স্যার, কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রাকিব কানাডায় দিন পনের ছিল। যেদিন ফিরবে তার আগের দিন রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। খবরটা আমি অনেক আগেই জেনেছি। আপনারা খুব দুঃখ পাবেন ভেবে এতদিন বলি নি।
রাকিব ছ’মাস আগে মারা গেছে শুনে আযীয মাস্টারের মনে হল কেউ যেন তাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে চোখের পানি ফেললেন। তারপর একসময় চোখ-মুখে কান্না জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান, সাবেরার পেটে রাকিবের সন্তান এসেছে?
জি, জানি। রাকিব কানাডা থেকে একটি চিঠিতে ফিরে আসার ও সাবেরার পেটে বাচ্চা আসার কথা লিখে জানিয়েছিল।
খবরটা শুনে সাবেরার কি অবস্থা হবে আল্লাহ মালুম। তারপর ফিরে আসার সময় আযীয মাস্টার ভাবতে লাগলেন, সাবেরার শরীরের যে অবস্থা, রাকিবের মৃত্যুর খবর শুনে না হার্টফেল করে। তবু তাকে জানানো উচিত ভেবে ঘরে এসে স্ত্রী ও মেয়েকে রাকিব মারা যাওয়ার খবরটা জানালেন।
শুনে মাসুদা বিবি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আল্লাহগো, আমার মেয়ের তকদিরে এই লিখেছিলে? ও কি করে বাকি জীবন কাটাবে?
আর সাবেরা খবরটা শুনে পাথরের মতো জমে গেল। কোনো কান্নাকাটি বা হা-হুঁতাশ করল না। তারপর যথাসময়ে সে মেয়ের জন্ম দিল, সেই মেয়ে রিজিয়া। রিজিয়ার বয়স যখন এক বছর তখন সাবেরা রোগে ভুগে মারা গেল। দাদি মাসুদা বিবি নাতনিকে মায়ের স্নেহ দিয়ে মানুষ করতে লাগলেন। বছর দুয়েক পর একদিন স্বামীকে বললেন, রিজিয়াকে ওর দাদা-দাদির কাছে দিয়ে এস। তারা ওকে লেখাপড়া করিয়ে বড় ঘরে বিয়ে দেবে।
আযীয মাস্টার বললেন, তুমি তো জান, রাকিব মা-বাবাকে না জানিয়ে সাবেরাকে বিয়ে করেছিল, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয়ও নেই। তারা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বরং ঠকবাজ লোক ভেবে অপমান করে তাড়িয়ে দেবে।
কিন্তু রিজিয়া বড় হয়ে যখন তার বাবার কথা জানতে চাইবে তখন কী বলবে?
তখন তাকে সত্য ঘটনা বলব।
আর সে যখন বলবে ছোটবেলায় আমাকে দাদা-দাদির কাছে দিয়ে এলে কেন, তখন কী বলবে?
আযীয মাস্টার স্ত্রীর কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইলেন।
মাসুদা বিবি বললেন, আমার কথা শোন, শিহাব তো সব কিছু জানে। তার কথা রিজিয়ার দাদা-দাদি অবিশ্বাস করতে পারবে না। যাওয়ার সময় তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। যা বলার শিহাবকেই বলতে বলবে।
আযীয মাস্টার বললেন, ঠিক আছে, শিহাবকে বলে দেখি সে কি বলে?
একদিন শিহাবের সঙ্গে দেখা করে আযীয মাস্টার স্ত্রীর কথাগুলো বলে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে তুমি কি বল?
শিহাব বলল, চাচি আম্মা অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। আমার মনে হয় তাই করা উচিত। কিন্তু রাকিবের মা-বাবা আমার কথা বিশ্বাস করলেও তা প্রকাশ করবেন না আর রিজিয়াকেও গ্রহণ করবেন না। বরং আমাকে ও আপনাকে যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন।
আযীয মাস্টার বললেন, আমারও তাই ধারণা। কিন্তু তোমার চাচি আম্মা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে রিজিয়াকে দিয়ে আসতে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে।
শিহাব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, যদিও মনে হচ্ছে গিয়ে কোন কাজ হবে, তবু চাচি আম্মার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য যাব। কবে যেতে চান?
শুক্রবার স্কুল বন্ধ। ঐ দিন গেলে ভালো হয়।
বেশ, তাই যাওয়া যাবে। আপনি সকালে রিজিয়াকে নিয়ে তৈরি থাকবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।
শুক্রবার দিন শিহাব ওদেরকে নিয়ে ঢাকায় এসে প্রথমে একটা হোটেলে উঠল। তারপর বিকেলে রাকিবদের বাসায় গেল।
রাকিবের বাবা জাহিদ হাসান স্ত্রী, বড় ছেলে ও ছেলের বৌ এবং আট বছরের বড় নাতি হিমুকে নিয়ে বারান্দায় বসে চা-নাস্তা করছিলেন। এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, ছোট ভাইয়ের বন্ধু শিহাব ভাই এসেছেন। তার সঙ্গে একজন বুড়ো লোক ও দু’বছরের একটা মেয়েও আছে।
শিহাব ভার্সিটিতে পড়ার সময় রাকিবদের বাসায় অনেক বার এসেছে। তাই দারোয়ান থেকে বাসার সবাই তাকে চেনে। রাকিব কানাডা যাওয়ার মাস খানেক পরে শিহাব একদিন বাসায় এসেছিল। সে সময় রাকিবের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিল। তারপর আর আসে নি।
প্রায় আড়াই বছর পর শিহাব এসেছে জেনে তারা একটু অবাক হলেও খুশি হলেন। কেউ কিছু বলার আগে জাহিদ হাসান বললেন, ওদেরকে ড্রইংরুমে বসাও, আমরা আসছি।
একটু পরে সবাই ড্রইংরুমে এলেন।
শিহাব দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল।
জাহিদ হাসান তাদেরকে বসতে বললেন। বসার পর আযীয মাস্টারকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?
শিহাব বলল, আমাদের গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। মেয়েটা ওনার নাতনি, আর রাকিবের মেয়ে।
তার কথা শুনে ঘরের সবাই খুব অবাক হয়ে একবার রিজিয়ার দিকে আর একবার আযীয মাস্টারের দিকে তাকাতে লাগলেন। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
জাহিদ হাসান অবাক হলেও শিহাবের ওপর খুব রেগে গেলেন। রাগটা সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি রাকিবের বন্ধু না হলে এতক্ষণে তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। যা বলার বলেছ, আর একটা কথা নয়। এক্ষুনি ওদেরকে নিয়ে চলে যাও।
শিহাব বলল, আপনারা বিশ্বাস না করলেও কথাটা সত্য। আর সত্য প্রকাশ করতে কোনো মানুষেরই ভয় পাওয়া উচিত নয়। মেয়েটা যে রাকিবের এবং তিন বছর আগে আমার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে রাকিব যে এই আযীয স্যারের মেয়েকে বিয়ে করেছিল, সে কথা আমাদের গ্রামের ও পাশের গ্রামের শত শত লোক জানে। তারপর রাকিব কিভাবে বিয়ে করল, সে সব বলে বলল, আপনারা আমাদের গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিলেই সত্য-মিথ্যা প্রমাণ পেয়ে যাবেন।