সে আমাকে বিদায় দিলেও আমি তাকে কখনো বিদায় দিতে পারব না। সে আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে।
তবু ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
এ ব্যাপারে আমি তাকে কিছু বলতে পারব না। সে যদি নিজের থেকে কথা তুলে, তা হলে আলাদা কথা।
ঠিক আছে, তা না হয় হল। এখন আমার কথা শোন, তুই একটা চিঠি লিখে তাকে তোর মনের কামনা-বাসনা জানা। তারপর সে কি উত্তর দেয় দেখ। আর চিঠিটা লেখার পর আমাকে পড়তে দিস।
বেশ তাই হবে।
রায়হান আর কিছু না বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
রায়হান চলে যাওয়ার পর শামী ফাহমিদাকে চিঠি লিখল
প্রিয়তমা,
পত্রের প্রারম্ভে জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অফুরন্ত পবিত্র ভালবাসা। জানি না, এই হতভাগার সম্বোধন ও ভালবাসা তুমি গ্রহণ করবে কি না। হয়তো ছোটমুখে বড় কথা বলে অন্যায় করে ফেললাম। যদি তাই হয়, তা হলে নিজগুণে ক্ষমা করে দিও। আশা করি, আল্লাহর রহমতে তুমি ভালো আছ। আর এটাই আমার কামনাও। দোয়া করি, পরম করুণাময় আল্লাহ যেন তোমাকে দীর্ঘায়ু করেন। সুখ শান্তি দিয়ে তোমার জীবন ভরপুর করে দেন। এদিকে আমি এক হতভাগা লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অভিশপ্ত জীবন নিয়ে কোনো রকমে দিন যাপন করছি। কি আর করব, সবই আমার তকৃদির। তা না হলে এত অল্প বয়সে মহাঘূর্ণিঝড়ে পড়ে বিধস্থ জীবন নিয়ে চলা ফেরা করছি কেন? আল্লাহকে মালুম, আরো কতদিন এই অভিশপ্ত জীবন আমাকে বহন করতে হবে। যদি বেশি দিন করতে হয়, তা হলে আমার অগ্নিদগ্ধ হৃদয় ভষ্মে পরিণত হয়ে যাবে। সেদিন আর তোমার যাত্রা পথে কোনো বাধা থাকবে না। ভালবাসার অধিকার নিয়ে তোমর হৃদয়ের বন্ধ দুয়ারে হাত পাতব না। তখন তুমি হয়তো আনন্দে নাচতে থাকবে। পাবে চিরজীবনের জন্য মুক্তি। যাই হোক, আজকে আমার এই তুচ্ছ লিপির উদ্দেশ্য হল, তোমার কাছে দুটো প্রশ্ন করার। তার আগে পূর্বের কিছু ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। কারণ আজকের এই পত্র হয়তো তোমার আমার জীবনের শেষ পত্র।
প্রায় চার বছর পূর্বে তুমি আমার হৃদয় আকাশে চৌদ্দ দিনের চাঁদের মত উদিত হয়েছিলে। তখন শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা তোমার কাছে প্রকাশ করি নি। একদিন তুমিই প্রথম স্বেচ্ছায় আমার কাছে প্রেম নিবেদন করলে। সেদিন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে সমস্ত মন প্রাণ উজাড় করে তোমার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিই। তারপর থেকে আমাদের সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ় হতে থাকে। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ এক তুফান এসে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। যদিও এতদিন বিচ্ছিন্নতার মধ্যে রয়েছি তবুও তোমার প্রতি মানষিক আকর্ষণ বেড়েছে বই কমে নি। যার ফলে বন্ধু মহলে সবাই আমাকে ঘৃণা করে। নানারকম বিদ্রূপ করে। কিন্তু তারা জানে না, তুমি আমার কাছে কতখানি ভালবাসার পাত্রী। জানেন শুধু তিনিই, যিনি কুল মাখলুকাতের সৃষ্টিকর্তা। ওগো আমার হৃদয়ের রাণী, এখন আমার সময় কি পরিস্থিতির মধ্যে কাটছে, তা যদি তুমি জানতে, তা হলে এত দীর্ঘ সময় যোগাযোগ না করে থাকতে পারতে না। তোমার হৃদয়ে কি এতটুকু দয়া মায়া নেই? শুষ্ক মরুর বুকে