এখন শামীর কথা শুনে রায়হানের ফাহমিদার বিয়ের কথা মনে পড়ল। বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু তোর মন এত খারাপ কেন?
ফাহমিদাকে আবার কবে দেখতে পাব ভেবে মন খারাপ হয়ে আছে।
দেখিস, শেষকালে তোকে ফাঁকি দিয়ে অন্যের গলায় ঝুলে না পড়ে।
তা কখনই সম্ভব নয়। আমাদের ভালবাসা যদি খাঁটি হয়, তা হলে ফাহমিদা এটা জান গেলেও করতে পারবে না।
তোর ভালবাসা না হয় খাঁটি; কিন্তু ফাহমিদার যদি খাঁটি না হয়?
আমার যতদূর মনে হয়, তার ভালবাসাও খাঁটি। আর যদি তার ভালবাসায় খাদ থাকে, তবে আমার ভালবাসার আগুনে সেই খাদ পুড়িয়ে খাঁটি করে নেব।
রায়হান মনে মনে ভাবল, শামী ফাহমিদার বিয়ের কথা শুনলে কি করবে কি জানি। বলল, দোয়া করি, আল্লাহ তোর মনের আশা পূরণ করুক। মন খারাপ করে আর কি করবি? ওয়াদা যখন করেছিস তখন তো তোকে তা রক্ষা করতেই হবে। ফাইন্যাল পরীক্ষার পর কি করে দেখ।
শামী বলল, তা তো নিশ্চয়। তারপর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
এরপর শামী মন দিয়ে পড়াশোনা করে ভালভাবে ফাইন্যাল পরীক্ষা দিল। পরীক্ষার পর যত দিন যেতে লাগল, ফাহমিদার সঙ্গে দেখা করার জন্য তার মন তত ছটফট করতে লাগল। তবু ওয়াদা ভঙ্গের ভয়ে যোগাযোগ না করে ধৈর্য ধরে তার চিঠির অপেক্ষায় রইল।
এভাবে তিন-চার মাস অতিবাহিত হবার পরও ফাহমিদা যোগাযোগ করল না। এর মধ্যে এস. এস. সি. পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। শামী চারটে লেটার নিয়ে স্টার মার্ক পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসানে পাস করেছে। রেজাল্ট বেরোবার পর থাকতে না পেরে একদিন শামী জোবেদাদের বাড়িতে গেল। তাকে পেল না। তার ছোট বোন আখতার বানু বলল, গতকাল খালা আপাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। জানেন শামী ভাই, আপা ও রাহেলা আপা সেকেণ্ড ডিভিসানে পাস করেছে। আর ফাহমিদা আপা তিনটে লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিসান পেয়েছে।
শামী বলল, আমি ওদের স্কুলে গিয়ে জেনে এসেছি। এখন চলি পরে আর একদিন আসব। তারপর সেখান থেকে ফিরে আসতে আসতে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে ফাহমিদার সঙ্গে দেখা করবে। জোবেদা বাড়ি ফিরে এলে আর একদিন তার কাছে যাবে ভেবে রাখল।
শামীর দিন যেন কাটতে চায় না। একদিন রায়হানের কাছে গিয়ে বলল, পরীক্ষা সেই কবে হয়ে গেছে, রেজাল্টও বেরিয়ে গেল। এখনও ফাহমিদার কাছ থেকে কোনো খবর পাচ্ছি না। কি করা যায় বলতে পারিস?
রায়হান বলল, তুই কারো হাতে চিঠি দিয়ে দেখ, সে কি করে।
না, তা আমি দেব না। দিলে ওয়াদা ভঙ্গ হবে। আমি ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারব না।
ফাহমিদা যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তোকে কল করে, তা হলে তো তোর কোনো আপত্তি নেই?
তাতে আপত্তি থাকবে কেন? সে অগ্রভূমিকা নিলে আমার ওয়াদা ভঙ্গ হবে না।
ঠিক আছে, এখন তুই যা। ভেবে চিন্তে দেখি কি করা যায়।
শামী ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এল। মাসখানেকের মধ্যে সে মুন্সীগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে লাগল। কিন্তু ফাহমিদার জন্য তার মনে একবিন্দু শান্তি নেই। শেষে একদিন জোবেদার কাছে গিয়ে ফাহমিদার কথা জিজ্ঞেস করল।
জোবেদা বলল, ফাহমিদা রামপাল কলেজে ভর্তি হয়েছে।
তুমি ও রাহেলা ভর্তি হওনি?
না, আমরা আর পড়ব না।
কেন?
রাহেলার তো বিয়ের কথা চলছে।
তার না হয় বিয়ের কথা চলছে, কিন্তু তুমি ভর্তি হলে না কেন? তোমারও কি সে রকম কিছু হচ্ছে না কি?
জোবেদা এই কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
কি সত্যি তাই নাকি?
না তাই নয়। আব্বা আর পড়াতে চান না। ওসব কথা বাদ দিন, কেন এসেছেন বলুন।
ফাহমিদার সঙ্গে অনেক দিন থেকে যোগাযোগ নেই। তাই তার একটু খোঁজ নিতে এলাম। সে কেমন আছে বলতে পার?
কেন পারব না? সে তো ভালই আছে। কলেজে যাচ্ছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। আপনার সঙ্গে কতদিন যোগাযোগ নেই? আমার সঙ্গে তো কয়েকদিন আগে দেখা হয়েছিল। কই, সে রকম কিছু বলল না তো? তাকে কি আপনার কথা বলে ডেকে নিয়ে আসব?
শামী বলল, না না ডাকতে হবে না। সে কেমন আছে, শুধু জানতে এসেছিলাম। আচ্ছা, এবার আসি। তারপর সালাম দিয়ে স্থাপদে চলে গেল।
জোবেদা শামীকে ঐভাবে চলে যেতে দেখে ভাবল, ওদের দুজনের মধ্যে কি মনোমালিন্য হয়েছে। শামীকে যতদূর দেখা গেল ততদূর তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আড়াল হয়ে যেতে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
এদিকে রায়হান চিন্তা করছে কিভাবে শামীকে জানান যায়, ফাহমিদার বিয়ে তার খালাত ভাইয়ের সাথে হবে। আর সেই জন্যে সে এতদিন শামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। একদিন রায়হান তার এক সাথীকে নিয়ে শামীদের বাসায় এল। আপ্যায়নের পর তিন জনে গল্প করতে লাগল।
এমন সময় ফাহমিদার ছোট চাচার মেয়ে জমিলা একটা নোট বই হাতে করে নিয়ে এসে শামীকে বলল, ফাহমিদা আপা পাঠিয়েছে। জমিলা ক্লাস ফাইভের ছাত্রী।
জমিলাকে দেখে ও তার কথা শুনে শামীর মুখে আনন্দের ঢেউ ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি বইটা নিয়ে ফরফর করে পাতা উল্টে দেখে কিছু না পেয়ে তার মুখটা মলিন। হয়ে গেল। বইটা আস্তে করে টেবিলের উপর রেখে বেশ কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। তখন তার প্রিটেস্টের আগের কথা মনে পড়ল। এই বইটার মধ্যে রফিকের হাতে ফাহমিদাকে শেষ চিঠি পাঠিয়েছিল। এই বইটাই তার আব্বার হাতে চিঠিসহ ধরা পড়েছিল। সেই থেকে বইটা তার কাছে রয়ে গিয়েছিল। তারপর যোগাযোগ বন্ধ থাকায় শামীকে আবার বইটা কিনতে হয়।