জোবেদার কথা শুনতে শুনতে ফাহমিদার চোখ থেকেও অঝোরে পানি পড়ছিল। তখন তার মনে হল, আমি বেশি লোভের বশবর্তী হয়ে শামীকে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে আমার সব স্বপ্ন আল্লাহপাক ধূলিস্যাৎ করে দিলেন। সে জোবেদার কথার উত্তরে তার খালাত ভাই মালেকের চরিত্রের সব কিছু খুলে বলল। তারপর জোবেদার গলা ধরে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, আমাকে শামীর কাছে নিয়ে চল। আমি তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব। সে ক্ষমা না করলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবে না।
জোবেদা বলল, শামী ভাই একদিন আমাকে একটা খাম দিয়ে বললেন, ফাহমিদার সঙ্গে যদি কখনও তোমার দেখা হয়, তা হলে তাকে দিয়ে বলল, এটা যেন সে মেহেরবাণী করে পড়ে। দাঁড়া, সেটা তোকে এনে দিচ্ছি। তারপর একটা বাক্স থেকে খামটা বের করে এনে তার হাতে দিয়ে বলল, আমাকে পড়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমি পড়েছি। তোর জিনিস তুই পড়ে দেখ।
ফাহমিদা খাম থেকে একটা কাগজ বের করে দেখল, তার দুপৃষ্ঠায় লেখা দুটো কবিতা। পড়তে শুরু করল, প্রথম পৃষ্ঠার কবিতার নাম অহঙ্কারীনি, কবি আব্দুস শামী।
পাঁচ বছর পূর্বের কথা,
মনে আছে কি তোমার?
সেদিন তুমি প্রহর গুণেছিলে
অপেক্ষায় ছিলে আমার।
আজ তুমি আমায় দেখে
অভিনয়ের স্বরে ডাক,
রাস্তা ঘাটে আমায় দেখে
অবহেলা দেখিয়ে থাক।
আধুনিকা মেয়েরা এত যে পাষাণী
জানতাম না আমি এর পূর্বে,
হামসে খুব সুরতওয়ালী কৌন হ্যায়।
এই কথা ভেবে চল বুক ফুলিয়ে গর্বে।
রূপসী ও ধনবতী কন্যা বলে
গরিবে করেছ যথেষ্ট অপমান,
রূপ নিয়ে শুধু চোখ ঝলসান যায়।
মনকে জয় করা যায় না কখন।
হ্যাঁ, আছে একদল মানুষ নামের কলংক
হিংস্র মেজাজের পশু, রূ
প দেখলে পাগল হেয় যায় তারা।
হুঁশ বুদ্ধি তাদের ঠিক থাকে না কিছু।
তোমার মত অহঙ্কারী ম্যাডাম
শত শত আছে বাজারে সমান।
আশ্রয় তাদের পতিতালয়ে।
তাদের শরীরের উপর দিয়ে যায় কত ঝড় তুফান।
রূপের গর্ব যদি থাকে তোমার ওগো রূপসী
একবার যেয়ে দেখ না সেখানে,
অহঙ্কার তোমার হবে চূরমার।
শত রূপবানের ভক্ষণে।
ফাহমিদা প্রথম পৃষ্ঠার কবিতাটা শেষ করে দ্বিতীয় পৃষ্ঠার কবিতাটা পড়তে লাগল। কাবতার নাম
হে প্রভু
তোমার করুণা কাম্য মোদের
দাও হে শক্তি দাও হে প্রভু,
থাকিতে পারি যেন মোরা
মিলন লগ্নাপেক্ষায় শুধু।
হে প্রভু, বিচলিত না হই যেন,
মোদের অন্তরে দাও সে শক্তি
মোরা যে দুর্গম পথের যাত্রী
কেটেছে কত দিবা রজনী।
অকুল সাগরে আল্লাহ, তুমি ভরসা
তুমিই মোদের একমাত্র আশা।
তোমারি নামে করেছি শপথ।
চিরকাল আমি ভুলব না তারে,
এই বিশ্বাস থাকে যেন মোর উপরে
হে আল্লাহ তুমি সেই জ্ঞান দাও গো তারে।
হে প্রভু আমি যে নিঃস্ব
কি দিয়ে সুখী করব তারে,
আছে শুধু পবিত্র ভালবাসা,
সেটাই স্থান পায় যেন তারই অন্তরে।
ফাহমিদা কবিতাটা পড়ে ভাঁজ করে খামের ভিতর রাখল। তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জোবেদার দিকে তাকিয়ে বলল, শামীর কথাই ঠিক, আজ আমার রূপের সকল অহঙ্কার চূর্ণ হয়েছে। তারপর আবার বলল, কিরে, আমাকে শামীর কছে নিয়ে যাবি না?
