জোয়ার্দার বললেন, না।
আনেন নি কেন? যতবার আমার এখানে আসবেন ততষ্কার রসমালাই আনতে হবে।
আচ্ছা আনব।
আমি রাত একটায় টেলিফোন করেছিলাম। এই নিয়ে কি বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?
না।
আপনার এক শ্যালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার কথা বার্তা কি রকম যেন লাগল। বাদ দিন ঐ প্রসঙ্গ। আপনার শরীর কেমন?
ভাল।
চা খাবেন?
না।
না বললে হবে না। আপনি যতবার আসবেন আমার সঙ্গে চা খেতে হবে।
জোয়ার্দার বললেন, আপনার ছেলে মেয়ে কি?
শায়লা চা বানাতে বানাতে বললেন, আমি বিয়ে করিনি। কাজেই ছেলেমেয়ের প্রশ্ন আসছে না। একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছি। তার নাম সুপ্তি। তিনমাস বয়সে দত্তক নিয়েছিলাম। দিনরাত ঘুমিয়ে থাকত বলে নাম দিয়েছিলাম সুপ্তি। এখন তার বয়স আট। দিনরাত জেগে থাকে। আপনি কি চায়ে চিনি খান?
খাই।
শায়লা বলল, ঝিম ধরে চা খাবেন না। চা খেতে খেতে গল্প করুন।
জোয়ার্দার বললেন, কারো পক্ষে কি মৃত মানুষকে দেখা, তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব?
আপনি মৃত কাউকে দেখছেন? তার সঙ্গে কথা বলছেন?
হুঁ। বরকতউল্লাহ সাহেব। আমাদের অফিসে কাজ করতেন। আমার সিনিয়ার ছিলেন। হঠাৎ হার্ট এটাকে মারা গেছেন।
মৃত মানুষটার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়?
আমার বাসায়। উনি বেশির ভাগ সময় সোফায় বসে টিভি দেখেন।
শায়লা বললেন, আপনার মোবাইলে কি ছবি তোলার অপসন আছে?
জানি না আছে কিনা। মোবাইল আমার সঙ্গে নেই। রঞ্জু নিয়ে নিয়েছে।
আরেকটা সেট কিনতে পারবেন না যেখানে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে।
খালেককে বললেই কিনে দেবে। সে এইসব ব্যাপারে খুবই দক্ষ।
শায়লা বললেন, ছবি তোলা যায়। এসব একটা মোবাইল সেট আপনি কিনবেন। বরকতউল্লাহ সাহেবের কয়েকটা ছবি তুলবেন। পারবেন না?
পারব।
বিড়ালটা কি এখানো আসে?
আসে।
সেই বিড়ালটার ছবি তুলবেন। আপনার মেয়ের কোলে যে বিড়াল থাকে তার ছবি তুলবেন।
আচ্ছা তুলব। এখন উঠি?
শায়লা বললেন, এখন উঠবেন না। আরো কিছুক্ষণ বসবেন। আমি ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিব। বক্তৃতাটা মন দিয়ে শুনবেন। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
শায়লা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমরা কঠিন নিয়মের এক জগতে বাস করি। নিয়মের সামান্য নড়াচড় হলেই জগৎ ভেঙ্গে পড়বে। জগৎকে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে চলতে হয়। কোনো মৃত মানুষ যদি আপনার সঙ্গে বসে হিন্দী ছবি দেখে তাহলে পদার্থবিদ্যার সূত্র কাজ করবে না।
জোয়ার্দার ক্ষীণ গলায় বললেন, তাহলে কি আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
শায়লা বলল, সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তবে আমি নিজে মনে করি আপনি অসম্ভব কল্পনা বিলাসী একজন মানুষ। যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রচুর কল্পনা করেন বলে একসময় কল্পনাটা নিজের কাছে সত্যি মনে হতে থাকে। বুঝতে পারছেন?
হুঁ।
ভাবীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি রকম?
ভাল না।
সমস্যাটা কার? ভাবীর না আপনার?
আমার। সে আমার সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারছে না।
আপনি বুঝাবার চেষ্টা করছেন না বলেই বুঝতে পারছেন না। একবার ভাবীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসুন না। দুজনের সঙ্গে কথা বলি। আমার কাজটা তখন হবে ম্যারেজ কাউন্সিলারের।
আচ্ছা আমি নিয়ে আসব। অনিকাকেও নিয়ে আসব।
শায়লা বললেন, চেম্বারে আনার দরকার নেই। কোনো একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের লাঞ্চ করলাম।
জ্বি আচ্ছা। এখন কি আমি উঠিব?
উঠুন। বাসায় যাবেন?
জ্বি।
বাসায় গিয়ে যদি দেখেন বরকত সাহেব সোফায় শুয়ে আছেন, ছবি তুলতে ভুলবেন না।
ছবি কিভাবে তুলিব? মোবাইল ফোনতো কেনা হয় নি।
সরি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার কাছে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আছে। অপারেশন খুব সহজ। টিপলেই ছবি। ক্যামেরাটা নিয়ে যান।
জ্বি আচ্ছা।
রাত একটা দশ। জোয়ার্দারের ঘুমাতে যাবের কথা। তিনি ঘুমাতে যাননি। বরকতউল্লাহর পাশে বসে আছেন। দুজনের দৃষ্টিই টিভির দিকে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির অনুষ্ঠান হচ্ছে। পেঙ্গুইন পাখি দেখাচ্ছে। পাখির একটা দল বরফের ওপর দাঁড়িয়ে। অন্য দল পানিতে। পানির দলটি বরফে উঠতেই বরফের দল নেমে যাচ্ছে। ওঠা-নামা চলছেই।
জোয়ার্দার একটু আগে খিচুড়ি খেয়েছেন। খিচুড়ি খেতে ভালো হয়েছে। ভদ্রতা করে তিনি বরকতউল্লাহকে খিচুড়ি খেতে বলেছিলেন। বরকতউল্লাহ জবাব দেননি। একজন মৃত মানুষ তার পাশে বসে আছে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। জোয়ার্দাকে বললেন, চা খাবেন?
বরকতউল্লাহ না-সূচক মাথা নাড়লেন।
রাতে ঘুমাবেন? গোস্টরুম খালি আছে। গোস্টরুমে ঘুমাতে পারেন।
বরকতউল্লাহ মূর্তির মতো বসে রইলেন। তিনি ক্লাতে ঘুমাতে যাবেন এ রকম মনে হচ্ছে না। জোয়ার্দারের বাসা খালি। খালি বাসায় জামাল এবং বিড়ালটা চলে আসে। আজ তারা আসেনি। জোয়ার্দার টিভির অনুষ্ঠানের দিকে নজর দিলেন। পেঙ্গুইনরা এখন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওপর প্রবল তুষারপাত হচ্ছে। জোয়ার্দার নিজের মনেই বললেন, ঘটনা কী?
বরকতউল্লাহ বললেন, এরা ডিম পাহারা দিচ্ছে।
জোয়ার্দার বললেন, ও আচ্ছা।
বরকতউল্লাহ বললেন, এসব প্রোগ্রাম মন দিয়ে দেখতে হয়।
জি জি।
ডিম পাহারা দিচ্ছে পুরুষ পেঙ্গুইনরা।
ও আচ্ছা।
ওদের সোসাইটিতে এটাই নিয়ম।
জোয়ার্দার বললেন, ইন্টারেস্টিং!
বরকতউল্লাহ বিরক্ত গলায় বললেন, ইন্টারেস্টিং কিছু না। প্রাণীদের ভিন্ন ভিন্ন নিয়মে চলতে হয়। আপনার টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন ধরুন। ফোন হাতের কাছে রাখতে হয়। ফোন ধরতে যাবেন, অনেকটা প্রোগ্রাম মিস করবেন।