একদিন শামী বন্ধুদের সাথে রাস্তায় আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় তিনটে মেয়েকে স্কুলে যেতে দেখে জামালকে জিজ্ঞেস করল, সবার আগে আগে যে মেয়েটা যাচ্ছে। তাকে চিনিস?
জামালের বাড়ি এই গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায়। সে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ওতো আমাদের পাড়ার আবসার উদ্দিন চাচার মেয়ে ফাহমিদা।
শামীদের বাড়ি উত্তর পাড়ায়। তাই সে ফাহমিদাকে দেখলেও কম দেখেছে। এখন তার নাদুস-নুদুস চেহারা ও রূপ দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। বলল, তাইতো চেনা চেনা মনে হচ্ছে। অনেক দিন দেখিনি বলে ঠিক চিনতে পারিনি। শামী ফাহমিদাকে যতদূর দেখা গেল তার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে তার কিশোর মনে কি এক রকমের যেন অনুভূতি জন্মাল। এরপর থেকে সে ফাহমিদাকে স্কুলে যাতায়াতের সময় একাকি আড়াল থেকে দেখতে লাগল। প্রতিদিন তাকে দেখা যেন তার নেশা হয়ে দাঁড়াল। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো দিন তার মুখোমুখি হতে সাহস করল না। এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর তার মনের পরিবর্তন হল। চিন্তা করল, গ্রামে। আরো কত মেয়ে আছে, কই, তাদেরকে তো দেখতে ইচ্ছা করে না? ওকে দেখার জন্য মন এত উতলা হয় কেন? যদি কোনো দিন ফাহমিদা স্কুলে না যায়,, সেদিন মন খুব খারাপ হয়ে থাকে কেন? হঠাৎ তার মন বলে উঠল, ফাহমিদা বড় লোকের মেয়ে। তোমরা তাদের তুলনায় কিছুই না। তা ছাড়া সে লেখাপড়া করছে, আর তুমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আজে বাজে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছ। ফাহমিদাকে যদি তোমার ভালো লাগে, তাকে যদি আপন করে পেতে চাও, তা হলে তুমি ভালোভাবে লেখাপড়া করে তাকে টেক্কা দাও। ভালো ছাত্রকে সকলে ভালবাসে। ভালো ছাত্র হতে পারলে, শুধু ফাহমিদা কেন, তারমতো সব মেয়েরা তোমাকে ভালবাসবে। এই সব চিন্ত 1 করে সে সিদ্ধান্ত নিল, মাদ্রাসায় না পড়ে স্কুলে পড়বে। একদিন শামী তার মাকে বলল, এবারে আব্বা এলে তাকে বলল, আমি মাদ্রাসায় পড়ব না, স্কুলে পড়ব। আর স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তো এখনো তিন চার মাস বাকি, তাই এই কমাস প্রাইভেট মাস্টারের কাছে অংক ও ইংরেজী শিখব।
মাসুবা বিবি ছেলের কথা শুনে খুশী হলেন। বললেন, ঠিক আছে, আজই আমি সে। কথা লিখে তোর আব্বাকে চিঠি দিচ্ছি।
স্ত্রীর চিঠি পেয়ে আব্দুস সাত্তার এক বৃহস্পতিবারে বাড়ি এলেন। এক সময়ে স্ত্রীকে বললেন, আমার খুব ইচ্ছা ছিল, ওকে একজন বড় আলেম করার। ভেবেছিলাম, ওকে আমার কাছে রেখে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেব। কিন্তু ও যখন মাদ্রাসায় না পড়ে স্কুলে পড়তে চাচ্ছে তখন আর কি করা যাবে। আজকাল ছেলেদেরকে শাসন করলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ঠিক আছে, ও স্কুলেই পড়ুক।
প্রত্যেকবারে আব্বা বাড়িতে এলে শামী যে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি পালিয়ে যায়। এবারে গেল না। সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মাকে বলল, তুমি আব্বাকে আমার কথা বলেছিলে?
আব্দুস সাত্তার বাড়িতে ছিলেন না। শামী যখন নাস্তা খেতে খেতে মাকে ঐ কথা বলল ঠিক তখনই এলেন। শামীকে নাস্তা খেতে দেখে বললেন, নাস্তা খেয়ে আমার কাছে আসবি, কথা আছে। তারপর তিনি ঘরের ভিতরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন।
মাসুমা বিবি স্বামীকে নাস্তা খেতে দিলেন।
শামী নাস্তা খেয়ে ঘরে ঢুকে এক পাশে দাঁড়াল।
আব্দুস সাত্তার খেতে খেতে বললেন, তোর আম্মা বলছিল, তুই নাকি তিন চার মাস প্রাইভেট পড়ে স্কুলে ভর্তি হতে চাচ্ছিস?
শামী মাথা নিচু করে বলল, জি।
আব্দুস সাত্তার বললেন, পড়তে চাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু আবার যদি পাগলামি করিস, তা হলে একদম জানে শেষ করে দেব।
শামী কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
মাসুমা বিবি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই কোন মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়বি বলছিলি, তার কাছে গিয়ে বেতন ঠিক করে পড়াশোনা শুরু কর।
শামী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রামপালের দিকে রওয়ানা দিল।
আলদিবাজার থেকে প্রায় দু-আড়াই মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে রামপাল। সেখানে বালক ও বালিকাদের আলাদা হাই স্কুল আছে। শামী স্কুলে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর একদিন রামপালে গিয়ে স্কুলের ফণিভূষণ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে রেখেছিল। আজ তার কাছে বেতন ঠিক করে এল।
পরের দিন থেকে শামী ওনার কাছে পড়তে লাগল। আর ঘরেও রীতিমত পড়তে লাগল। তারপর জানুয়ারি মাসে রামপাল বয়েজ হাই স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরও সে ফণিভূষণ স্যারের কাছে ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরে।
শামী আগেই জেনেছিল, ফাহমিদা রামপাল গার্লস হাই স্কুলে পড়ে। স্কুলে যাতায়াতের পথে মাঝে মধ্যে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। তবে পাশ থেকে যাওয়ার সময় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখে। কয়েকবার চোখে চোখও পড়েছে। তাতেই একে অপরের মনের ভাব একটু বুঝতে পারে। ফাহমিদার সঙ্গে সব সময় রাহেলা ও জোবেদা থাকে। তাই শামীর ফাহমিদার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারে না। রাহেলা ও জোবেদা এই গ্রামেরই মেয়ে। রাহেলাদের বাড়ি পূর্ব পাড়ায় আর জোবেদাদের বাড়ি ফাহমিদাদের পাড়ায়। তারাও ক্লাস এইটে পড়ে।
হাফইয়ার্লি পরীক্ষায় শামী স্ট্যাণ্ড করতে না পারলেও ফোর্থ হল। কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে ক্লাস নাইনে উঠল।