শামী ম্লান হেসে বলল, জোবেদা যে ভালবাসে তা আমাকে না বললেও আমি জানি। কিন্তু আমার এই হৃদয়ে ফাহমিদা এমনভাবে গেঁথে আছে, তাকে যেমন ভুলতে পারব না তেমনি অন্য কোনো মেয়েকে এ হৃদয়ে স্থান দিতে পারব না। তাতে যদি আমার মৃত্যু হয়, তবুও সম্ভব নয়। তুই আমাকে আর কখনও বিয়ের কথা বলবি না। তার চেয়ে বিষ এনে দে, তাতে বরং খুশী হব।
রায়হান কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোকে বন্ধুত্বের দাবিতে আল্লাহপাকের কসম দিয়ে বলছি, বিয়ের ব্যপারে আমাকে পিড়াপিড়ী করবি না, দোহাই। লাগে তোকে।
এরপর রায়হান আর কিছু বলতে পারল না। শামীর কাছ থেকে বেরিয়ে এসে তার মা-বাবাকে বলল, আমি শামীকে বিয়ে করার জন্য কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না। তারপর তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কসম দেয়ার কথা বলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ি চলে গেল।
মাসুমা বিবি ও আব্দুস সাত্তার ছেলের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
যত দিন যেতে লাগল শামীর শরীর তত ভেঙ্গে পড়তে লাগল। এখন সে আর বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারে না। আব্দুস সাত্তার হেকেমী, কবিরাজি, ডাক্তারী কোনো চিকিৎসাই করাতে বাকি রাখলেন না। এমনকি ঢাকার এক পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ তদবির করালেন, কুরআন খতম দিলেন, খতমে ইউনুস করালেন। কিন্তু কোনো। কিছুতেই শামীর শারীরিক কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং দিন দিন সে কাহিল হয়ে পড়তে লাগল। ফাহমিদার সেদিনের কথাগুলো তাকে এত বেশি আঘাত করেছে, যা সে সহ্য করতে পারছে না। তাই কোনো এক আরবী কৰি তার এক কবিতায় লিখেছেন
যারা হাতো সেনানে লা মাত্তেইয়ামো
ওয়ালা ইয়ালতামো মাজারাহাল লেসানে
অর্থাৎ মানুষের মুখের কোনো কোনো কথা এই রকম বিষাক্ত ও পীড়াদায়ক যে, ধনুকের তীরের চেয়েও মারাত্মক। কারণ ধনুকের তীর কোনো প্রাণীর শরীরে আঘাত করলে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং বেদনা অনুভব হয়। আবার ওষুধের মাধ্যমে তা ভালো করা যায়। কিন্তু মানুষের মুখের দ্বারা মানুষের মনে যে আঘাত লেগে ক্ষতের ও বেদনার সৃষ্টি হয়, তার কোনো ওষুধ নেই। আমরণ রুগীকে পীড়া দিতে থাকে।
কবির এই মূল্যবান কথা সত্য না মিথ্যা শামী এবং ফাহমিদা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আব্দুস সাত্তার যখন ছেলের সব রকমের চিকিৎসা করিয়ে দেখলেন, তার অসুখ ভালো না হয়ে দিন দিন বাড়ছে তখন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে তার চিকিৎসা চলতে লাগল।
৭. জোবেদার সাথে রাগারাগি
৭.
ফাহমিদা যেদিন শামীকে ঐসব কথা বলে এবং জোবেদার সাথে রাগারাগি করে চলে যায় তার কিছুদিন পর খালাত ভাই মালেক তাদের বাড়িতে এল। একদিন থেকে পরের দিন খালাকে বলল, আম্মা ফাহমিদাকে নিয়ে যেতে আমাকে পাঠিয়েছে।
শাকেরা খানম শুনে খুশী হয়ে বললেন, বেশ তো বাবা নিয়ে যাও। এসেছ যখন তখন আরো দুচারদিন থাক। তারপর নিয়ে যেও।
মালেক বলল, অন্য সময় এসে থাকব। আজ বিকেলেই ওকে নিয়ে যেতে মা বলে দিয়েছে। আজ রাতে আমাদের বাড়িতে একটা ফাংসান আছে। ফাংসানের কথাটা সে মিথ্যে করে বলল।
শাকেরা খানম বললেন, তা হলে তো তোমার আজই যাওয়া উচিত। খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে যেও। তোমার খালু আসুক, তাকে বলব।
আবসার উদ্দিন বাড়িতে ছিলেন না। জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে সদরে গিয়েছিলেন। দুপুরে ফিরলেন।
খাওয়াবার সময় শাকেরা খানম স্বামীকে মালেকের কথা বললেন।
আবসার উদ্দিন বললেন, তুমি কি বল?
শাকেরা খানম বললেন, আমি আর কি বলব, খালার বাড়ি যাবে, তাতে আবার বলা-বলির কি আছে? তা ছাড়া কদিন পরে তো সে তাদের বৌ হবে।
আবসার উদ্দিন বললেন, আমিও তাই মনে করি।
বিকেলে মালেক ফাহমিদাকে নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা দিল। মালেক গাড়ি নিয়ে। এসেছিল। সে নিজেই ড্রাইভ করে। ফাহমিদা মালেকের পাশে দরজার কাছে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিল। মালেক একহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে অন্য হাতে ফাহমিদার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, আমার কাছে বস না, তোমার গায়ের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে। তারপর ফাহমিদার হাত ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধের উপর রেখে বলল, আমার খুব ইচ্ছা তোমাকে শিগ্রী বিয়ে করার। তোমার মতামতটা বলবে?
মালেক তাকে ঐভাবে টেনে নিতে তার একপাশের উন্নত বক্ষ মালেকের শরীরে ঠেকে আছে। তাতে ফাহমিদার বেশ লজ্জা পেলেও সারা শরীরে অজানা এক আনন্দের শিহরণ বয়ে যেতে লাগল। তারপর বিয়ের কথা শুনে আরো বেশি লজ্জা পেয়ে কোনো কথা বলতে পারল না।
তাই দেখে মালেক তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল, কি, কিছু বলছ না কেন?
ফাহমিদা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, প্লীজ হাতটা সরিয়ে নিন। পথিকরা দেখলে কি ভাববে? আমার লজ্জা পাইনি বুঝি?
মালেক হাতটা সরিয়ে নিতে ফাহমিদা সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, আমার মতামত আপনি কি বুঝতে পারেন নি? না পেরে থাকলে আব্বা-আম্মার কাছ থেকে জেনে নেবেন।
মালেক বলল, তার আর দরকার নেই। এবার বল, এখনও তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? আর বলবে না কেমন? মনে থাকবে তো?
ফাহমিদা বলল, থাকবে।
তুমি চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, লালবাগের কেল্লা, শিশুপার্ক দেখেছ?
ছোট বেলায় আব্বার সঙ্গে একবার শুধু চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়েছিলাম। সে সময় শিশুপার্ক দেখতে চাইলে আব্বা বলল, পরে আর একদিন এসে দেখবি। আজ সময় হবে না।