মাঝে মধ্যে বৃষ্টিপাত হয়, কঠিন পাথরের বুক ফেটে ঝরনার ধারা নির্গত হয়। কিন্তু তোমার হৃদয় কি কঠিন পাথরের থেকে শক্ত? তা না হলে এত দীর্ঘ বিরহ জ্বালা সহ্য করছ কি করে? দুদুটো বসন্ত পার হতে চলল। বসন্তের সমীরণে তোমার হৃদয় কি দুলে উঠে না? এতে করে কি আমার ভাবা অন্যায় হবে, তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পার নি? তাই তুচ্ছ ভেবে ভুলে গেছ? বিশ্বাস কর ফাহমিদা, আজ আমি নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থায় তোমার প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। চারদিকে শুধু অথৈ পানি। যার কোনো কূল কিনারা নেই। তুমি যদি আমাকে সাহায্যার্থে হাত না বাড়াও, তা হলে সেই সাগরের অথৈ পানিতে আমার সলিল সমাধি হবে। পৃথিবীটাকে আমার বড় নিমর্ম মনে হচ্ছে।
এবার আসল কথায় ফিরে আসি। প্রেম ভালবাসা কাকে বলে, সেটা অনুভব করার বয়স থেকে তোমাকে ভালবেসে আসছি। যার কারণে তোমাকে একদণ্ডও ভুলে থাকতে পারি নি। তুমি আমাকে কতটা ভালবাস জানি না। চন্দ্র সূর্য যেমন সত্য, আমার ভালবাসাও তেমনি সত্য। চন্দ্র সূর্য না থাকলে পৃথিবী যেমন অচল তেমনি তোমাকে ছাড়া আমার জীবনও অচল। আমার ভালবাসা পবিত্র। আমি সেই পবিত্র ভালবাসার ও আল্লাহপাকের কসম খেয়ে বলছি, তোমাকে এমনভাবে পেতে চাই, যা সমাজের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য। তোমাদের বংশ মর্যাদা যাতে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখব। তোমার কাছে শুধু একটা মিনতি, তুমি আমাকে অবহেলা করে বিরহের আগুনে জ্বালিও না। দোহাই তোমার, আমাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিও না। জানি ভালবাসলে অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়। আর এটাও জানি, ভালবাসার পাত্রীকে একান্ত করে পাওয়ার পর সেই আঘাতগুলো তখন মধুময় হয়ে উঠে। সেই মধু আহরণ করার অধিকার আর কেন বা থাকবে না? তুমিই তো একদিন স্বেচ্ছায় সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পথ দেখিয়েছ। তুমি টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টের দিন বলেছিলে, আপাততঃ কিছুদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখতে। আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কিন্তু প্রায় দেড় বছর হতে চলল, সেই কিছুদিন কি এখনও শেষ হয়নি? মনে হয়, আমার কথা ভুলে গেছ। তা না হলে এতদিনে দুএকটা চিঠি দিয়ে আমার খোঁজ খবর রাখতে। তুমি হয়তো ভেবেছ, তোমার চিঠির কথা সবাইকে জানিয়ে সমাজে তোমাকে অপমানিত করব, তোমার দুর্নাম রটাব? এরকম ভাবলে তোমার অন্যায় হবে। কারণ আমাদের দুজনের বাড়ি যখন একই গ্রামে তখন নিশ্চয় আমরা দুজন দুজনার বংশ পরিচয় জানি। আমি যে এ রকম করব, তা কি আমার চিঠি পড়ে তোমার মনে হয়েছে? আমার সঙ্গে কথা বলে বা আমার ব্যবহারে আমাকে কি তুমি কোনো খারাপ ছেলে ভেবেছ? তা নিশ্চয় ভাবনি। আর যদি সত্যি আমাকে ঐ রকম ভেবে থাক, তা হলে জেনে রেখ, যা কিছু হয়েছি, তোমাকে ভালবেসেই হয়েছি। আরো জেনে রেখ, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা, এটা যেমন ধ্রুব সত্য তেমনি তুমি আমার রক্তকণিকায় মিশে গিয়ে সমস্ত শরীরে প্রবাহিত হচ্ছ, সেটাও ধ্রুব সত্য। তোমাকে ভুলতে হলে শরীরের সমস্ত রক্ত বর্জন করতে হবে। তুমিই বল, রক্ত ছাড়া কি মানুষ বাঁচে?