জোবেদা বলল, হ্যাঁ নিয়ে যাব। আর একটু অপেক্ষা কর, রায়হান ভাই আসুক।
এমন সময় রায়হান জোবেদাদের সদরে এসে তার হোট বোন জয়তুনকে দেখতে পেয়ে জোবেদাকে ডেকে দিতে বলল।
জয়তুন জোবেদার কাছে গিয়ে বলল, আপা তোমাকে রায়হান ভাই ডাকছেন।
জোবেদা এতক্ষণ ফাহমিদার সঙ্গে নিজের রুমে কথা বলছিল। ছোট বোনের কথা শুনে ফাহমিদাকে সঙ্গে নিয়ে সদরে এল।
জোবেদার সঙ্গে ফাহমিদাকে দেখে রায়হান বেশ অবাক হল। সেই সঙ্গে রাগে তার চোয়াল দুটো আপনা থেকে শক্ত হয়ে উঠল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে জোবেদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তাড়াতাড়ি এস, এমনি অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ফাহমিদা রায়হানের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। সে একরকম ছুটে এসে বসে পড়ে তার পায়ে হাত রেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, রায়হান ভাই; আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি। আমাকে বোনের মতো মনে করে ক্ষমা করে দিয়ে শামীর কাছে নিয়ে চলুন। আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব। আমার বিশ্বাস, সে নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করবে। তারপর সে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
রায়হান কঠিন পাথরের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
জোবেদা বলল, আপনি ওকে ক্ষমা করে দিন রায়হান ভাই। সত্যি সত্যি ওর ভুল ভেঙ্গেছে। তাই আমার কাছে এসে সেকথা জানিয়ে কান্নাকাটি করে শামী ভাইয়ের কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। অপরাধী যখন নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চায় তখন তাকে ক্ষমা করাই তো মহত্ত্বের লক্ষণ। আল্লাহপাক ক্ষমা প্রার্থীকে ক্ষমা করেন। আর যারা ক্ষমা প্রার্থীকে ক্ষমা করে তাদেরকে ভালবাসেন। এটা হাদিসের কথা। হাদিসে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, এমরানের পুত্র মুসা (আঃ) জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, হে প্রভু! তোমার নিকট সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি কে? আল্লাহ বলিলেন, ক্ষমতাশীল হইয়াও যে ক্ষমা করে। এসব কথা আমি মুগ্ধ হয়ে আপনাকে আর কি বলব। আপনি তো আলেম লোক। আপনাকে এই সব বলে বেয়াদবি করে ফেললাম। সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
রায়হান ফাহমিদাকে দেখে ভীষণ রেগে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ তারই জন্য প্রীয় বন্ধু শামী আজ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। জোবেদার কথা শুনে তার রাগ পড়ে গেল। বলল, জোবেদা, হাদিসের কথা বললে বেয়াদবি হয় না। বলে। বরং আমার উপকার করলে, তোমার কথা শুনে রাগ পড়ল। নচেৎ ফাহমিদাকে হয়তো যাতা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিতাম। তারপর ফাহমিদার হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল, তুই বড় দেরি করে ফেলেছিস বোন। আয় আমাদের সঙ্গে। এই কথা। বলে হাঁটতে শুরু করল।