শামী মোনাজাতের পর কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল।
মাসুমা বিবি জাহেদকে মসজিদ থেকে নামায পড়ে ফিরতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, শামী নামায পড়তে গিয়েছিল তাকে দেখেছ?
জাহেদ বলল, আমি যখন আসি তখনও শামী ভাই নামায পড়ছিল।
এই কথা শুনে মাসুমা বিবি নামায পড়ার জন্য পুকুর ঘাটে অযু করতে গেলেন। নামায পড়ার পরও যখন শামী এল না তখন জাহেদকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, যাও তো বাবা শামী আসছে না কেন একটু দেখে এস।
জাহেদ ফিরে এসে বলল, শামী ভাই কুরআন তেলাওয়াত করছে।
মাসুমা বিবি বললেন, তুমি তাকে ডাক নি?
জাহেদ বলল, জি ডেকেছি। বলল, তুই যা আমি একটু পরে আসছি।
মাসুমা বিবি বললেন, তুমি আর একবার যাও বাবা। গিয়ে বলবে, আমি তার জন্যে ভাত বেড়ে বসে আছি।
জাহেদ মসজিদে গিয়ে দেখল, শামী ঘুমাচ্ছে। কয়েকবার শামী ভাই শামী ভাই বলে ডেকে সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে জাগাতে চেষ্টা করল।
শামীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখল, জাহেদ ডাকছে।
তাকে তাকাতে দেখে জাহেদ বলল, চাচি আম্মা তোমাকে ডাকছে। ভাত বেড়ে তোমার জন্য বসে আছে।
শামী বলল, তুই আম্মাকে ভাত খেয়ে নিতে বল, আমার ক্ষিধে নেই আমি ভাত খাব না।
জাহেদ ফিরে এসে চাচি আম্মাকে সেকথা জানাল।
মাসুমা বিবি বললেন, ঠিক আছে, তুমি ঘরে যাও। ওনার তখন ইচ্ছা হল, নিজে গিয়ে শামীকে ডেকে আনার। সমজিদটা একটু দূরে। তাই ইচ্ছা হলেও গেলেন না। এই কদিন ছেলে খাইনি বলে, তিনিও একরকম না খেয়ে আছেন। আজ সকালে নাস্তা খেয়েছে বলে নিজেও খেয়েছেন। এখন আবার ছেলে খেল না বলে তিনিও খেতে পারলেন না। একগ্লাস পানি খেয়ে এক খিলি পান সেজে মুখে দিয়ে স্বামীর কাছে চিঠি লিখতে বসলেন।
আব্দুস সাত্তার স্ত্রীর চিঠি পেয়ে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এলেন। চিঠি পড়ে তিনি ছেলের উপর খুব রেগে গিয়েছিলেন। তখন ভেবেছিলেন, বাড়িতে গিয়ে ছেলেকে ভীষণ রাগারাগি করবেন। কিন্তু আসার পর তার অবস্থা দেখে কিছুই বলতে পারলেন না। বরং খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
শামী সব সময় শুয়ে থাকে। মসজিদে নামায পড়তেও সব ওয়াক্তে যায় না। ঘরেই পড়ে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। জোর করে কিছু খাওয়ালে বমি হয়ে যায়।
আব্দুস সাত্তার মুন্সীগঞ্জ থেকে একজন বড় ডাক্তার নিয়ে এলেন।
ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, না খেয়ে খেয়ে স্টোমাক খুব গরম হয়ে গেছে। তাই কিছু খেলে বমি হয়ে যাচ্ছে। বমি বন্ধের ও অন্যান্য ওষুধের প্রেসক্রিপশান করে বললেন, এগুলো এনে খাওয়ান। আর সেই সঙ্গে সব কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করুন। বাই দা বাই, রুগীর দুর্বলতা ছাড়া অন্য কোনো অসুখ নেই। মনে হচ্ছে, খুব বড় মানষিক আঘাত পেয়েছে। আপনারা সেই আঘাতের কারণ খোঁজ করে তার প্রতিকার করুন। নচেৎ রুগীকে যতই ওষুধ খাওয়ান না কেন কোনো কাজ হবে না। এভাবে বেশি দিন চললে রুগীকে বাঁচান মুশকিল হবে। তারপর তিনি চলে গেলেন।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর মাসুমা বিবি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বামীকে বললেন, যা হোক কিছু কর। শামীর কিছু হলে আমি বাঁচন না।
আব্দুস সাত্তার চিন্তিত মুখে বললেন, সবর কর শামীর মা, সবর কর। সবকিছু আল্লাহপাকের ইচ্ছা। তিনি বিপদে সবর করতে বলেছেন।
মাসুমা বিবি বললেন, তা আমিও জানি। কিন্তু মন যে বোধ মানছে না। আমার অমন তরতাজা ছেলে এই কদিনে কি অবস্থা হয়েছে দেখতে পাচ্ছ না? বিছানার সাথে লেগে গেছে। তুমি যা হোক কিছু ব্যবস্থা কর।
আব্দুস সাত্তার বললেন, আমাকে কি তুমি আবসার উদ্দিনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলছ?
মাসুমা বিবি বললেন, হ্যাঁ, তাই বলছি। এছাড়া শামীকে বাঁচাবার আর কোনো উপায় নেই। ডাক্তারও তো সেই রকম ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। তারা যা কাবিন করতে বলবে, রাজি হয়ে যেও। তাতে যদি আমাদের সব জমি জায়গা চলে যায়, তবু অরাজি হয়ো না।
আব্দুস সাত্তার বললেন, কিন্তু তুমি তো বললে, ওনার মেয়ের বিয়ে ওনার শালীর ছেলের সঙ্গে ঠিক হয়ে গেছে। তারা খুব বড় লোক। ছেলে আমেরিকায় চাকরি করে। তারা যদি আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়? না না, আমি তাদের কাছে যেতে পারব না। তাতে আমাদের তকদীরে যা আছে হবে।
মাসুমা বিবি বললেন, তবু তুমি যাও। যেখানে ছেলের জীবন মরণ নিয়ে সমস্যা সেখানে মান সম্মানের কথা ভাবলে চলবে না। মান সম্মান কি আমাদের ছেলের জান বাঁচাবে? আল্লাহ না করুন শামীর কিছু হলে তুমি নিজের বিবেকের কাছে কি জবাব দেবে? আর তুমি সহ্য করবেই বা কি করে? তাই বলছি তুমি গিয়ে প্রস্তাব দাও। তারপর যা হবার হবে। তবু তো আমরা নিজেদেরকে বোধ দিতে পারব। এই সব বলার সময় মাসুমা বিবির চোখ থেকে পানি পড়ছিল।
আব্দুস সাত্তার স্ত্রীর করুন অবস্থা দেখে এবং তার কাতরোক্তি শুনে বললেন, চিন্তা ভাবনা করে দেখি।
স্বামীর কথা শুনে মাসুমা বিবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি একবার রায়হান এর কাছে যাও। তাকে ডেকে নিয়ে এসে শামীকে বুঝাতে বল, তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দেব।
আব্দুস সাত্তার রায়হানকে গ্রামের ছেলে হিসেবে এবং ছেলের বন্ধু হিসেবে ভালভাবে চেনেন। বললেন, তাই যাই তাকে ডেকে নিয়ে আসি।