আমি কখনো সিনেমা দেখি নি, সস্তা না দামি জানব কী করে? ওসব কথা বলে যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিন।
সে কথা পরে বলছি, গল্পটা আগে শেষ কর।
এবার হিমু নিজেকে নায়ক ও রিজিয়াকে নায়িকা করে তাদের সম্পর্কের কথা ও নায়কের বাবা-মার অমতের কারণ এবং নায়কের সিদ্ধান্তের কথা বলে বলল, গল্পের আর একটা অংশ বাদ পড়ে গেছে। বলছি শুনুন, দু’বছরের নায়িকাকে দাদা-দাদির কাছে দেয়ার ঘটনার সময় তার বড় চাচার আট বছরের ছেলেও সেখানে ছিল। ছেলেটার মনে তখন রিজিয়ার প্রতি সহানুভূতি জাগে এবং ঘটনাটা গভীরভাবে মনে দাগ কাটে। বড় হওয়ার পরও সেই দাগ মুছে যায় নি। বরং আরো বাড়ে। ঘটনাচক্রে নায়ক তার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে যে মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই মেয়েই হল এই গল্পের নায়িকা। আর নায়ক হল নায়িকার বড় চাচার ছেলে। এবার বলুন কিভাবে তাদের মিল দেব?
গল্পের প্রথম অংশ শুনে জাহিদ হাসানের যে ধারণা হয়েছিল, শেষের অংশ শুনে সেই ধারণা আরো দৃঢ় হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি গল্পের প্রথম অংশ বলার পর যে প্রশ্ন করেছিলে তার উত্তরে বলব, নায়িকার দাদা ও বড় চাচার উচিত ছিল সত্য-মিথ্যা যাচাই করা এবং ঘটনা সত্য হলে নায়িকাকে গ্রহণ করা। আর গল্পের নায়ক-নায়িকার মিল দিতে হলে প্রথমে নায়ককে জানতে হবে নায়িকা তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না। যদি রাজি থাকে, তা হলে নায়ক মা-বাবার অমতের কথা ও তার কারণ জানিয়ে গোপনে বিয়ে করার কথা বলবে। সব কিছু জানার পরও নায়িকা রাজি থাকলে কাজি অফিসে বিয়ে দিয়ে গল্পটা শেষ করবে।
হিমু বলল, বিয়ে দিয়ে শেষ করলে গল্পটা সম্পূর্ণ হবে না। কারণ ছেলের বৌকে নায়কের মা-বাবা গ্রহণ করবে কি না, না করলে নতুন বৌকে নিয়ে নায়ক কি করবে? কোথায় তুলবে? এসব প্রশ্ন পাঠকদের মনে জাগবেই। তখন তারা লেখককে যা তা বলবে।
জাহিদ হোসেন মৃদু হেসে বললেন, আরে ভাই, আমি তো আর লেখক নই, এসব বলব কি করে? তুমি যখন গল্পটার লেখক তখন তোমাকেই গল্পের শেষটা লিখতে হবে। আমার তো মনে হচ্ছে, গল্পটা কারো কাছে শুনে লিখেছ। তার কাছেও জিজ্ঞেস করতে পার। আমার অনুমান সত্য কি না বল?
আপনি জানেন কি না জানি না, লেখকরা কিন্তু কোনো বাস্তব ঘটনা দেখে-পড়ে অথবা শুনে গল্প বা উপন্যাস লেখেন। অবশ্য সেটাকে পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয় ও সুখপাঠ্য করার জন্য কল্পনার আশ্রয় নেন।
একজন ডাক্তার হয়ে তুমি লেখকদের এসব কথা জানলে কি করে?
আমার একজন বন্ধু আছেন, তিনি গল্প উপন্যাস লেখেন, তার কাছে। শুনেছিলাম। ইদানীং কিছু গল্প উপন্যাস পড়ে বন্ধুর কথাই ঠিক মনে হয়েছে।
নাতির শেষের দিকের কথা জাহিদ হাসানের কানে গেল না। তখন তিনি চিন্তা করছেন, বিশ বছর আগের ঘটনা। শিহাবের কথা বিশ্বাস করলেও আভিজাত্যের অহঙ্কারে অস্বীকার করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও বেশ কিছু টাকা আযীয মাস্টারকে দিতে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য নাতনিকে গ্রহণ না করে যে অন্যায় করেছিলেন, সে জন্য অনুশোচনা হয়েছিল। এখন নাতির পুরো গল্প শুনে নিশ্চিত হলেন, সেই নাতনিই নায়িকা এবং নায়ক নাতি হিমু।
নিশ্চিত হয়ে জাহিদ হাসান এত আনন্দিত হলেন যে, অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে সেই আনন্দের জোস সামলাবার চেষ্টা করলেন। তবু একসময় বন্ধ চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
দাদুর অবস্থা দেখে হিমু বুঝতে পারল, সে সময় আভিজাত্যের অহঙ্কারে যে অন্যায় করেছিলেন, এখন অনুশোচনার আগুন নেভাবার চেষ্টা করছেন চোখের পানি ফেলে। তবু জিজ্ঞেস করল, গল্পটা শুনে, আপনার চোখে পানি কেন?
জাহিদ হাসান নাতিকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, সত্যি করে বল, এই গল্পের নায়ক তুই আর নায়িকা তোর ছোট চাচার মেয়ে?
হিমু বলল, হ্যাঁ দাদু, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন।
জানিস দাদু, সেদিন তোর ছোট চাচার মেয়েকে ও শ্বশুরকে ফিরিয়ে দিয়ে যে অন্যায় করেছিলাম, তার মাশুল আজও দিতে হচ্ছে। তুই কোনো চিন্তা করবি না। তোর মা-বাবা যতই অমত করুক না কেন নায়িকাকে নাতবৌ করে আনবই আনব। নায়িকার নামটা কি বলত ভাই।
রিজিয়া।
ওটা নিশ্চয় ডাক নাম, পুরো নাম জানিস না?
না।
শোন, ডাক নামটাই যদি পুরো নাম হয়, তা হলে বিয়ের সময় নাম দেব সুলতানা রিজিয়া। ইতিহাসে একজন বিখ্যাত মহীয়সীর নাম ছিল সুলতানা রিজিয়া। বলত তিনি কে?
আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি ইতিহাসের কথা জানব কি করে?
উনিই প্রথম নারী, যিনি দিল্লির সিংহাসনে বসে দেশ শাসন করতেন। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে সৈনিকের পোষাক পরে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যও পরিচালনা করতেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কবে তার সঙ্গে দেখা করাবি বল। দেখার জন্য খুব অস্থিরতা অনুভব করছি।
বাসায় আনা যাবে না। মা চিনে ফেলবে। তাই ওর সঙ্গে আলাপ করে আপনাকে জানাব।
তোর ছোট চাচার বন্ধু শিহাব নিজের বাসায় রেখে রিজিয়াকে পড়াচ্ছে, তাই না?
জি।
শিহাবের বাসা চিনিস তা হলে?
জি, চিনি।
জাহিদ হাসান চিন্তিত মুখে বললেন, রিজিয়াকে দেখতে শিহাবের বাসায়ও যেতে পারব না, অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করবি।
দাদু কেন শিহাব চাচার বাসায় যেতে চান না, তা বুঝতে পেরে হিমু বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করব।