.
ঐ দিন রায়হান শামীদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে জোবেদার কাছে গেল।
জোবেদা তাকে দেখে সালাম বিনিময় করে বলল, রায়হান ভাই যে, কেমন। আছেন?
রায়হান ফাহমিদার বান্ধবী জোবেদা ও রাহেলাকে ভালোভাবেই চিনে। রাহেলার চেয়ে জোবেদা দেখতে শুনতে অনেক ভাল। রায়হান জানে ফাহমিদার সঙ্গে জোবেদার বেশি ভাব, তাই তার কাছে ফাহমিদার সব কথা জানার জন্য এসেছে। জোবেদার কথা শুনে বলল, আল্লাহপাকের রহমতে একরকম ভালো আছি। কিন্তু শামীর অবস্থা খুবই খারাপ। সেদিন ফাহমিদা শামীকে কি বলেছিল? যে জন্যে সে আজ শয্যাশায়ী। না খেয়ে খেয়ে বিছানার সঙ্গে লেগে গেছে। তার মা-বাবা চিকিৎসা করিয়েও কিছু করতে পারছে না। তোমাদের বাড়িতেইতো ওদের দুজনার সেদিন কথা হয়েছিল? তুমি কি সে সব জান?
জোবেদা ও রায়হানকে ভালভাবে চিনে, সে যে শামীর অন্তরঙ্গ বন্ধু তাও জানে। বলল, হ্যাঁ জানি। তারপর ফাহমিদা ও শামীর মধ্যে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল সব বলল। শেষে আরো বলল, ফাহমিদা যে এরকম করবে তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। সেদিন শামী ভাই চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে এই ব্যাপার নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছি। তার সঙ্গে চিরজীবনের মতো সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।
রায়হান বলল, শামীর জন্য খুব দুঃখ হয়। সে ফাহমিদাকে এত বেশি ভালবেসেছে যে, তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বেশি দিন বাঁচবে না।
জোবেদাও মনের অজান্তে অনেকদিন থেকে শামীকে ভালবাসে। শামীও ফাহমিদা দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবাসে জেনে এতদিন নিজেকে কঠোরভাবে সংযত করে রেখেছিল, আজ আর পারল না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, রায়হান ভাই, আপনি জেনে রাখুন, শামী ভাইয়ের কিছু হলে আমিও আপনার থেকে কম দুঃখ পাব না। আর ফাহমিদার বিচার আল্লাহ করবেন। তারপর সে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
রায়হান বুঝতে পারল, জোবেদাও শামীকে গভীরভাবে ভালবাসে। কিন্তু তা কাউকে জানতে দেয় নি। তার কথা শুনে রায়হানের চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, যেমন করে হোক জোবেদার সঙ্গে শামীর বিয়ে দিতে হবে।
পরেরদিন রায়হান শামীর কাছে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য যাবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু রাতে খবর এল মামার খুব অসুখ। তাই সকালে মাকে সঙ্গে করে মামার বাড়ি মিরকাদিতে যেতে হল। কয়েকদিন থেকে মামার অবস্থা একটু ভালো হওয়ার পর মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
আব্দুস সাত্তার রায়হানদের বাড়িতে এলে রায়হান সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন চাচা? কবে এলেন?
আব্দুস সাত্তার বললেন, আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি। তিন চার দিন হল এসেছি। শামীর ব্যাপারে কথা বলব বলে এলাম। তোমার চাচি আম্মা বলেছিল, তুমি দুই একদিনের মধ্যে যাবে, দেরি দেখে খোঁজ নিতে এসেছি।
রাযহান মামার অসুখের কথা বলে বলল, গতকাল ফিরেছি। আজ আপনি না এলেও যেতাম। আসুন সদরে এসে বসুন। তারপর ওনাকে সদরে বসিয়ে চা বিস্কুট দিয়ে বলল, শামী এখন কেমন আছে?
আব্দুস সাত্তার চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে বললেন, আগে যা দেখে এসেছিলে তার চেয়ে আরো খারাপ। তুমি গিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করাও।
রায়হান বলল, সে কথা আনপাকে বলতে হবে না। সেদিন তাকে বিয়ে করার কথা বলে অনেক বুঝিয়েছি। মেয়েও আমি দেখে রেখেছি। পুবপাড়ার কায়েস চাচার মেয়ে জোবেদা। কায়েস চাচাঁদের সব কিছুতো আপনি জানেন, জোবেদাকেও আপনি। দেখেছেন। শামী ও জোবেদা দুজন দুজনকে চেনে। আমার মনে হয়, আপনাকে নিয়ে আমি প্রস্তাব দিলে কায়েস চাচা রাজি হয়ে যাবেন।
আব্দুস সাত্তার বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। আমি ওদের সবাইকে চিনি, তবে তোমার চাচি আমাকে আবসার উদ্দিনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলেছিল। এ ব্যাপারে তুমি কি বল?
রায়হান বলল, না না, এটা ঠিক হবে না। কারণ উনিতো রাজি হবেনই না, প্রস্তাব দিতে গেলে বরং আপনি অপমানিত হবেন।
আব্দুস সাত্তার বললেন, সেকথা আমারও মনে হয়েছে। এখন তুমি আমার সঙ্গে চল। প্রথমে শামীকে রাজি করাও, তারপর আমরা কায়েসের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাব।
ততক্ষণ আব্দুস সাত্তারের চা খাওয়া হয়ে গেছে। রায়হান কাপ পিরিচ নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এগুলো রেখে আসি। একটু পরে ফিরে এসে ওনার সঙ্গে রওয়ানা হল।
বাড়িতে এসে রায়হান শামীকে দেখে চমকে উঠল। এই কদিনের ব্যবধানে তাকে চেনাই যায় না। তার মনে হল, শামী যেন মৃত্যুর দোর গোড়ায় পৌঁছে গেছে।
রায়হানের চোখ দুটো আপনা থেকে পানিতে ভরে উঠল। ভিজে গলায় বলল, শামী, তুই নিজের সর্বনাশ নিজেই করছিস? সেদিন তোকে অত করে বললাম, ফাহমিদাকে মন থেকে মুছে ফেল। সে তার খালাতো ভাইকে বিয়ে করে সুখে থাকবে আর তুই তার জন্যে নিজের জীবন শেষ করতে চলেছিস। তাকে ভালবাসিস সেটা ভালো কথা; কিন্তু তাকে না পেয়ে মৃত্যুপথের যাত্রী হওয়া কি মানুষের কাজ হচ্ছে? একটা মেয়ে যা সহজে করতে পারল, তুই পুরুষ হয়ে তা পারছিস না কেন? আমার কথা শোন, আমি তোর আব্বার সঙ্গে কথা বলেছি, জোবেদার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। তোর কোনো কথা শুনব না। ঐ দিন এখান থেকে ফিরে গিয়ে ফাহমিদার সঙ্গে তোর কি কথা হয়েছিল ভালো করে জানার জন্য আমি জোবেদার কাছে গিয়েছিলাম। তার কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম সে তোকে ভীষণ ভালবাসে। তোর অসুখের কথা শুনে ঝর ঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, শামী ভাইয়ের কিছু হলে সে ভীষণ দুঃখ পাবে।