তুই চিনবি কি করে? তোর জন্মের অনেক আগে সালাউদ্দিন মিয়া মারা গেছেন। তখন তার স্ত্রীর পেটে বাচ্চা ছিল। দু’বছরের ছেলেকে বড় বোনের হাতে দিয়ে তিনি মারা গেছেন। বড় ভালো ছিলেন সালাউদ্দিন মিয়া। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। প্রায় আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাকেও অনেকবার তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। আল্লাহর কি কুদরত, তারই ছেলের দ্বারা আজ তোকে বিপদ থেকে উদ্ধার করালেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি না কেন?
আসমা বলল, আসতে বলেছিলাম, উনি বললেন পরে এক সময় আসবেন।
তারপর থেকে সবসময় ছেলেটার কথা আসমার মনে পড়েছে। এখন সালেহার কথা শুনে বলল, উনি কোথায়?
সালেহা বলল, উনি পুকুর পাড়ে ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
আসমা গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে উঠোন পার হয়ে রিয়াজুলকে দেখতে পেল। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর বলল, গ্রাম দেখতে। বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম।
আসুন বলে আসমা এগোল।
তার পিছু নিল।
আসমা তাকে ঘরে নিয়ে এসে আব্বাকে বলল, গতকাল ইনি আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
মোসারেফ হোসেন শুয়েছিলেন। নিজে উঠে বসতে পারেন না। রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, বাপের মতো হয়েছে।
রিয়াজুল সালাম দিল।
মোসারেফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে ধরে একটু বসা তো মা।
আসমার আগে রিয়াজুল এগিয়ে এসে তাকে ধরে বসাল।
আসমা দু’টো বালিশ পিঠের দিকে ঠেস দিয়ে রিয়াজুলকে বলল, আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন।
রিয়াজুল বসার পর মোসারেফ হোসেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কি বাবা?
রিয়াজুল।
তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করনি তো?
না-না, মনে করব কেন? আমি তো আপনার ছেলের বয়সি।
হাঁ বাবা, আমার ইলিয়াস তোমার বয়সিই হবে। তিন বছর হল আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। কথা শেষ করে চোখ মুছলেন।
রিয়াজুল বলল, কাঁদবেন না চাচা, হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। সবর করুন। আল্লাহ যা কিছু করেন বান্দাদের ভালর জন্য করেন।
চোখ মুছে মোসারেফ হোসেন বললেন, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক কথা বলেছ। সবর করেই আছি। তোমাকে দেখে ও তোমার কথা শুনে ইলিয়াসের কথা মনে পড়ে গেল। জান বাবা, তোমার আব্বার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। তার মতো ভালো লোক পাঁচ সাতটা গ্রামে ছিল না। আসমা যে ওর মামাদের বাড়ি গিয়েছিল আমি জানতাম না। ফিরে এসে বিপদের কথা জানিয়ে যখন বলল, তুমি তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছ তখন তোমার জন্য অনেক দোয়া করেছি। আল্লাহ তোমার হায়াৎ দারাজ করুন। তোমাকে সুখি করুন।
রিয়াজুল বলল, আপনার অসুখের কথা কাল আসমার কাছে কিছু শুনেছিলাম। রাত্রে ছোট চাচার কাছে সব শুনেছি। আপনি নাকি আগে কথাও বলতে পারতেন না। আল্লাহর রহমতে এখন তো পারছেন। আমার মনে হয় শহরে নিয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। এখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন না?
হ্যাঁ বাবা করাচ্ছি। তবে….. বলে থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আসমাকে বললেন, রিয়াজুলকে চা করে দে। শহরের ছেলে চা খাওয়া অভ্যাস। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আমার বন্ধুর ছেলে। তুমি এসেছ, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। আল্লাহ আমাকে…..। কথাটা শেষ করতে পারলেন না। কান্নায় গলা বুজে এল। ঠোঁট চেপে সামলাবার চেষ্টা করলেন।
রিয়াজুল বলল, হাদিসে পড়েছি, পিতার বন্ধু পিতার সমান। পিতার মতো তাকে। সম্মান করবে। হাদিস মোতাবেক আমি আপনার ছেলের মতো। আপনার অপারগতার কথা আমি জানি। ছেলে হিসাবে বলছি, আপনি বিচলিত হবেন না। আল্লাহ যেমন দিনের পর রাত্রি রেখেছেন, তেমনি সুখের পর দুঃখ ও দুঃখের পর সুখও রেখেছেন। রাত্রের অন্ধকার যেমন এক সময় দূর হয়ে দিনের আলো ফুটে উঠে তেমনি দুঃখের রজনী একসময় দূর হয়ে সুখের আলো ফুটে উঠবে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের নানা রকম দুঃখ কষ্ট ও বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। কোরআন পাকে আছে, আর আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করিব কিঞ্চিৎ ভয় দ্বারা। আর উপবাস দ্বারা এবং ধনের ও প্রাণের ও ফল-শষ্যের স্বল্পতা দ্বারা। আর সুসংবাদ শুনাইয়া দিল এমন ধৈর্যশীলদিগকে যখন তাহাদের উপর মুসিবত আসে তখন বলে, আমরা তো আল্লাহরই আয়ত্তে আর আমরা সকলে আল্লাহরই সমীপে প্রত্যাবর্তনকারী। আপনি সবর করুন। যে বান্দা দুঃখ কষ্টে ও বিপদে পড়ে সবর করেন, আল্লাহ তাকে খুব ভালবাসেন। তার দুঃখ কষ্ট ও বিপদ দূর করে দেন।
তুমি খুব দামি কথা বলেছ বাবা। তোমার আব্বার কাছে আমি কোরআন হাদিসের অনেক জ্ঞান পেয়েছি। তার কাছ থেকে ঐসবের বাংলা তরজমা নিয়ে অনেক পড়েছি। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করে আছি। শুধু মেয়ে দুটোর জন্য খুব চিন্তা হয়। আসমার বিয়ের বয়স হয়েছে। কতদিন তাকে আর ঘরে রাখব। সালেহাও ডাগর হয়ে উঠেছে। অভাবের কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছি। আসমা দু’বেলা কয়েকটা ছেলে-মেয়েকে প্রাইভেট পড়িয়ে ছোট ভাইকে এখনো পড়াচ্ছে। সব দিন চুলোও জ্বলে না। বাপ হয়ে শুয়ে শুয়ে এইসব দেখতে হচ্ছে। আড়াই বিঘা জমি বেচে বড় ছেলেকে কুয়েত পাঠিয়েছিলাম। তারপর আরো আড়াই বিঘা জমি বেচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছি। বাস্তু আর পুকুরটা ছাড়া কিছু নেই। পুকুরটা বেচেই দিতাম, যদি পুকুর ব্যবহার করতে না দেয়, তা হলে আমরা যাব কোথায় ভেবে বেচিনি। এমন সময় আসমাকে চা হাতে আসতে দেখে চুপ করে গেলেন।