ডাক্তারের কথা শুনে আব্দুস সাত্তার ও রায়হান ইন্নালিল্লাহে ……….. রাজেউন।.. পড়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন, অন্যান্যরা সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
শুধু ফাহমিদা মুক ও বধির হয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল।