সোহানা বেগম ভিজে গলায় বললেন, তুমি আমার রুবীনার থেকে অনেক বেশি মা। রুবীনাকে কেড়ে নিবে বলে আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। লাইলী বসে পড়ে শাশুড়ীর পা জড়িয়ে ধরে বলল, তা হলে এবার থেকে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করবেন বলুন? না খেয়ে খেয়ে আপনি শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছেন।
সেলিম ও আরিফ উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা, তোমার বউ যা বললে, সেইমত আমাদের সবার চলা উচিত। নচেৎ আল্লাহ বেজার হবেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির সবার মনে শান্তি ফিরে আসতে লাগল।
কয়েকদিন পর মনিরুল রেহানা ও আসমাকে নিয়ে সেলিমদের বাড়িতে বেড়াতে এল। নাস্তার টেবিলে সবাই বসেছে। লাইলী নাস্তা আনার জন্য রান্নাঘরে গেছে। হঠাৎ মনিরুল উঠে গিয়ে সোহানা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে বলল, ফুফুআম্মা, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আমি আপনাকে আর ভাবির আবাকে বেনামে চিঠি দিয়ে সেলিমের বিয়ে ভাঙ্গিয়েছিলাম। আমার এই অন্যায় কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে মাফ চাইছি।
এমন সময় লাইলী চা-নাস্তা নিয়ে এসে মনিরুলের কথা শুনে থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সোহানা বেগম শুনে ওম হয়ে বসে রইলেন। তার নিজের ভাইপো হয়ে এমন জঘন্য কাজ করবে, তিনি কখনও ভাবতে পারেন নি।
ফুফুআম্মাকে চুপ করে থাকতে দেখে মনিরুল আবার বলল, আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, তবে আমি কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আর নিজের বিবেকের চাবুকে চিরকাল জর্জরিত হতে থাকব। তার কথাগুলো কান্নার মত শোনাল।
লাইলী শাশুড়ীকে বলল, আপনি মনিরুল ভাইকে ক্ষমা করে দিন মা। আল্লাহপাক ক্ষমাকে ভালবাসেন। যখন কেউ নিজের অপরাধ স্বীকার করে অনুতপ্ত হৃদয়ে তার কাছে ক্ষমা চায়, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ক্ষমা করে দেন। যে ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করে, আল্লাহপাক তার অপরাধও ক্ষমা করে দেন এবং তাকে ভালবাসেন।
সোহানা বেগম পূত্রবধূর কথা শুনে অশ্যপূর্ণ নয়নে বললেন, মনিরুল, তুমি আমার কাছে যতটুকু অপরাধ করেছ, তার চেয়ে শতগুণ বেশি মা লাইলীর কাছে করেছ। আগে তার কাছে মাফ চাও। আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম।
মনিরুলকে উঠে তার দিকে এগোতে দেখে লাইলী বলল, আমার কাছে মাফ চাইতে হবে না। আমি কোনোদিন কারুর দোষ দেখি না। কেউ যদি আমার কোনো
ক্ষতি করে, তখন আমি ভাবি সবকিছু আল্লাহপাকের ইশারা। তার হুকুম ছাড়া কারুর কিছু করার ক্ষমতা নেই। সেই কথা চিন্তা করে আমি কারও প্রতি দোষারোপও করি এবং কাউকে অপরাধীও মনে করি না। যদি কিছু করে থাক, দোয়া করছি, আল্লাহপাক যেন তোমাকে মাফ করেন।
লাইলীর জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে সকলে শুধু অবাক নয়, সেই থেকে তারা তাকে আল্লাহপাকের খাসবান্দী বলে মনে করল।
সোহানা বেগম পূত্রবধূকে কাছে বসিয়ে গায়ে ও মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ এমন রত্মকে আমার বৌ করে ধন্য করেছেন। আল্লাগো! তোমার দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া।
সেলিম বলল, আমি কিন্তু মনিরুলকে কিছুতেই ক্ষমা করতাম না। আসমাকে বিয়ে করেছে বলে ক্ষমা পেয়ে গেল। আল্লাহ ওকে সুবুদ্ধি দিয়েছেন, মচৎ আমি এতক্ষণ ওকে আস্ত রাখতাম না। আল্লাহপাকের দরবারে দোওয়া করি, তিনি যেন আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করেন। তারপর লাইলীকে বলল, তুমি চা নাস্তা খাওয়াবে, না মায়ের সব আদরটুকু স্বার্থপরের মত নিজে একা ভোগ করবে? তারপর মাকে বলল, তুমি যেভাবে ওকে আদর করছ, মনে হচ্ছে দুদিন পরে আমদেরকে ভুলেই যাবে। আচ্ছা আরিফ! তুইও কিছু বলবি না?
আরিফ হাসতে হাসতে বলল, ভাইয়া, আদর-যত্ব, ভক্তি-সম্মান কেউ কাউকে দেয় না। আদায় করার ক্ষমতা থাকা চাই। ঐগুলো পাওয়ার জন্য যা কিছু দরকার, সবগুলোই ভাবির মধ্যে আছে। সেইজন্য সে আমাদের সবাই-এর কাছ থেকে শ্ৰেনীমত আদর-যত্ন-ভক্তি সম্মান পাচ্ছে।
সেলিম বলল, তুইও তোর ভাবির দলে? বেশ, তোরা তাকে ভক্তি-সম্মান করতে থাক, আমি হোটেলে গিয়ে চা খাব। সেই কখন থেকে চা খাবার ইচ্ছা হচ্ছে। তারপর সত্যি সত্যি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
লাইলী তাড়াতাড়ি করে নাস্তা পরিবেশন করতে লাগল।
সোহানা বেগম বললেন, আমি তো ভাগ্যচক্রে ওকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তুইতো খুঁজে এনে দিলি। ওর জন্য সেদিন তুই আমাকে কি বলেছিলি মনে আছে? বাপ মরা মেয়েকে এখন একটু আদর করলে তোর হিংসা হয় কেন?
সোহানা বেগমের কথা শুনে সবাই মিটি মিটি হাসতে লাগল।
লাইলী চায়ের কাপটা সেলিমকে দেওয়ার সময় ফিস ফিস করে বলল, নিজের কথায় কেমন বকুনি খাওয়া হচ্ছে?
সেলিম কৃত্রিম রাগতস্বরে বলল, মা তোমার ফরে, তা না হলে কে তোমার কথা শুনতো?
১২. এক রাত্রে ঘুমাবার সময়
এক রাত্রে ঘুমাবার সময় লাইলীর দেরি দেখে সেলিম ছটফট করতে লাগল। তাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে তার ঘুম আসে না। সে মনে মনে একটু রেগে গেল।
লাইলী শাশুড়ীর বিছানা ঠিক করে দিয়ে মাথার কাছে টেবিলে এক গ্লাস পানি ঢেকে রেখে তার হুকুম নিয়ে নিজের রুমে ঢুকল। দেখল, সেলিম চেয়ারে বসে বই পড়ছে।
সেলিম লাইলীকে ঢুকতে দেখেও না দেখার ভান করে বই পড়তে লাগল।
লাইলী বুঝতে পারল, তার অভিমান হয়েছে। কারণ খাওয়া দাওয়ার পর মায়ের কাছে সবাই গল্প করছিল। সেলিম উঠে আসার সময় লাইলীকে ইশারা করে চলে আসতে বলেছিল। কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেছে। লাইলী চেয়ারের পেছন থেকে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চিবুক রেখে বলল, অপরাধীনি ক্ষমা প্রার্থী। সারাদিন অফিসে কাজ করে তুমি ক্লান্ত, এবার ঘুমাবে চল।