তিনজনকে অজ্ঞান করে শফি যখন রাহেলার কাছে এল তখন রাহেলা কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারল না। শুধু ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে থেমে গেল। তবে একইভাবে তার দিকে চেয়ে থেকে চোখের। পানি ফেলতে লাগল। তার মনে হল স্বপ্ন দেখছে। কয়েকদিন আগে বাবার মুখে কীভাবে লেঠেল সর্দার মোবারকের একটা হাত ভেঙ্গে দিয়ে এবং যেসব কথা বলে পুরস্কারের দশ হাজার টাকা তাকে দিয়েছে, সেসব শুনে খুব অবাক হয়ে ভেবেছে, শফি মানুষ না ফেরেশতা। আজ আবার তিনজনকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মেরে অজ্ঞান করতে দেখে দৃঢ় বিশ্বাস হল, সত্যিই শফি মানুষ না ফেরেশতা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাহেলা এসব ভাবছিল।
রাহেলার কাপড়ের অবস্থা দেখে শফি নিজের পাঞ্জাবী খুলে তার কাঁধে রেখে বলল, এটা পরে ওড়না গায়ে জড়ান। কথা শেষ করে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আর ভয় নেই। আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই বলে হাঁটতে শুরু করল।
তার কথা শুনে রাহেলা তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে সারা শরীরে ওড়না জড়িয়ে তার পিছু নিল। একটু দ্রুত হেঁটে এসে পাশাপাশি যেতে যেতে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আপনি এসে না পড়লে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না। এই কথা বলে যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শফি জানে কাঁদলে মানুষের মন কিছু হালকা হয়। তাই কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বলল, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। ভাগ্যে যা থাকবে তা কেউ রোধ করতে পারবে না। তবে মানুষ যদি সাবধান হয়ে ও চিন্তা ভাবনা করে কাজ করে, তা হলে অনেক বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দ.) মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে বেরোবার সময় পর্দা করে বেরোতে বলেছেন। আজকাল মুসলমান ঘরের মেয়েরা জেনে ও না জেনে বিধর্মীদের মতো বেপর্দা হয়ে পথে ঘাটে চলাফেরা করছে। তাইতো এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে।
ততক্ষণে তারা বড় রাস্তায় হুন্ডার কাছে চলে এল। বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে দেখে শফি সেগুলো কুড়িয়ে রাহেলার হাতে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, ওদের আপনি চেনেন?
রাহেলা বলল, কালো কুচকুচে ছেলেটা এম.পি. বশির মোল্লার ছেলে। বাকি দু’জনকে চিনি না।
শফি আর কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
ঘরের কাছে এসে রাহেলা বলল, আপনি বৈঠকখানায় একটু বসুন, আমি আসছি। তারপর ঘরে ঢুকে মায়ের সামনে পড়ে গেল।
মেয়ের অবস্থা দেখে আখতার বানু আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কী হয়েছে?
রাহেলা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
আখতার বানু মেয়েকে কখনও কোনো ব্যাপারেই কাঁদতে দেখেন নি। বড় শক্ত মেয়ে তার। সেই মেয়েকে কাঁদতে দেখে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে বললেন, কাঁদছিস কেন কি হয়েছে বলবি তো?
রাহেলা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা ঘরে নেই?
আখতার বানু বললেন, না, একটু আগে বেরিয়ে গেল। কী হয়েছে বলছিস না কেন?
সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে রাহেলা বলল, চরদৌলতখানের যে ছেলেটাকে বাবা মোবারক লেঠেলের দ্বারা মেরে হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল। সেই ছেলেটাই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে নিয়ে এসেছে। তারপর ওড়না সরিয়ে পাঞ্জাবীটা দেখিয়ে বলল, এটা ঐ ছেলেটার। তারপর কান্না জড়িতস্বরে বলল, ঠিক সময় মতো যদি ছেলেটা এসে না পড়ত, তা হলে বদমাসগুলো আমার ইজ্জৎ লুটে নিয়ে এসিড দিয়ে আমার মুখ পুড়িয়ে দিত।
আখতার বানু খুব অবাক হয়ে ভয়ার্তস্বরে বললেন, কী সর্বনাশের কথা, ছেলেগুলোকে চিনিস?
মাকে ছেড়ে দিয়ে রাহেলা বলল, একজনকে চিনি। সে কালকিনির এম.পির ছেলে জুলহাস। তার বাবা নাকি আমাকে ছেলের বৌ করার জন্য ঘটককে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন?
আখতার বানু বললেন, হ্যাঁ, কয়েকদিন আগে তোর বাবার মুখে শুনেছি। সে তো না করে দিয়েছে।
রাহেলা বলল, কই, আমাকে তো তোমরা কিছু জানাওনি।
আখতার বানু বললেন, তোর বাবা হয়তো তোকে জানাবার দরকার মনে করেনি। অথবা না করে দিয়েছে বলেও হয়তো জানাইনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সেই ছেলেটা চলে গেছে।
রাহেলা বলল, যাহ্, ওনার কথা ভুলেই গেছি। বৈঠকখানায় বসতে বলেছিলাম। তুমি ওনার নাস্তার ব্যবস্থা কর বলে নিজের রুমে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টাল। তারপর শফির পাঞ্জাবী একটা খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, কাজের বুয়াকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দাও। আমি। বৈঠখানায় যাচ্ছি।
রাহেলা বৈঠকখানায় এসে শফিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল, সরি, অনেক দেরি করে ফেললাম, সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। তারপর কাগজে মোড়া পাঞ্জাবীটা ফেরত দিয়ে বলল, আর একটু বসুন নাস্তা খেয়ে যাবেন।
শফি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আজ আর দেরি করতে পারব না। আবার যেদিন আসব সেদিন খাব। একটা অনুরোধ করছি, বোরখা পরে কলেজে যাবেন আর একা যাবেন না, সঙ্গে একজনকে নেবেন। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে সেখান থেকে চলে এল।
রাহেলা তার দিকে চেয়ে চিন্তা করল, ঐ একহারা ছেলেটার গায়ে এত শক্তি প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করতাম না। শফি আড়াল হয়ে যাওয়ার পরও কতক্ষণ সেদিকে চেয়েছিল খেয়াল নেই। কাজের বুয়া নাস্তা নিয়ে এসে যখন বলল, আপা, মেহমান কই? তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, মেহমান চলে গেছেন, এগুলো নিয়ে যাও।