আল্লাহপাকের দয়াতে ভালো আছি। আসুন ভিতরে চলুন। ড্রইংরুমে এসে দুজনে বসল। লাইলী আগেই ভাইয়াকে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে।
একটু পরে রহিমা তিন কাপ চা নিয়ে এসে লাইলীকে দেখতে না পেয়ে বলল, কই আমার ননদিনীকে দেখছি না কেন?
জলিল সাহেব বললেন, ও গেট দিয়ে ঢুকেই পালিয়ে গেছে। চা পান শেষ করে সেলিম বিদায় নিয়ে ফিরে গেল।
রহমান সাহেব ও হামিদা বানু এত রাত পর্যন্ত লাইলী ফিরে আসছে না দেখে খুব চিন্তিত ছিলেন। মেয়েকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। লাইলীকে ডেকে রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এত রাত হল কেন মা? আমরা এদিকে ভেবে মরছি।
লাইলী বালা পরা হাত দুটো দেখিয়ে লজ্জা রাঙা হয়ে বলল, ওর আম্মা পরিয়ে দিয়েছেন। উনি আপনাদের সালাম জানিয়েছেন। আমি আর কিছু বলতে পারব না বলে প্রায় ছুটে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
রহমান সাহেব স্ত্রীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, তার দুচোখ থেকে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছে।
পরের দিন সকালে লাইলীর হাতের দিকে চেয়ে রহিমা জিজ্ঞেস করল, কি গো সখি, কে পরিয়ে দিল?
লাইলী লজ্জা পেয়ে বলল, তুমিই বল না দেখি?
নেকলেস হলে বুঝতাম, সেলিম দোকান থেকে কিনে পরিয়ে দিয়েছেন। বালা যখন, তখন নিশ্চয় ওর মা পরিয়ে দিয়েছেন।
প্রথমটা ঠিক কিনা জানি না, তবে দ্বিতীয়টা তুমি ঠিক বলেছ। জান ভাবি, ফাংশানের শেষে যখন ওর মা সকলকে বিয়ের কথা বলে বালা দু’টো পরিয়ে দিলেন তখন আমার এত লজ্জা ও ভয় করছিল যে, তোমাকে আমি ঠিক বলতে পারছি না।
শুধু লজ্জা আর ভয় পেলে, আনন্দ পাওনি?
তা আবার পাইনি। কত বড় বড় ঘরের লোকজনও তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে ছিল, আমি তো খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
রহিমার কাছে লাইলীর মা-বাবা সব কিছু শুনে যেমন খুশি হলেন, তেমনি আবার চিন্তিতও হলেন। অত বড়লোকের খাতির যত্ন করবেন কেমন করে? রহমান সাহেব আনন্দে অসুখের কথা ভুলে গেলেন। তিনি সুস্থ মানুষের মত পরের দিন থেকে নিয়মিত অফিস করতে লাগলেন।
দু’দিন পর বিকালে সোহানা বেগম ড্রাইভারের সঙ্গে লাইলীদের বাড়িতে এলেন।
রহমান সাহেব ও জলিল সাহেব কেউ অফিস থেকে তখনও ফেরেন নি। লাইলী সোহানা বেগমকে সালাম করে মা ও ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয়ের পালা শেষ করে হামিদা বানু প্রাথমিক আপ্যায়নের পর রহিমাকে সোহানা বেগমের কাছে বসিয়ে, লাইলীকে নিয়ে নাস্তা তৈরি করতে গেলেন।
সোহানা বেগম রহিমার কাছ থেকে তাদের ও লাইলীদের সব খবর জেনে নিলেন।
হামিদা বানু নাস্তা তৈরি করে এনে বললেন, আমরা ভাই গরিব মানুষ। আপনাদের মত লোকের আদর যত্ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যতটুকু করেছি খেয়ে আমাদের ধন্য করুন।
সোহানা বেগম তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন, ঐ রকম কথা বলে লজ্জা দেবেন না। আমি সবকিছু জেনেশুনে আত্মীয়তা করত এসেছি। এখানে গরিব ও বড়লোকের প্রশ্ন নেই। আসুন আমরা তিনজন এক সঙ্গে খাই, লাইলীর বাবা ও দাদা বুঝি এখনও ফেরেন নি?
