মালেকের কথা শুনে ফাহমিদার শামীর কথা মনে পড়ল। সে একদিন তাদের তিনজনকে ধর্মকর্ম সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিল। বলল, আমি আপনার কথা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। একজনের কাছে ধর্ম সম্বন্ধে কিছু কথা শুনেছিলাম। সে বলেছিল, যা সত্য ও ন্যায় সেটাই ধর্ম। ধর্মের মধ্যে কোনো মিথ্যা বা অন্যায়ের প্রশ্রয় নেই। ধর্মের জ্ঞান না থাকলে যেমন ন্যায় অন্যায় বিচার করার ক্ষমতা কারো থাকে না, তেমনি অপরাধ বোধের জ্ঞানও জন্মায় না। আর ভোগের মধ্যে নাকি সুখ শান্তি নেই, ত্যাগের মধ্যে আছে। শুধু ভালোভাবে জীবন যাপন করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু ভোগ কর। বাকিটা অন্যকে ভোগ করার জন্য সুযোগ দাও। অতিরিক্ত ভোগ বিলাসে মানুষ নাকি অমানুষ হয়ে যায়। বিবেক-বুদ্ধি, দয়া-মায়া হারিয়ে ফেলে। ভোগ বিলাসের নেশা না কি এমন, যত পাবে তত পাওয়ার নেশা বেড়ে যাবে। আর বুড়ো বয়সে ধর্ম-কর্ম করার কথা যা বললেন, তাও ঠিক নয়। যুবক বয়সটাই সব কিছু করার সময়। সেই বয়সে অন্যায়ের পথে থেকে বুড়ো বয়সে সৎপথে থেকে লাভ কি? তখন তার কর্ম ক্ষমতাই বা কতটুকু থাকবে। তাই সবকিছুর সঙ্গে যুবক বয়সেই ধর্মকর্ম মেনে চলা উচিত।
মালেক বলল, তুমি যার কাছে এইসব কথা শুনেছ, সে নিশ্চয় ধার্মিক। আর ধার্মিকরা নিজেদের ভোগ-বিলাস ও ভালো-মন্দের চেয়ে অন্যের চিন্তা বেশি করে। এসব কথা এখন থাক। পরে এক সময় আলোচনা করা যাবে। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দেবে তো?
কেন দেব না? উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয় দেব।
আমাকে তোমার কেমন মনে হয়?
কেমন আবার? ভালো।
শুধু ভালো বললে হবে না। আমাকে তোমার পছন্দ কি না বলতে হবে।
যদি বলি অপছন্দ, তা হলে নিশ্চয় দুঃখ পাবেন তাই না? কথাটা ফাহমিদা এমনভাবে বলল, তাতে করে দুজনেই হেসে উঠল।
মালেক বলল, ইয়ার্কি রেখে আসল কথাটা বল।
ফাহমিদা বলল, আমি বুঝি আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি করার জন্য এসেছি?
মালেক বলল, তুমি তো আসনি, আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি। এবার না বললে মনে কষ্ট পাব।
ফাহমিদা কি বলবে ভাবতে লাগল; মালেককে তার খুব ভালো লাগলেও বারবার। শামীর কথা মনে পড়ছে। সেই সাথে এই কথাও মনে পড়ছে, শামীর সঙ্গে মা-বাবা কিছুতেই বিয়ে দেবে না। তা ছাড়া মালেকের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। এই কথা জানার পর শামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য তার অনুশোচনা হতে লাগল। তাকে ভালবাসলেও বিয়ে করা সম্ভব নয়। কবে সে মানুষের মতো মানুষ হবে, ততদিন মা বাবা কি তার বিয়ে না দিয়ে ছাড়বে?
