শামী কাতর স্বরে বলল, ফাহমিদা অন্যকে বিয়ে করে সুখী হোক তাই আমি চাই। সে দুঃখ পেলে আমি আরো বেশি দুঃখ পাব। তুই ঐসব কথা আর বলবি না।
রায়হান বুঝতে পারল শামীর প্রেম পবিত্র। তাই ফাহমিদা বেঈমানী করলেও তাকে সুখী দেখতে চায়। বলল, তাই যদি হয়, তা হলে তুই এরকম করছিস কেন?
শামী বলল, ওকে গভীরভাবে ভালবাসতাম। তাই আঘাতটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। সেই ক্ষতের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।
রায়হান বলল, তুইও তো হাদিস কালাম জানিস। আল্লাহ যাকে ভালবাসেন তাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে পরীক্ষা করেন। যদি বান্দা সেই পরীক্ষায় ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে পাশ করতে পারে, তা হলে তাকে প্রিয় বান্দাদের মধ্যে সামিল করে নেন। তুই আল্লাহর কাছে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা চা। চল, ঘরে চল। গোসল করে খাওয়া দাওয়া করবি। চাচি আম্মা বললেন, তুই নাকি এই কদিন খাওয়া দাওয়া না করে শুধু শুয়ে শুয়ে কেঁদেছিস?
শামী বলল, বললাম না আঘাতে খুব কাহিল হয়ে পড়েছি? তাই সামলাতে পারছি না। একটু আগে নাস্তা খেয়েছি। পরে গোসল করে ভাত খাব। তুই এখন যা। পরে আবার আসিস।
রায়হান আর কিছু বলল না। ফিরে এসে শামীর মাকে বলল, চাচি আম্মা, আমি শামীকে অনেক বুঝিয়েছি। মনে হয় এবার ঠিক হয়ে যাবে। এখন আসি, পরে আবার আসব।
মাসুমা বিবি বললেন, তুমি একটু বস। তোমার জন্য চা করে রেখেছি, নিয়ে আসি। তারপর চা নিয়ে এসে রায়হানকে খেতে দিয়ে বললেন, ওর কি হয়েছে তোমাকে বলেছে?
রায়হান চিন্তা করল, ব্যাপারটা ওনাদের জানান উচিত। জানার পর চিন্তা ভাবনা করে কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন। কিভাবে কথাটা বলবে চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মাসুমা বিবি বললেন, যদি বলে থাকে, তা হলে নিশ্চিন্তে বলতে পার। আমাকে তো কিছুই বলছে না।
রায়হান বলল, শামী প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকে একটা মেয়েকে ভালবাসত। মেয়েটিও ওকে ভালবাসত। সেই মেয়েটি এখন তার খালাত ভাইকে ভালবাসে এবং তাদের বিয়ের কথাবার্তাও পাকা হয়ে গেছে। তিন চারদিন আগে মেয়েটি সেকথা শামীকে জানিয়েছে। তাই শামী মনে ভীষণ আঘাত পেয়ে এরকম করছে।
মাসুমা বিবি খুব অবাক হয়ে বললেন, কই, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারিনি? তুমি কি মেয়েটিকে চেনো?
রায়হান বলল, জি চিনি। দক্ষিণ পাড়ার আবসার উদ্দিনের মেয়ে। নাম ফাহমিদা। দুবছর আগে আই.এ. পাস করে আর পড়ে নি।
মাসুমা বিবি বললেন, আবসার উদ্দিন খুব ধনী তোক। তার মেয়ের সঙ্গে জেনেশুনে শামী ভালবাসা করতে গেল কেন? তা ছাড়া ওদের ফ্যামিলির কেউ নামায রোযা করে না। তারা অন্য সমাজের মানুষ। শামীর মতো ছেলে এত বড় ভুল করতে পারল? ওদের কাছে প্রেম ভালবাসার কোনো মূল্য নেই। ওরা শুধু বুঝে টাকা। টাকাকেই মনুষত্বের মাপকাঠি মনে করে। ওর আব্বা কিছুতেই ও বাড়ির মেয়েকে বৌ করতে রাজি হতেন না। আল্লাহ যা করেন ভালই করেন। তুমি শামীকে বলল, আমরা ভালো মেয়ে দেখে তার বিয়ে দেব। সে যেন ঐ মেয়েকে ভুলে যায়। ঐ মেয়ের জন্য আবার এত কান্নাকাটি? আমি আজই তোমার চাচাকে চিঠি লিখে বাড়ি আসতে বলব। যতশিঘী পারি ওর বিয়ে দেব।
রায়হান বলল, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। এখন আমি আসি, কামলা নিয়ে বাগানে কাজ করছিলাম। যাই, দেখি কি করছে। কাল পরশু আবার আসব।
মাসুমা বিবি বললেন, হ্যাঁ বাবা তাই এস। এসে শামীকে বিয়ে করার জন্য বুঝিয়ে বলে।
রায়হান বলল, আজও বুঝিয়েছি। আবার এসে বোঝাব। তারপর সালাম দিয়ে চলে গেল।
শামী নাস্তা খেয়ে সেই যে আমবাগানে গিয়ে বসেছিল, একেবারে জোহরের আযানের সময় বাড়িতে এল। তারপর গোসল করে মসজিদে নামায পড়তে গেল। নামাযের পর কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করল, হে রহমানুর রহিম, তোমার দয়া ব্যতীত কোনো মানুষ একটা নিঃশ্বাসও নিতে পারে না। তুমি যেমন দয়ার সাগর তেমনি প্রেমের সাগর। দুনিয়ার সাগরের কিনারা আছে। কিন্তু তোমার প্রেমের সাগরের কোনো কিনারা নেই। তুমি মানুষের মধ্যেও সেই প্রেমের কিঞ্চিতের বঞ্চিত দান করেছ। তাই মা-বাপ তার সন্তানকে ভালবাসে, সন্তানও তার মা বাপকে ভালবাসে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই বোনের মধ্যে, বন্ধু-বান্ধবীর মধ্যে, এমনিক সমস্ত মানব-মানবীর মধ্যেও তুমি প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছ। যারা সেই প্রেমকে অস্বীকার করে অথবা অন্যায় পথে ব্যবহার করে, তারা মানুষ নামের অযোগ্য। তুমি সমস্ত জীবের মনের কথা জান। আমি ফাহমিদাকে ভালবেসেছিলাম। তাতে আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল কিনা, তাও তুমি জান। কারণ তুমি সর্বজ্ঞ। তবু আমাকে তুমি এতবড় শাস্তি দিলে কেন? আমার তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না; তবু কেন এরকম করলে? যদি ফাহমিদাকে আমার জোড়া করে পয়দা না করে থাক, তবে কেন তার প্রতি প্রেমের বীজ আমার মনে অংকুরিত করে দিলে? আর এটাই যদি আমার তকদিরের লিখন হয়, তা হলে সবকিছু সহ্য করার তওফিক আমাকে দাও। নচেৎ আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নাও। আমি নাদান, নালায়েক বান্দা, কিভাবে তোমাকে ডাকতে হয় জানি না। কিন্তু তোমার প্রেরিত শ্রেষ্ঠ রাসুল (সঃ)-এর উম্মত। সেই রাসুল (সঃ)-এর উপর শতকোটি দরূদ ও সালাম পেশ করে বলছি, তারই তোফায়েলে আমার জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দিয়ে আমার দোয়া কবুল কর। আমিন! সুম্মা আমিন।