এবারও আসমা মাথা নাড়ল। এমন সময় রেহানা সেলিম তুমি ঘরে আছ বলে ভিতরে ঢুকে আসমাকে ঐ অবস্থায় দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেলিম ভালো হয়ে ফিরে এসেছে জেনে সে তাকে দেখতে এসেছে।
সেলিম আসমার মাথাটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল, উঠে বস। তারপর রেহানার দিকে চেয়ে বলল, কি খবর? কেমন আছ?
রেহানা নিজেকে সামলে নিয়ে ঝাঁজের সঙ্গে বলল, সেলিম তুমি এত নিচে নেমে গেছ? আমি যে ভাবতে পারছি না, ছি, ছি, ছি।
সেলিম বলল, তুমি একি বলছ রেহানা? তোমার কাছ থেকে একথা শুনব আশা করিনি।
ততক্ষণে আসমা উঠে দাঁড়িয়ে দুচোখ মুছে বলল, দেখুন রেহানাদি, যারা বাইরেটা দেখে বিচার করে, তাদের রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল হয়। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রেহানা বলল, শুনেছি মেয়েটা তোমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। সে তো অনেকদিন হয়ে গেল এসেছে, আর কত দিন থাকবে?
সেলিম বলল, আচ্ছা রেহানা, মেয়েরা এত হিংসুটে ও সন্দেহ প্রবণ হয় কেন বলতে পার? যাক, তুমি আমাকে যা কিছু ভাবতে পার। এখন দয়া করে আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লীজ।
রেহানা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেলিমের শেষের কথা শুনে অপমান বোধ করে হাই হিল জুতোর আওয়াজ তুলে গট গট করে চলে গেল।
সেলিম চোখ বন্ধ করে আবার লাইলীর চিন্তায় ডুবে গেল।
ঐদিন দুপুরে আরিফের চিঠি এল। সে প্রথমে হাফেজ হয়ে পরে আরবীতে এম, এ, পাশ করেছে। যে কোনোদিন বাড়িতে এসে পৌঁছাবে। সেলিমের ব্যাপারটা নিয়ে এ সংসারে যেমন বিষাদের ছায়া নেমেছিল, আরিফের চিঠি পেয়ে সকলের মনে আনন্দের সাড়া জেগে উঠল। সেলিম মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি, আমি বলিনি? আরিফ মানুষের মত মানুষ হয়ে একদিন ঠিক ফিরে আসবে? এতদিন নিজেকে বড় একা মনে হত, ও এলে আর কোনো চিন্তা নেই। সকলে আরিফের পথ পানে চেয়ে রইল।
দিন দশেক পরের ঘটনা। রুবীনা বিকেলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকে চেয়েছিল। দেখল, একজন দাড়ীওয়ালা মৌলবী ধরনের লোক গেটে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভিতরে আসছে।
দারোয়ান তার হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে আগে আগে এসে চিৎকার করে বলল, বেগম সাহেবা দেখবেন আসুন, ছোট বাবু এসেছেন।
উপরের বারান্দা থেকে রুবীনা আরিফকে চিনতে পারেনি। দারোয়ানের চিৎকার শুনে সকলে নিচের বারান্দায় বেরিয়ে এল।
আরিফ মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা তুমি কেমন আছ? আমাকে মাফ করে দিয়েছ তো?
সোহানা বেগম ছেলেকে বুকে চেপে ধরে আনন্দঅশ্রু ফেলতে ফেলতে বললেন, মাফ তো অনেক আগেই করেছি। আল্লাহ যে তোকে আমার কোলে ফিরিয়ে আনলেন, তার জন্য তাঁকে অসংখ্য শুকরিয়া জানাচ্ছি। তোর খবরাখবর চিঠি দিয়েও তো জানাতে পারতিস। আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে কত যে খুশি হতেন।
আরিফ মাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কি বললে মা? আহ্বা বেঁচে নেই? ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন বলে মায়ের পায়ের কাছে বসে তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আব্বা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন? আমি যে তার কাছে মাফ চাইতে পারলাম না। ইয়া রাহমানুর রহিম, তুমি আমার আবার রুহের মাগফেরাত দান কর। তার সমস্ত অপরাধ মাফ করে দাও।
সোহানা বেগম ছেলের হাত ধরে তুলে বললেন, কতদুর থেকে এসেছিস, চল বাবা, হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিবি। তারপর রুবীনার দিকে চেয়ে বললেন, তোর ছোটদার জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।
আরিফ বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজের রুমে কাপড় পাল্টাল। একটা অচেনা মেয়েকে রুবীনা ও মায়ের সঙ্গে নাস্তা নিয়ে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, মা, এই মেয়েটিকে তো চিনতে পারছি না?
সোহানা বেগম বললেন, তুই চিনবি না। আমাদের দুর সম্পর্কে আত্মীয়া। বিপদে পড়েছে। তাই সেলিম ওকে রুবীনার মত মানুষ করছে। এমন সময় বছর তিনেকের একটা ছেলে পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে আরিফের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে আম্মা বলে এগিয়ে গেল। আসমা ছেলেকে কোলে তুলে নিল।
আরিফ বলল, বাহ! ছেলেটা তো খুব সুন্দর। সোহানা বেগম বললেন, হ্যাঁ ওরই ছেলে।
আরিফ নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কখন ফিরবে? সে নিশ্চয় ব্যবসা বাণিজ্যে মন দিয়েছে?
সোহানা বেগম মান স্বরে বললেন, সে দেখবে না তো কে দেখবে? সে একা আর কত দিক সামলাবে। কখন ফেরে, কখন খায়, তার কিছু ঠিক নেই। এবার দু’ভাই মিলে সবকিছু দেখাশোনা করবি।
আচ্ছা মা, মনে হচ্ছে ভাইয়ার এখনও বিয়ে দাওনি?
আরিফের কথা শুনে সোহানা বেগমের মুখটা আরও মান হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কি আর বলব বাবা, বিয়ে তো ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তা আর হল কৈ?
কেন, হল না কেন।
বিয়ের বিশ পঁচিশ দিন আগে তোর দাদা এ্যাক্সিডেন্ট করে স্মৃতি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ওকে নিয়ে আমি সুইজারল্যান্ডে গিয়ে ছ’মাস চিকিৎসা করিয়ে ভালো করি। এই তো মাত্র দশ বারদিন হল আমরা ফিরেছি।
আরিফ আল্লাহপাকের দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানিয়ে বলল, তিনি যা কিছু করেন, তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। তুমি অত মন খারাপ করছ কেন? এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে ভাইয়ার বিয়ের ব্যবস্থা কর।