ফাহমিদা কিছু বলছে না দেখে মালেক বলল, কি ভাবছ? আমাকে কি পছন্দ…
ফাহমিদা তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলল, আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। এ ব্যাপারে মা-বাবার মতামতই আমার মত।
তবু তোমার নিজস্ব মতটা বললে খুশী হতাম।
আমার কথাতেই আপনার বুঝে নেয়া উচিত ছিল। তুব বলছি, আপনার মতো ছেলেকে সব মেয়েরা পছন্দ করবে।
তুমি খুব বুদ্ধিমতী।
আপনি আরো বেশি।
তাই যদি হয়, বুদ্ধি খাটিয়ে তোমাকে বিয়ে করবই।
সেটা আপনার ইচ্ছা।
আর তোমার কি ইচ্ছা?
আমার ইচ্ছার কথা বলব না। কারণ আমাকে তো আর বুদ্ধি খরচ করে বিয়ে করতে হচ্ছে না।
মালেক হাসতে হাসতে বলল, না, সত্যি তুমি খুব বুদ্ধিমতী। ভাবছি, বুদ্ধিতে তোমার সাথে কোনো দিন পারব কিনা।
ফাহমিদা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। তখন তার মনে আবার শামীর কথা ভেসে উঠল। ভাবল, শামী যতই দুঃখ পাক তার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে নিতে হবে। কিভাবে করবে চিন্তা করতে লাগল।
মুন্সীগঞ্জ থেকে আলদিবাজার মাত্র তিন-চার মাইলের পথ। তারা ততক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেল।
শাকেরা খানম মালেকের মার্কেটিং দেখে খুশী হলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে বললেন, শুধু শুধু এতটাকা খরচ করতে গেলে কেন বাবা?
মালেক হাসিমুখে বলল, খালাআম্মা কি যে বলেন, আপনাদের ছেলে বিদেশ থেকে যদি নিয়ে আসত, তা হলে আপনারা কি খুশী হতেন না? মনে হচ্ছে, আমাকে ছেলের মতন মনে করেন না।
শাকেরা খানম তাড়াতাড়ি করে বললেন, না বাবা না, তা নয়। তুমি তো আমাদের নিজেদের ছেলেই। এমনি কথাটা বলছি। তুমি আবার মনে কিছু করো না।
মালেক বলল, মনে কিছু করব কেন? তাই জানি বলে তো এগুলো নিয়ে এলাম। দেখে বলুন, পছন্দ হয়েছে কিনা।
শাকেরা খানম সবকিছু দেখে বললেন, এত দামী জিনিস এনেছো পছন্দ তো হবেই। তা ছাড়া ছেলে দামীই দিক আর অদামীই দিক, মা বাবার কাছে সব কিছুই ভালো। দোয়া করি, আল্লাহ তোমার রুজী রোজগারে কত দিক। তোমার হায়াত দারাজ করুক।
আরো দু দিন থেকে মালেক বাড়ি ফিরে এল।
.
০৬.
এদিকে শামী ফাহমিদার সঙ্গে দেখা করার কোনো উপায় বের করতে না পেরে একদিন জোবেদাদের বাড়িতে এল। তাদের সদরের সামনে জোবেদার ছোট ভাই লিটন কয়েকটা ছেলের সঙ্গে খেলা করছিল। সে শামীকে চেনে। তাকে দেখে খেলা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে এল।
শামী তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
লিটন।
লিটন আবার একটা নাম হল নাকি? ভালো নাম বল।
মোসারফ হোসেন।
বাহ! এইতো বেশ সুন্দর নাম। তুমি জোবেদাকে চেন?
জি চিনি। সে আমার বড় আপা।
ও আচ্ছা, তুমি আমাকে কি চেন?
শামী যেদিন প্রথমবার তাদের বাড়িতে এসেছিল সেদিন চলে যাওয়ার পর লিটন জোবেদাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বড় আপা, উনি কে? জোবেদা বলেছিল, উনি শামী ভাই, উত্তর পাড়ায় বাড়ি। তারপর তাকে আরো দুতিনবার আসতে দেখেছে।