.
দিন দশেকের মধ্যে রিয়াজুল সব কাজ সেরে মোসারেফ হোসেন ও আসমাকে নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হল। রওয়ানা হওয়ার আগের দিন মতি আসমাকে ও রিয়াজুলকে চিঠি দিতে বলে দিল।
.
০৮.
মুনসুর আলি ও জাহেদা রিয়াজুলের চিঠি পেয়ে খুব অবাক হলেও মোসারেফ হোসেনের থাকার জন্য একটা রুম রেডি করে রেখেছিলেন।
ঢাকায় পৌঁছে রিয়াজুল সবার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল।
আসমা জাহেদা ও মুনসুর আলিকে কদমবুসি করে আব্বাকেও করল।
জাহেদা আসমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক মা, সুখি হও। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এর কথা তো তুই চিঠিতে লিখিসনি?
রিয়াজুল বলল, তোমাদেরকে একটু অবাক করে দেব বলে লিখিনি।
পরের দিন রিয়াজুল মোসারেফ হোসেনকে পঙ্গু হাসপাতালের একজন বড় ডাক্তারের চেম্বারে দেখাল। উনি পরীক্ষা করে বললেন, অনেক দিন ঠিকমতো চিকিৎসা না করার ফলে ও মানসিক দুশ্চিন্তায় শিরা-উপশিরাগুলো খুব দুর্বল হয়ে গেছে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ঠিক মতো চিকিৎসা ও সেই সঙ্গে কিছু ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়ে যাবেন।
রিয়াজুল বলল, ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ উনি করবেন কি করে?
উনি করবেন না, আমরা উনাকে করাব।
ঠিক আছে, আপনি ব্যবস্থা করুন।
কোনো ক্লিনিকে রেখে চিকিৎসা করাতে পারবেন?
জ্বি পারব।
ডাক্তার প্যাডে ক্লিনিকের নাম ঠিকানা ও ভর্তি করার এ্যাডভাইস লিখে রিয়াজুলের হাতে দিয়ে বললেন, আজ কালের মধ্যে ভর্তি করে দিন। ওখানে আমিই চিকিৎসা করব।
কাল সকালে ভর্তি করার কথা বলে রিয়াজুল মোসারেফ হোসেনকে নিয়ে বাসায় ফিরে মা-বাবাকে ডাক্তারের কথা বলল।
একসময় মুনসুর আলি ও জাহেদা রিয়াজুলকে বললেন, ক্লিনিকে রেখে চিকিৎসা করালে অনেক টাকা লাগবে। তুই তো আমাদের অবস্থা জানিস, এত টাকা পাব কোথায়?
টাকার চিন্তা তোমরা করো না। তারপর ছোট চাচা ও বড় চাচার কাছ থেকে পঁচিশ বছরের ফসল বিক্রির টাকা পাওয়ার কথা বলল।
জাহেদা বলল, আল্লাহ অনেক বড় দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচালেন। সে জন্যে তাঁর পাক দরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া।
মোসারেফ হোসেনের ঠিকমতো চিকিৎসা না হওয়ার কারণে যতটা না পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন, সংসারের দুরাবস্থা ও দু’টো সেয়ানা মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় আরো বেশি পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন। রিয়াজুলকে পেয়ে সেই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পান। তারপর ঢাকায় এসে ক্লিনিকে ঠিকমতো চিকিৎসা ও ভালোমন্দ খাওয়ার ফলে পনের বিশ দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে চলাফেরা করতে পারছেন।
একদিন রিয়াজুলকে বললেন, বাবা, এবার গ্রামে যেতে চাই। এখানে আর মন টিকছে না।
রিয়াজুলকে বলল, আরো কিছুদিন থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তারপর যাবেন।
মোসারেফ হোসেন জানতে পেরেছেন, ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা করাতে এ পর্যন্ত পঁচিশ ত্রিশ হাজার টাকা বিল হয়েছে। তাই নিজেই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা রিয়াজুলকে বার বার বলতে লাগলেন।
রিয়াজুল বলল, ঠিক আছে, আমি, ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখি, উনি যা বলবেন তাই করব। তারপর ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে রুগীর বাড়ি যাওয়ার কথা বললেন।
ডাক্তার বললেন, এবার নিয়ে যেতে পারেন। তবে ওষুধ অনেক দিন খেতে হবে। আর গ্রামে তো ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের যন্ত্রপাতি নেই, আমরা ফ্রি হ্যাঁন্ড কিছু পদ্ধতি দেখিয়ে দেব। সেগুলো প্রতিদিন অনুশীলন করলে আশা করি দু’এক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে কোনো পরিশ্রমের কাজ আর কখনো যেন না করেন। আর মানসিক টেনশন ও দুশ্চিন্তা করতে একদম নিষেধ করে দেবেন। তা নাহলে আবার সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যাবেন।
রিয়াজুল বলল, অনুগ্রহ করে আপনি নিজে ওঁকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন।
ছাব্বিশ দিন ক্লিনিকে থেকে মোসারেফ হোসেনকে রিয়াজুল বাসায় নিয়ে এল।
জাহেদা ও মনসুর আলি মাঝে মাঝে ক্লিনিকে গিয়ে ওঁকে দেখে এসেছেন। মোসারেফ হোসেন গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বললে মনসুর আলি বললেন, ঢাকায় এসে ক্লিনিকে প্রায় একমাস রইলেন। এবার আমাদের বাসায় কয়েকদিন বেড়ান, তারপর যাবেন।
মোসারেফ হোসেন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আপনারা আমার জন্য যা কিছু করলেন, তার ঋণ আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারব না। আল্লাহ তার জাজাহ আপনাদেরকে নিশ্চয় দেবেন।
আসমাকে দেখে ও তার আচার ব্যবহারে জাহেদা ও মনসুর আলি খুব সন্তুষ্ট। একদিন রাতে ঘুমাবার আগে আসমাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলাপ হওয়ার সময় জাহেদা বললেন, আসমাকে বৌ করলে কেমন হয়?
মুনসুর আলি বললেন, আমার মনের কথা বলেছ, রিয়াজুলের মতামত জানার জন্য তোমাকে বলব ভাবছিলাম। ওর মতামতটা জানতে পারলে ভাল হত।
আমার ধারণা রিয়াজুল না করবে না।
ধারণাটা ভুলও হতে পারে?
না, হতে পারে না, তুমি কী মনে কর, রিয়াজুল শুধু শুধুই তার বাবার বন্ধুকে সাহায্য করছে?
ওর মত ছেলের এটা করাই স্বাভাবিক।
তোমার সঙ্গে আমিও একমত। তবে এর মধ্যে আসমার মতো মেয়েকে পাওয়ার আশা করাটা কী অস্বাভাবিক কিছু?
না তা নয়, তবু তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো। তবে আমার মনে হয়, সবার আগে মোসারেফ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করা উচিত।