শামী দূর থেকেই ফাহমিদার পরিবর্তন লক্ষ্য করল। নিজেই দ্রুত এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে একদৃষ্টে তারদিকে তাকিয়ে রইল।
প্রায় দেড়বছর পর তাদের দেখা। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। দুজনে দুজনের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন তারা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কতক্ষণ তারা এভাবে ছিল তা বুঝতে পারল না। এক সময় দুজনের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তাই দেখে ফাহমিদা মাথা নিচু করে চোখ মুছতে লাগল।
শামীও চোখ মুছে বলল, সালামের উত্তর দিলে না যে?
ফাহমিদা মাথা নিচু করেই সালামের উত্তর দিয়ে চুপ করে রইল।
শামী বলল, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না। লোকজন তাকিয়ে দেখছে। তারপর রাস্তার পাশে মোড়লদের বাগানবাড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, চল, ওখানে গিয়ে একটা নিরীবিলি জায়গায় বসি।
ফাহমিদা মাথা তুলে বলল, তাই চল।
মোড়লদের বাগানবাড়িতে বিরাট একটা পুকুর আছে। পুকুরের একদিকে সান বাঁধান ঘাট। চারপাশের পাড়ে নানারকম ফলের গাছ। সেগুলোর ছায়া ঘাটের উপর পড়েছে। তারা এসে ঘাটের পাকা রকের উপর ছায়াতে বসল। বসার পরও বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।
ফাহমিদা মাথা নিচু করে ভাবছে, শামী কিছু জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেবে।
আর শামী একবার ফাহমিদার মুখের দিকে আর একবার পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছে, ফাহমিদাই আগে কিছু বলুক, তারপর যা বলার বলবে।
অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন ফাহমিদা কিছু বলল না তখন শামী ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। বলল, ফাহমিদা, তুমি কি বোবা হয়ে গেছ? সালামের উত্তর ছাড়া এতক্ষণ তোমার গলার স্বর শুনতে পেলাম না। প্লিজ কিছু বল।
কি বলব?
তোমার কি কিছুই বলার নেই?
আছে। তবে সে সব বলা সম্ভব নয়।
তা হলে সত্যি কি তুমি আমাকে ভুলে গেছ?
ভুলতে পারলে তো বেঁচে যেতাম।
শামী একটা দীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলে বলল, আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া জানাই, আমার কথা মনে রেখেছ। এবার বল, এতদিন যোগাযোগ না করে আমাকে কষ্ট দিলে কেন?
তা বলাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জেনে রেখ, আমিও কষ্ট কম পাইনি।
তাই যদি হয়, তা হলে কেন সব কিছু বলতে পারছ না?
ফাহমিদা একটা বইয়ের ভিতর থেকে এক টুকরো ভাজ করা কাগজ বের করে শামীর হাতে দিয়ে বলল, যা কিছু বলার এতে লিখে রেখেছি। কয়েকদিন আগে হঠাৎ আমার মনে হল, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাই সেদিন এটা লিখে সঙ্গে করে রেখেছি। আল্লাহর কি মহিমা, সত্যি সত্যি দেখা হয়ে গেল।
শামীও পকেট থেকে চিঠিটা বের করে ফাহমিদার হাতে দিয়ে বলল, তোমার দীর্ঘদিন নীরবতার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে গত পরশু এটা লিখেছি। তুমি আমারটা পড়, আমি তোমারটা পড়ছি।
ফাহমিদা চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।
তাই দেখে শামী কাগজের টুকরোটা চোখের সামনে মেলে ধরল। দেখল, শুধু কয়েক লাইনের একটা কবিতা। পড়তে শুরু করল।
অনেক না বলা কথার বেদনা
জমা হয়ে আছে এই ভগ্ন হৃদয়ে,
কেমনে শোনাব তাহা আমার প্রিয়জনে?
সেই সব বেদনা, হৃদয়ের মাঝে
ফল্গুধারার মতো কান্না হয়ে অবিরত বইছে।
না বলা কথাগুলো, বলার জন্য
পথ কি কোনো দিন খুঁজে পাবো?
জানি না ভাগ্য আমাকে কোন পথে নিয়ে যাবে।
ইতি ফাহমিদা।
শামী কবিতাটা পড়ে চুপ করে ফাহমিদার চিঠি পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল।
ফাহমিদা চিঠি পড়ে তার প্রতি শামীর গভীর ভালবাসার পরিচয় পেল। তখন সে সবকিছু ভুলে গিয়ে শামীর দুটো হাত ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, সত্যি আমি খুব অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।
শামী তার ধরা হাতে চুমো খেয়ে বলল, তোমার কবিতা পড়ে আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন কথা দাও, এবার থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে?
ফাহমিদা বলল, রাখব। তবে দুজনকেই খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমাকে বাড়ি থেকে কোথাও যেতে দেয়া হয় না। কলেজে আসি তাও একজন কাজের মেয়ে থাকে। তার অসুখ হয়েছে। তাই আজ একা এসেছি। আব্বা বাড়িতে নেই। থাকলে একা আসতে দিত না। এখন তুমিই বল, কি করে আমাদের যোগাযোগ হবে?
শামী একটু চিন্তা করে বলল, আমি প্রতি বৃহস্পতিবার তোমার সঙ্গে কলেজে দেখা করব।
ফাহমিদা বলল, প্রত্যেক বৃহস্পতিবার ক্লাস কামাই করবে?
শামী বলল, ঐ দিন মাত্র দুটো ক্লাস। বাড়িতে পড়ে মেকাপ দিয়ে নেবে। ও নিয়ে তুমি কিছু ভেব না।
ফাহমিদা বলল, বেশ তাই করো। এখন চল ওঠা যাক।
শামী বলল, হ্যাঁ তাই চল। নচেৎ তোমার আরো একটা ক্লাস নষ্ট হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সেদিন শামী ফাহমিদাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরল।
শামী যেন আজ নবজন্ম লাভ করল। ফেরার পথে রায়হানের সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলল। তারপর কবিতাটা পড়তে দিল।
কবিতাটা পড়ার পর রায়হানের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। বুঝতে পারল, ফাহমিদাও শামীকে ভালবাসে। কিন্তু তার মা-বাবা তো কিছুতেই শামীকে জামাই করবে না। সে জন্যে তারা মালেকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শামী বলল, মনে হচ্ছে কিছু যেন ভাবছিস?
রায়হান বলল, না, মানে ভাবছি, ফাহমিদা তোকে ভালবাসে ঠিক; কিন্তু তার মা বাবা তোর সঙ্গে কি বিয়ে দেবে? তোদের কি আছে? কি দেখে দেবে? ওরা বড়লোক। এক মেয়েকে কি তারা তোর মতো ছেলের হাতে তুলে দিতে রাজি হবে? আমার মনে হয় তুই ভুল পথে চলছিস। এখনও ফিরে আসার সময় আছে। তুই আমার বাল্যবন্ধু। তোর ভালো-মন্দ কিছু হলে, আমিও কম দুঃখ পাব না। আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস।