- বইয়ের নামঃ বিদায় বেলায়
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ নূর-কাসেম পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. পূর্ব-দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ
বিদায় বেলায় – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
ঢাকা থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে মুন্সীগঞ্জ যেতে হয়। তবে সরকারী ও বেসরকারী গাড়ি পারাপারের জন্য পঞ্চবটী রোডের দক্ষিণে ধলেশ্বর নদীতে মুক্তারপুর ফেরীঘাট আছে। নারায়ণগঞ্জের পূর্বকোল ঘেঁষে শীতলক্ষা নদী প্রবাহিত। আর দক্ষিণে ধলেশ্বর নদী। এই নদীর দক্ষিণ পাড়ে মুন্সীগঞ্জ। এটা একটা উপশহর। এখানে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোর্ট-কাঁচারী, জেলা পরিষদ ও বিভিন্ন অফিস এবং হাসপাতাল আছে।
বর্ষাকাল। খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, নদী-নালা ও মাঠ-ঘাট পানিতে থৈ থৈ করছে। গ্রামের মেঠো পথগুলোয় একহাঁটু কাদা। মুন্সীগঞ্জের এদিকের রাস্তাগুলো এখনও পাকা হয়নি। তবে গ্রামের পাশ থেকে একটা বিশ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা মুন্সীগঞ্জ থেকে টঙ্গিবাড়ী হয়ে বালিগাঁও পর্যন্ত চলে গেছে। যারা শহরে চাকরি করে বা লেখাপড়া করে অথবা কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাতায়াত করে, তারা বর্ষার সময় বাড়ি থেকে জুতো হাতে করে এসে পাকা রাস্তার ধারে ডোবার পানিতে পা ধুয়ে জুতো পায়ে দিয়ে চলাচল করে। মুন্সীগঞ্জের তিন চার মাইল দক্ষিণে এমনি একটা গ্রাম আলদিবাজার। গ্রামটা বেশ বড়। চার পাঁচটা পাড়া নিয়ে এই গ্রাম। গ্রামের উত্তর পাড়ায় আব্দুস সাত্তারের বাড়ি। ওনি একজন আলেম। কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ওনাদের বংশে বেশ কয়েকজন আলেম ও কুরআনে হাফেজ আছেন। ওনারা দেশের বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। আব্দুস সাত্তারের এক ছেলে তিন মেয়ে। মেয়ে তিনটে ছোট। ছেলেটা বড়। নাম আব্দুস শামী। ডাক নাম শামী। আব্দুস সাত্তার ছেলেকে প্রথমে মক্তবে এবং পরে কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। শামী খুব মেধাবী ছাত্র। পাঞ্জাম পর্যন্ত খুব ভালভাবে পড়াশোনা করল। পাঞ্জামের ফাইন্যাল পরীক্ষার পর গ্রামের কিছু বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিল।
তার মা মাসুমা বিবি একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, তুই মাদ্রাসায় যাচ্ছিস না কেন?
শামী বলল, আমার পড়তে ভালো লাগে না।
মাসুমা বিবি খুব অবাক হয়ে বললেন, কেন?
কেন আবার? বললাম তো পড়তে ভালো লাগে না।
তোর আব্বা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না। কাল থেকে মাদ্রাসায় যাবি।
না, আমি আর পড়ব না।
কি করবি তা হলে? সারাদিন গ্রামের আজেবাজে ছেলেদের সাথে বোম বোম করে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগে বুঝি? ঘরে আসুক তোর আব্বা, এলে মজা বুঝবি।
কিছু না বলে শামী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মাসুমা বিবি ছেলের স্পর্ধা দেখে যেমন খুব অবাক হলেন তেমনি রেগে গেলেন। ভেবে রাখলেন, খাবার সময় এলে যা করার করবেন। তারপর এক সময় একটা বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে রাখলেন।
শামী সেদিন সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে রাতে ঘরে ফিরল। সে আজ সমস্ত দিন কিছু খায়নি। তার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। রাতে ঘরে এসে মাকে বলল, খেতে দাও।
শামী বাইরে চলে যেতে এবং সারাদিন বাইরে থাকায়, মাসুমা বিবি খুব রেগে ছিলেন। কিন্তু ছেলের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, সারাদিন কিছু খায়নি। তাই রাগটা চেপে রেখে ভাত বেড়ে খেতে দিয়ে বললেন, যাদের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়ালি তারা খেতে দেয়নি? নামায পড়েছিস, না তাও ছেড়ে দিয়েছিস?
শামী হাত ধুয়ে খেতে খেতে বলল, সমজিদ থেকে এশার নামায পড়েই তো এলাম।
মাসুমা বিবি আর কিছু বললেন না।
শামী খেয়ে উঠে ঘুমাতে গেল।
মাসুমা বিবি একটু পরে কঞ্চিটা নিয়ে রুমে এসে সপাং সপাং করে শামীকে মারতে মারতে বললেন, তুই পড়বি না কেন বল? না পড়লে তোকে আজ শেষ করে ফেলব।
শামী ভাবতেই পারেনি আম্মা তাকে মারবে। কারণ প্রথম সন্তান ও এক ছেলে বলে আম্মা তাকে ভীষন ভালবাসে। তাকে মারধর করা তো দূরের কথা, কোনো দিন চোখ পর্যন্ত রাঙ্গায়নি। বরং আব্বা কখনো কখনো কোনো কারণে বকাবকি করলে, আম্মা আব্বার উপর রাগ করে বলেছে, এতটুকু ছেলেকে তুমি এরকম করছে কেন? তারপর তাকে আদর করতে করতে আব্বার সামনে থেকে নিয়ে চলে গেছে। সেই আম্মাকে আজ কঞ্চি দিয়ে মারতে দেখে তার ভীষণ অভিমান হল। আম্মার চাবুকের আঘাত খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে চোখের পানি ফেলতে লাগল, তবু চিৎকার করে কান্নাকাটি করল না।
মাসুমা বিবি একসময় ক্লান্ত হয়ে মার থামিয়ে বললেন, এখন কি হয়েছে? তোর আব্বা এসে কি করে দেখবি। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এসে কঞ্চিটা ভেঙ্গে দুতিন টুকরো করে উঠোনের একদিকে ছুঁড়ে দিলেন।
তিনি যখন শামীকে মারতেছিলেন তখন ছোট মেয়ে তিনটেও সেখানে ছিল। তারা আম্মাকে কখনও এত রাগতে বা কাউকে মারতে দেখেনি। ভাইয়াকে মারতে দেখে তারা কান্না জুড়ে দিয়েছিল।
মাসুমা বিবি সেসব গ্রাহ্য না করে খাবার ঘরে এলেন। কিন্তু ভাত খেতে পারলেন। হড়ী-পাতিল ও থালা বাসন গুছিয়ে রেখে এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমাতে গেলেন। তিনি ছেলেমেয়ের গায়ে কখনো হাত তুলেন নি। আজ রাগের মাথায় ছেলেকে মেরেছেন। এখন রাগ পড়ে যেতে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগলেন। তবু ছেলেকে প্ৰবোধ দিতে গেলেন না। ভাবলেন, প্রবোধ দিতে গেলে ওর সাহস আরো বেড়ে যাবে। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি ঘুমাতে পারলেন না।