হামিদা বানু বললেন, না, তবে আসবার সময় হয়ে গেছে। লাইলী সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করল। নাস্তার পর তিনজনে গল্প করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রহমান সাহেব ও জলিল সাহেব ফিরলেন।
পরিচয়াদির পর সোহানা বেগম বললেন, আমি তো লাইলীকে পূত্রবধূ করার জন্য পাকা কথা বলতে এসেছি। আপনাদের মতামত না নিয়েই সেদিন আমাদের বাড়িতে সকলের সামনে লাইলীকে পূত্রবধূ করব বলে মনোনীত করেছি। আপনাদের মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখন আপনাদের মতামত জানতে পারলে একদম দিন ধার্য করে ফিরব।
রহমান সাহেব বললেন, আমরা কি আর বলব। এযুগে এরকম ঘটনা বিরল। মনে হয় আল্লাহপাকের বড় রহমত আমাদের মেয়ের উপর। তাই আপনাদের মত লোকের বাড়িতে তার স্থান হচ্ছে। দোয়া করি, তিনি যেন আপনাদের সবাইকে সুখী করার তওফীক লাইলীকে দান করেন। আর ওদের দাম্পত্য জীবন সুখের করেন। এর বেশি কি আর বলব বোন?
সোহানা বেগম লাইলীকে ডাকতে বললেন।
রহমান সাহেব অনুচ্চস্বরে মেয়ের নাম ধরে ডেকে বললেন, এখানে এস তো মা।
পাশের রুম থেকে লাইলী তাদের সবকথা শুনতে পাচ্ছিল। ধীরে ধীরে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
সোহানা বেগম ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে পাঁচভরী ওজনের একটা সোনার হার বার করে লাইলীর গলায় পরিয়ে দিলেন।
লাইলীর রূপ ঝলসে উঠল। সবাই নির্বাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল। লাইলী প্রথমে সোহানা বেগমকে ও পরে একে একে সবাইকে কদমবুসি করল।
সোহানা বেগম তার মাথায় ও চিবুকে হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক মা, তোমরা দুজনে সুখী হও।
বিয়ের তারিখ ঠিক করে সোহানা বেগম ফিরতে চাইলে রহমান সাহেব বললেন, সে কি কথা বেয়ান, আপনি আজ মেহমান হয়ে প্রথম এসেছেন, খাওয়া দাওয়া না করে যেতে দিচ্ছি না।
সোহানা বেগম বললেন, একটু আগে তো খেলাম। আমি এত তাড়াতাড়ি আর কিছু খেতে পারব না। আত্মীয়তা যখন হল তখন তো মাঝে মাঝে এসে খেয়ে যাব। আমি একা মানুষ, আরও কয়েক জায়গায় যেতে হবে, কাজ আছে।
রহমান সাহেব নাছোড়বান্দা। শেষে আর এক প্রস্থ চা বিস্কুট খেয়ে সোহানা বেগম বিদায় নিলেন।
———
(১) সূরা-হুজুরাত, ১০ নং-আয়াত, পারা-২৬।
(২) বর্ণনায়, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ)- বোখারী ও মুসলিম।
০৭. সেলিমদের বাড়ি থেকে ফিরে মনিরুল
সেলিমদের বাড়ি থেকে ফিরে মনিরুল রেহানাকে বলল, তুই তো সেদিন খুব ফটফট করে বললি, তোর দিকটা তুই সামলাবি। দেখলি তো, ঐ মেয়েটা তোকে টেক্কা দিয়ে জিতে গেল।