ফাহমিদা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তুমি?
শামী বলল, শারীরিক ভাল থাকলেও মানষিক যন্ত্রণায় ভুগছি। এতদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় বিরহ জ্বালায় জ্বলছি। তুমি পড়াশোনা ছেড়ে দিলে কেন?
আমি তো পড়তে চাই। কিন্তু আব্বা পড়াতে রাজি নয়। আমরা যে আবার মেলামেশা করেছি, সে কথা আব্বা বোধ হয় সন্দেহ করেছে। তাই পড়াতে রাজি হয় নি।
আচ্ছা সপ্তাহে না হলেও মাসে অন্ততঃ একদিন এখানে অথবা জোবেদাদের বাড়িতে বেড়াবার নাম করে আসতে পার না? ঐদিন আমিও আসব।
তা হয়তো দুএকবার পারব; কিন্তু প্রতি মাসে এলে ধরা পড়ে যাব।
তা অবশ্য ঠিক কথা বলেছ। আমার কি মনে হচ্ছে জান?
কি?
আজকেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলি।
করছ না কেন?
উপযুক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে তোমাকে ঘরে তুলতে চাই। তা ছাড়া তোমাদের বংশের সম্মানের কথা ভেবে তা পারছি না। তোমার উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না?
আমিও তাই চাই। কিন্তু একটা গ্রাম্য বালিকার কতটুকু ক্ষমতা তা তো তুমি জান। অন্ততঃ বি. এ. পর্যন্ত পড়তে চাইলাম। তাও যখন পড়তে দিল না তখন তোমার জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে পারব তা এখন বলব কি করে?
আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
বল, পারলে নিশ্চয় রাখব।
তোমার যখন অন্য কোথাও বিয়ের কথা হবে তখন আমাকে জানাবে।
জানালে কি করবে?
আব্বাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাব।
আমার আব্বা রাজি হবে না।
তখন তুমি তোমার আব্বাকে নিজে না পারলেও অন্য কাউকে দিয়ে নিজের মতামত জানাবে।
ফাহমিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তার ফলাফল আরো ভয়াবহ হবে। সবাই মনে করবে, তোমার সাথে এখনও যোগাযোগ রেখেছি। তবু আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করব।
শামী বলল, আমিও আব্বাকে দিয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করাব। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা। এখন যা বলছি শোন, জোবেদাদের বাড়ি থেকে তোমাদের বাড়ি এখানকার চেয়ে কাছে। পারলে দু-এক মাস অন্তর সেখানে এসে জোবেদাকে বলল, সে যেন আমাকে খবর পাঠায়। আর আমিও মাঝে মাঝে জোবেদার হাতে চিঠি দিয়ে বলব, সে যেন তোমাকে দেয়। সেই সময় তুমিও তার হাতে উত্তর দিও।
ফাহমিদা বলল, বেশ তাই হবে।
এমন সময় রাহেলা দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে এসে বলল, শামী ভাই, আপনারা তো অনেকক্ষণ গল্প করলেন, নিশ্চয় গলা শুকিয়ে গেছে। চা পান করে গলা ভিজিয়ে নেন।
চা খেয়ে শামী তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
উক্ত ঘটনার দিন পনের পর জোবেদা তার চাচাতো বোনের বিয়ের উৎসবে শামী ও ফাহমিদাকে দাওয়াত দিল। রাতে উৎসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শামী সন্ধ্যের আগে এসেছে। ফাহমিদা আসছে না দেখে জোবেদা তাদের বাড়িতে গেল।
ফাহমিদার মা শাকেরা খানম জোবেদাকে বললেন, তোমার চাচা বাড়িতে নেই। তার অনুমতি ছাড়া আমি পাঠাতে পারব না।
জোবেদা অনেক করে বলে উনাকে রাজি করাল। তবু আসবার সময় শাকেরা খানম বললেন, খাওয়া-দাওয়ার পর ওকে তুমি দিয়ে যেও।
জোবেদা বলল, চাচি আম্মা কি যে বলেন, ফাহমিদা আজ আমার কাছে থাকবে। কাল সকালে আসবে। বিয়ের রাতে আসা যায় নাকি?
শাকেরা খানম আর কিছু বললেন না।
বিয়ের কাজ মিটে যাওয়ার পর এক সময় খাওয়া-দাওয়ার কাজও শেষ হল।
এখানে আসার পর থেকে শামীর মন ফাহমিদার সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছে। একসময় জোবেদা তাকে বলে গেছে, আজ আপনি বাড়ি যাবেন না। এখন কাজের খুব চাপ। রাতে ফাহমিদার সাথে আলাপ করবেন।
এখন রাত একটা। শামী একটা চেয়ারে বসে বসে ভাবছে, জোবেদা না হয় কাজে ব্যস্ত, ফাহমিদা তো তার সাথে দেখা করতে পারত। শেষে শামী আর ধৈর্য ধরতে না পেরে জোবেদাদের বাড়ির ভিতরে গিয়ে সব ঘরে ঘুরে ঘুরে তাদেরকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কাউকেই পেল না। ভাবল, কোথাও একটু জায়গা পেলে ঘুমানো যেত। কোনো ঘরেই একটু ফাঁকা নেই। সব ঘরেই মেহমান ঠাশা। শুধু একটা রুমে তালা দেয়া দেখল। কোনো আশাই যখন পূরণ হল না তখন আগের জায়গায় এসে ঝিমোতে লাগল।
শামী যখন জোবেদা ও ফাহমিদাকে খুঁজছিল তখন তারা-প্রকৃতির ডাকে খিড়কী পুকুরের দিকে গিয়েছিল। ফিরে এসে জোবেদা তালা দেয়া ঘর খুলে ফাহমিদাকে বসতে বলে বলল, একটু অপেক্ষা কর, আমি শামী ভাইকে ডেকে নিয়ে আসি। বেচারা হয়তো বাইরে চেয়ারে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। তারপর বাইরে এসে সত্যিই তাই দেখল। জোবেদা তার একটা হাত ধরে বলল, শামী ভাই, আসুন আমার সঙ্গে।
শামী বিরক্তিপূর্ণ চোখে জোবেদার দিকে তাকিয়ে বলল, মেহমানদের পিছনে অনেক খেটেছি। এখন আর কোন ফরমাইশ শুনতে পারব না।
জোবেদা বুঝতে পারল, বেচারা ঘুমে কাতর হয়ে পড়েছে। তার উপর ফাহমিদার সঙ্গেও দেখা হয়নি। মুচকি হেসে বলল, আর ফরমাইশ করব না, আসুন তো আমার সঙ্গে।
অগত্যা শামী একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে বলল, চল তা হলে।
জোবেদা তাকে ফাহমিদার কাছে নিয়ে এল। তারপর বেরিয়ে এসে দরজা লক করার সময় বলল, আমি কিছুক্ষণ পরে আসব। আপনারা ততক্ষণ কথা বলুন।
শামী ফাহমিদাকে খাটে বসে থাকতে দেখে আনন্দে কোনো কথা বলতে পারল না। একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফাহমিদারও একই অবস্থা। এদিকে সময় যে চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের খেয়াল নেই।
প্রায় দশ পনের মিনিট পর জোবেদা চা নাস্তা নিয়ে এসে তাদের দুজনকে একে অপরের দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, শামী ভাই, আপনি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন? তারপর ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে, তুই শামী ভাইকে বসতে বলিসনি?