পরের দিন শামীকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সকালে তাকে দেখতে না পেয়ে মাসুমা বিবি ভাবলেন, রাগ করে হয়তো বন্ধুদের কাছে গেছে। দিনে না ফিরলেও রাতে ঠিক ফিরবে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে যেতেও যখন ফিরল না তখন বেশ চিন্তিত হলেন। তারপর দু-তিন দিন হয়ে যেতেও যখন শামী ঘরে ফিরল না তখন তিনি সবকিছু লিখে স্বামীকে চিঠি দিলেন।
একই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার রায়হান নামে একটা ছেলের সঙ্গে শামীর খুব বন্ধুত্ব। মাদ্রাসায় পাঞ্জাম পর্যন্ত একসাথে পড়েছে। তাদের বংশ খুব ভালো। ঐ বংশেও বেশ কয়েকজন আলেম ও হাফেজ আছে। রায়হানও ভালো ছাত্র। রেজাল্ট বেরোবার পর শামী যখন মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিল তখন একদিন রায়হান তার সঙ্গে দেখা করে বলল, কিরে, তুই আর মাদ্রাসায় যাসনি কেন?
শামী বলল, আমি আর পড়ব না।
রায়হান জানতে পেরেছিল, সে গ্রামের আজে বাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে। তাই বলল, তুই আমার চেয়ে ভালো ছাত্র। এসব বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে পড়াশোনা ছেড়ে দিলি, এটা কি ঠিক হল? তোর আব্বা-আম্মা কিছু বলেন না?
শামী বলল, তারা আবার কি বলবে, আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না।
কি করবি তা হলে?
তা এখনও ভাবিনি।
আমার কি মনে হয় জানিস, তুই ঐসব খারাপ ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে এরকম হয়ে গেছিস। আমি বলি কি ওদের সাথে আর মেলামেশা না করে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যা।
ঠিক আছে, এখন তুই যা। তোর কথা ভেবে দেখব।
সেদিন রায়হান আর কিছু না বলে ফিরে এলেও শামীর কথা ভুলতে পারল না। অনেক দিনের বন্ধুত্ব, সহজে কি ভুলা যায়? তাই মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করে গল্প গুজব করার সময় মাদ্রাসায় ভর্তি হবার তাগিদ দেয়। কয়েকদিন তাকে দেখতে না পেয়ে একদিন রায়হান শামীদের বাড়িতে এসে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, চাচি আম্মা, শামী কোথায়?
মাসুমা বিবি রায়হানকে চেনেন। অনেকবার শামীর সঙ্গে এসেছে। বললেন, সে তো কয়েকদিন থেকে বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে বলেও যায়নি।
রায়হান আবার জিজ্ঞেস করল, ও আর মাদ্রাসায় যায়নি কেন? জিজ্ঞেস করতে বলল, সে আর পড়বে না। আপনারা ওকে কিছু বলেন নি?
মাসুমা বিবি বললেন, আমি জিজ্ঞেস করতে আমাকেও তাই বলেছে। সেই জন্যে একদিন মেরেছিলাম। তারপরের দিন থেকে না বলে কোথায় চলে গেছে। তুমি একটু খোঁজ করে দেখোত বাবা। দেখা হলে তাকে পড়াশোনা করার জন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িতে আসতে বলল।
রায়হান বলল, আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি। ও বলে আমার পড়তে ভালো লাগে না। ঠিক আছে, খোঁজ করে দেখব। দেখা হলে আবার বোঝাব। তারপর সালাম জানিয়ে ফিরে এল।
স্ত্রীর চিঠি পেয়ে আব্দুস সাত্তার বাড়িতে এসে সবকিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, তুমি যখন মারতে সে বাড়ি ছাড়া তখন আমি মারলেও কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। আমি বাড়িতে এসেছি শুনলে ভয়ে আর এদিকে পা মাড়াবে না। আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখ, নিশ্চয় ফিরে আসবে। আমি কাল চলে যাব। যাওয়ার পর বড় ভাইয়ের ছেলে মান্নানকে একবার মোল্লাকান্দিতে ওর নানার বাড়িতে খোঁজ নিতে পাঠাবে। যদি সেখানে থাকে, তা হলে তাকে যেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসে। আমিও মান্নানকে বলে যাব। তাকে আর মারধর করো না। কয়েকদিন পরে আমি এসে যা করার করব। মাদ্রাসা কমিটির মিটিং চলছে। একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। কালকেই আমাকে যেতে হবে।
পরের দিন সকালে আব্দুস সাত্তার চলে যাওয়ার পর মাসুমা বিবি ভাসুরপো মান্নানকে বাবার বাড়িতে পাঠালেন।
মান্নান শামীর চেয়ে অনেক বড়। কলেজে পড়ে। মোল্লাকান্দি গিয়ে শামীকে নিয়ে এল।
মাসুমা বিবি ছেলেকে কিছু বললেন না। বরং আদর করে খেতে দিয়ে বললেন, আমি তোর আম্মা না? আম্মা মেরেছি বলে রাগ করে চলে গেলি। আমার চিন্তা হয়নি বুঝি? তোর আব্বা এসেছিল। তুই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিস শুনে খুব দুঃখ পেয়েছে। তোকে মাদ্রাসায় ভর্তি হতে বলেছে।
শামী কিছু না বলে চুপ করে খেতে লাগল।
মাসুমা বিবি তখন আর কিছু বললেন না।
দিন দশেক পর আব্দুস সাত্তার বাড়িতে এলেন। রাতে শামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই পড়াশোনা করতে চাচ্ছিস না কেন?
শামী ভয়ে কোনো কথা বলতে পারল না, চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আব্দুস সাত্তার হুংকার ছেড়ে বললেন, কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
শামী আরো বেশি ভয় পেয়ে কাঁপতে লাগল।
আব্দুস সাত্তার তার অবস্থা দেখে রাগ সংযত করে বললেন, কালকেই তোকে আমি ভর্তি করে দেব। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।
পরের দিন আব্দুস সাত্তার শামীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। তারপর চার-পাঁচ দিন বাড়িতে থেকে তিনি কর্মস্থলে ফিরে গেলেন।
যে কয়দিন আব্বা ছিল সেই কয়দিন শামী মাদ্রাসায় গেল এবং পড়াশোনাও করল। ওনি চলে যাওয়ার পর সবকিছু বন্ধ করে দিল।
মাসুমা বিবি ছেলেকে প্রথমে অনেক বোঝালেন। তাতে কাজ না হতে ভীষণ রাগারাগি করলেন। কিন্তু শামীর কোনো পরিবর্তন হল না। সে আগের মতো সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বেড়াতে লাগল। আব্বা বাড়িতে এলে শামী নানার বাড়ি, খালার বাড়ি নয়তো ফুফুর বাড়ি চলে যায়। ওনি চলে যাওয়ার পর আবার বাড়িতে আসে। এভাবে প্রায় দুবছর পার হতে চলল।