শাকেরা খানম বেশ অবাক হয়ে বললেন, চলে যাচ্ছিস কেন? দাঁড়া মালেক এল না কেন?
ফাহমিদা দাঁড়াল না। যেতে যেতে বলল, কেন এল না তা আমি কি করে বলব? সে এলে জিজ্ঞেস করো।
শাকেরা খানম মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, নিশ্চয় মালেকের সঙ্গে কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হয়েছে। ফাহমিদা এখন রেগে আছে। রাগ পড়লে পরে জিজ্ঞেস করা যাবে, এই কথা ভেবে নিজের কাজে মন দিলেন।
বিকেলে শাকেরা খানম মেয়ের রুমে গিয়ে দেখলেন, ফাহমিদা কাপড় পাল্টাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবি?
ফাহমিদা বলল, একটু জোবেদার কাছে যাব।
শাকেরা খানম আবার জিজ্ঞেস করলেন, মালেক এল না কেন তখন বললি না যে?
ফাহমিদা কাপড় পড়া শেষ করে মালেকের ক্রিয়া কলাপ যতটা সম্ভব বলে কেঁদে ফেলল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, একটা মদখোর, মাগী খোর ছেলের সাথে তোমরা যদি আমার বিয়ে দাও, তা হলে আত্মহত্যা করব।
শাকেরা খানম মেয়ের মুখে মালেকের চরিত্রের অবনতির কথা শুনে খুব অবাক হলেন। বললেন, সত্যি সে যদি ঐরকম ছেলে হয়, তা হলে তোর আব্বাকে বলে বিয়ে ভেঙ্গে দেব।
ফাহমি কিছু না বলে জোবেদাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
জোবেদা তাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ঝাঝালো স্বরে বলল, তোকে না আমাদের বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছিলাম? আর তুইও তো সেদিন আসবিনা বলে গরম দেখিয়ে চলে গেলি। আজ আবার হঠাৎ কি মনে করে? শামী ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে খুশী হতে এসেছিস বুঝি?
ফাহমিদা জোবেদার কথা শুনে চমকে উঠে কেঁদে ফেলল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি বললি, শামী নেই? আল্লাহ গো তুমি একি খবর শোনালে? আমি যে তার কাছে মাফ চাইতে পারলাম না। সে না মাফ করলে আমি যে তোমার কাছেও মাফ পাব না। তারপর জোবেদাকে ছেড়ে দিয়ে তার দুটো হাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে বলল, তুই আমাকে গলা টিপে মেরে ফেল। আমি যে কত বড় ভুল করেছি, তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি। সেই জন্য তো তোর কাছে ছুটে এলাম শামী ভাইয়ের কাছে। মাফ চাইতে যাব বলে। আর তুই যে কথা শোনালি তা কি সত্যি? বল জোবেদা বল।
ফাহমিদা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে জেনে জোবেদা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুই বড় দেরি করে ফেলেছিস। কয়েকদিন আগে যদি তোর ভুল ভাঙত, তা হলে শামী ভাই হয়ঙ্গে বেঁড়ে যেত। এখন যা অবস্থা এই আছে তো এই নেই। আমি রায়হান ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। সে প্রতিদিন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় শামী ভাইকে দেখতে। আজ আসতে এত দেরি করছে কেন কি জানি? জানিস, যেদিন তুই শামী ভাইকে ঐসব কথা বলে বিদায় করে দিলি, সেদিন থেকে শামী ভাই আহার নিদ্রা ত্যাগ করে শুধু তোর নাম বিড়বিড় করে বলত। তারপর কয়েক দিনের মধ্যে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। আমি ও রায়হান ভাই কত করে তোকে ভুলে যাওয়ার জন্য বুঝিয়েছি। ওর বাবা যত রকমের চিকিৎসা আছে, সব করিয়েছেন, তাবিজ তদ্বীরও অনেক করিয়েছেন। এই সব করাতে গিয়ে জমি জায়গা বিক্রি করে একরকম নিঃস্ব হয়ে গেছেন। শেষে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা বলে। দিয়েছেন, শামী ভাই আর বাঁচবে না, যে কোন সময় মারা