মোসারেফ হোসেন বললেন, হ্যাঁ মা যাও, শুয়ে পড়। গরুর গাড়ির ঝাঁকুনিতে মাথা তো ধরবেই।
আসমা অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারলো না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চিন্তা করতে লাগল, একদিকে আমার প্রেম ও স্বপ্ন এবং অন্যদিকে আব্বার জীবন ও পুরো সংসারের ধংসলীলা। কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করল, আল্লাহ গো, আমি এখন কী করব, মতিকে কী বলব, তুমিই বলে দাও।
.
সালেহার বয়স পনের মোলর মতো। স্বাস্থ্য ভালো। দেখতে আসমার থেকে সুন্দরী। তরুণী বয়সেই যুবতী বলে মনে হয়। বুবুর সঙ্গে মতি ভাইয়ের যে ভালোবাসা হয়েছে তা জানে। সেও চায়, মতি ভাইয়ের সঙ্গে বুবুর বিয়ে হোক। ইদানিং রিয়াজুল ভাই এসে তাদের সব দায়-দায়িত্ব নিতে তাকে বড় ভাইয়ের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আজ ঘুমাবার সময় বুবুকে ডেকে আব্বা কি বলেছে তা জানতে পারল না। কারণ বুবু যখন আব্বার কাছ থেকে ফিরে আসে তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতে বুবুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ভয় পেল। তাকে নাড়া দিয়ে বলল, বুবু তুমি কাঁদছ কেন? কোননা। খারাপ স্বপ্ন দেখছ না কি?
আসমা সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, না, ওসব কিছু নয়, তুই শুয়ে পড়।
সালেহা অবাক হয়ে বলল, তুমি তা হলে জেগে জেগে কাঁদছ? কি হয়েছে বুবু বল না, আমার খুব ভয় করছে।
আসমা তার গায়ে হাত রেখে বলল, কিসের ভয়? আমি তোর পাশে রয়েছি না। নে এবার শুয়ে পড়।
সালেহা চিন্তা করতে লাগল, বুবু কাঁদছে কেন? রাতে আব্বা কি বকেছে? কিন্তু আব্বাতো বুবুকে আগেও কতবার বকেছে, কই কোনো সময়েই তো কাঁদেনি। তা হলে এখন কেন কাঁদছে। কারণ খুঁজে না পেয়ে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, বুবু তুমি ঘুমিয়েছ?
না, তুই ঘুমাসনি এখনো?
তুমি কেন কাঁদছিলে না বললে ঘুম আসবে না।
তুই আমাকে খুব ভালবাসিস তাই না?
সালেহা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে আমি সবার চেয়ে বেশি ভালবাসি। কেন, সে কথা কী তুমি জান না?
আসমা তার দু’গালে চুমো খেয়ে বলল, জানি রে জানি, তবু জিজ্ঞেস করলাম আরকি। আচ্ছা, আমি যদি মরে যাই তখন কী করবি?
বুবু এমন কথা আর বলবে না। তুমি মরে গেলে আমিও মরে যাব।
তুই আমাকে এত ভালবাসিস? ঠিক আছে ঐ কথা আর বলব না। এবার বল, বিয়ে হয়ে গেলে আমি তো স্বামীর ঘরে চলে যাব, তখন কী করবি?
বারে, রোজ পাঁচ-ছ’বার তোমাকে দেখতে যাব। মতি ভাইয়ের বাড়ি তো কাছেই।
এই কথা শুনে আসমার চোখে পানি চলে এল। ভিজে গলায় বলল, আর মতি ভাইয়ের সঙ্গে যদি বিয়ে না হয়?
কেন হবে না? তোমরা দু’জন যে অনেকদিন থেকে দু’জনকে ভালবাস তা আমি জানি।
আসমার ভীষণ কান্না পেতে লাগল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সামলাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
সালেহা ভয়ার্ত স্বরে বলল, বুবু তুমি আবার কাঁদছ? তোমার কি হয়েছে?
আসমা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তুই কখনো কোনো ছেলেকে ভালবাসবি না। ভালবাসা শুধু কাঁদায়।
কেন বুবু? মতি ভাই কী তোমাকে বিয়ে করবে না বলেছে।
না রে, তা বলেনি। তারপর বলল, সে করতে চাইলে কী হবে, আমার ভাগ্যে মতি ভাই নেই।
সালেহার মনে হল, রাতে আব্বা নিশ্চয় কিছু বলেছে। বলল, মতি ভাই যখন চায় তখন তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না কেন? তোমাকে আল্লাহর কসম লাগে বল।
কাউকে বলবি না বল?
না বুবু কাউকে বলব না।
রিয়াজুল ভাইয়ের মা-বাবা আমাকে বৌ করতে চান। তারা আব্বাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। আব্বা রাজি আছেন এবং সে কথা তাদেরকে জানিয়েও এসেছেন। তারা। কিছুদিনের মধ্যে এসে বৌ করে আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবেন। আব্বা আমাকে ঢাকায় কিছু বলেননি। আজ রাতে ঘুমোবার সময় বলেছেন। এখন বুঝতে পারলি কেন কাঁদছি? কথা শেষ করে আসমা চোখ মুছল।
সালেহা জিজ্ঞেস করল, রিয়াজুল ভাই একথা জানেন?
হাঁ, তার মতামত নিয়েই তারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।
তা হলে মতি ভাইয়ের কী হবে? সে তো রিয়াজুল ভাইয়ের উপর খুব রেগে যাবে। আর তুমিও কী পারবে মতি ভাইকে বাদ দিয়ে রিয়াজুল ভাইকে বিয়ে করতে?
আমি কী করব কিছুই ভাবতে পারছি না। তাই তো শুধু কান্না পাচ্ছে। মতি ভাইকে যেমন বাদ দিতে পারব না, তেমনি রিয়াজুল ভাইকেও না। রিয়াজুল ভাই আমাদের সংসারের দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন, অনেক টাকা খরচ করে আব্বার চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছেন। তাকে যদি বিয়ে না করি, তা হলে সংসারের অবস্থা কী হবে? তা ছাড়া ডাক্তার বলেছেন, আব্বা যদি কোনো কারণে রেগে যান অথবা টেনশন ফিল করেন, তা হলে আবার স্ট্রোক করে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যেতে পারেন। তুই বল, আমি এখন কী করব? আত্মহত্যা করা যদি মহাপাপ না হত, তা হলে সেই পথ বেছে নিতাম। কথা শেষ করে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সালেহা কী বলবে ভেবে না পেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
আসমা কান্না থামিয়ে বলল, কি রে, ঘুমালি নাকি?
না, বুবু ঘুম আসছে না। তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আসমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কষ্ট আমারও কি কম হচ্ছে? শোন, ঘুমাবার চেষ্টা কর। আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছেন হবে। আমি এখন তাহাজ্জুদের ও এস্তেখারার নামায পড়ব।
বুবু তুমি তো আমাকে কবে থেকে তাহাজ্জুদ নামাষের ফযিলত বলে পড়তে বলেছ, পড়িনি। আজ থেকে আমিও পড়ব।