যাবে। তবু যতক্ষণ শ্বাস। ততক্ষণ আশ, এই কথা ভেবে চিকিৎসা চলছে। ডাক্তাররা তার ভালবাসার কথা শুনে বলেছেন, যদি মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে দেয়া সম্ভব না হয়, তা হলে অন্য একটা ভালো। মেয়ে দেখে বিয়ে দেন। নচেৎ ওকে বাঁচান যাবে না। ডাক্তারের কথা শুনে ওর বাবা রায়হান ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আব্বার কাছে এসে আমার সঙ্গে শামী ভাইয়ের বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। ওনার সঙ্গে রায়হান ভাইও এসেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, জোবেদা তুমিই একমাত্র শামীকে বাঁচাতে পার। আমি বললাম, বলুন কি করতে হবে। রায়হান ভাই বললেন, তুমি শামীকে বিয়ে কর। আমাদের বিশ্বাস, তুমি তোমার প্রেম ভালবাসা দিয়ে শামীর মন থেকে ফাহমিদার কথা ভুলতে পারবে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, তাই যদি আপনারা মনে করেন, তা হলে শামী ভাইকে বাঁচাবার জন্য আমি রাজি। কিন্তু আব্বা কিছুতেই রাজি হল না। বলল, একটা মৃত্যু পথযাত্রী ছেলের সঙ্গে জেনেশুনে বিয়ে দিয়ে আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারব না। আর লোকজন শুনলে আমাকে কি বলবে আপনারা ভেবে দেখেছেন? আমি আমার নিজের কাছেও ছোট হয়ে যাব। না না, এ প্রস্তাব আমি কখনই মেনে নিতে পারি না। আপনারা চলে যান। আব্বার কথা শুনে আমি রায়হান ভাইকে গোপনে বললাম, আব্বাকে রাজি করাবার দরকার নেই। শামী ভাইকে দেখতে আমি তো হাসপাতালে যাই। আজ যখন যাব তখন সেখানেই বিয়ে পড়িয়ে দেবেন। আপনারা আগের থেকে হাসপাতালে কাজী সাহেবকে হাজির রাখবেন। ওনারা সবকিছু করেছিলেন। আমিও গিয়েছিলাম, কিন্তু শামী ভাই কিছুতেই রাজি হলেন না। সবাই অনেক করে বোঝাল। তাতেও কিছু হল না। শেষে লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে আমি তার পায়ের উপর পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, শামী ভাই, তুমি জান কিনা জানি না, আমি তোমাকে বহুদিন আগে থেকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি। তুমি ফাহমিদাকে ভালবাস জানতে পেরে তা কোনোদিন তোমাকে জানাইনি। আর কোনো দিন জানাতামও না। তোমার অবস্থা দেখে আজ বাধ্য হলাম। তুমি আমাকে বিয়ে করে দেখ, আমি আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও প্রেম ভালবাসা দিয়ে এবং সেবা শুশ্রূষা করে তোমাকে ভালো করে তুলবই। শাম। ভাইয়ের তো নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। তাই শুধু চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি তা জানি জোবেদা। কিন্তু এতদিন যখন সেকথা গোপন রেখেছিলে তখন প্রকাশ করা তোমার উচিত হল না। তুমি নিশ্চয় জান, ফাহমিদাকে আমি কত ভালবাসি। তাকে ছাড়া জীবনে অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে কখনও যে তাকাইনি তাও তুমি জান। এতকিছু জেনেও কেন এরকম করলে? আমার হায়াত যত দিন আছে ততদিন ফাহমিদা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের কথা আমি ভাবতে পারব না। তা ছাড়া মনে হচ্ছে আমার হায়াৎ আর বেশি দিন নেই। তার আগে যদি একবার ফাহমিদাকে দেখতে পেতাম, তা হলে শেষ বাসনা পূরণ হত। তারপর ফাহমিদার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করল, এবার বল দেখি, তোর ভুল ভাঙ্গল কি করে? তোর খালাত ভাইয়ের সঙ্গে তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তার গাড়িতে চড়ে একদিন তোকে কোথায় যেতেও দেখলাম। এই কয়েক দিনের মধ্যে কিসে কি হল বল?