শফি বলল, হ্যাঁ দাদি। ওনার হাত ভাঙ্গার ইচ্ছা ছিল না, তবু ভেঙ্গেছি ভবিষ্যতে উনি যেন আর কখনও লেঠেলী করতে না পারেন। তারপর বলল, এ ব্যাপারে পরে আলাপ করব। এখন আপনি নাস্তা রেডি করুন। আমি গোসল করে আসি বলে লুংগী গামছা নিয়ে পুকুরের দিকে চলে গেল। শফি ফিরে আসার পর তার কাজ-কর্ম ও আচার-ব্যবহারে গ্রামের ছোট বড় সবাই শ্ৰেণীমতো তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আজ লাঠিখেলা প্রতিযোগীতার, ঘটনায় তার প্রতি সবাইয়ের ভক্তি শ্রদ্ধা আরও অনেক বেড়ে গেছে। শফি মসজিদে নামায পড়তে যাবার পথে সবার মুখে তার গুণাগুণ শুনে মনে মনে আল্লাহকে জানাল, কখন কোনো ব্যাপারেই যেন তার মনে অহংকার না আসে। অহংকার থেকে তাকে হেফাজত করো।
.
মাতব্বর সাহেব বৈঠকখানায় বসেছিলেন। শফিকে দেখে বললেন, এস ভাই বস, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
শফি সালাম বিনিময় করে বসে বলল, কী যেন আলাপ করার জন্য ডেকেছিলেন?
মাতব্বর বললেন, তোমার চাচা জাকির হোসেনকে তুমি কী করবে না করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, তুমি না কী ঢাকায় চাকরি করবে। কথাটা কি সত্য?
শফি বলল সত্য মিথ্যা দু’টোই।
ব্যাপারটা বুঝলাম না।
বললেই বুঝবেন। শুনুন, কথাটা বলেছি সত্য; কিন্তু ওনার মন বোঝার জন্য মিথ্যে করে বলেছি।
মাতব্বর হেসে উঠে বললেন, তুমি খুব জিনিয়াস জেনেছি; কিন্তু এতটা জিনিয়াস বুঝতে পারিনি। তারপরই বললেন, কেন ডেকেছি শোন-তোমার নানাবাড়ি তো নলছটি, আমার নানার বাড়িও নলছটি। তুমি বোধ হয় জান না ওখানে একটা কামিল মাদ্রাসা আছে। যাই হোক, আমার নানার কোনো ছেলে সন্তান ছিল না, শুধু দু’টো মেয়ে ছিল। বড় মেয়ে মারা যায়। আমার মা ছোট। নানার অনেক বিষয় সম্পত্তি ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর মা সব সম্পত্তির মালিক হয়। মায়ের কথা মতো বাবা কারিগরী শিক্ষাসহ একটা কামিল মাদ্রাসা করে সব সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেন। তখন বাবা ছিলেন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির প্রেসিডেন্ট। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কমিটি আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছে। আগে ওয়াকফ করা সম্পত্তির আয়ে মাদ্রাসার যাবতীয় খরচ চলত। এখন সরকারের অণুদান। পায়। মাদ্রাসায় যিনি প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন। বর্তমানে ভাইস প্রিন্সিপাল প্রিন্সিপালের কাজ করছেন। আমি চাই তোমাকে প্রিন্সিপাল করতে।
শফি বলল, শুধু আপনি চাইলে তো হবে না কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরও তো চাইতে হবে।
মাতব্বর বললেন, তা তো বটেই। তবে আমার বিশ্বাস আমি যাকে পছন্দ করব, তাকে কমিটি না রেখে পারবে না। কয়েকদিন আগে-ঐ পদের জন্য দু’তিনটি কাগজে বিজ্ঞপ্তী দেয়া হয়েছে। আমি চাই তুমিও একটা দরখাস্ত নিজে গিয়ে ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে দিয়ে এস। আমি একটা চিঠি লিখে দেব, সেটাও ওনাকে দিবে।
শফি বলল, ঠিক আছে দাদু, চিন্তা করে আপনাকে জানাব।
মাতব্বর বললেন, চিন্তা করতে চাও কর, তবে আমি বলব, কোথাও অন্য কিছু করার চেয়ে এখানে থেকে এটা করা অনেক ভালো। কারণ গ্রামের গরিব ও অশিক্ষিত লোকজন তোমার কাছ থেকে অনেক উপকার পাবে। তুমি যে শুধু সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত তাই নও, ধার্মিক ও আদর্শবান ছেলে। গ্রামের লোকজন ধর্ম সম্পর্কে একরকম কিছুই জানে না। যারা জানে তারা সার্থের জন্য ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করছে। আর একশ্রেণীর লোক মডার্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রগতির নাম দিয়ে ধর্মকে এড়িয়ে চলছে। তা ছাড়া ধর্মের নামে অনেক কুসংস্কার ও রীতিনীতি প্রচলিত রয়েছে। তুমি সেসব সমাজ থেকে দূর করতে পারবে। এতকিছু জানার পরও আর কিছু চিন্তা করার আছে?
শফি বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমি দু’একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে আপনার কাছে আসব। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
০৯. কালকিনির বসির মোল্লা
কালকিনির বসির মোল্লা এ বছর ইলেকসনে জিতে এম.পি. হয়েছেন। ওনার একমাত্র ছেলে জুলহাস গত বছর বি.এ. পাশ করে মাস্তানী করে বেড়াচ্ছিল। এ বছর বাবা এম.পি. হবার পর মাস্তানী আরও বেড়ে গেছে। দু’জন বন্ধুকে হুডায় নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বাজারে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। স্কুল কলেজের সেয়ানা মেয়েদের দেখলে টিজ করে। হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করার প্রস্তাব দেয়। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটাইনি।
একদিন সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলা যখন কলেজ থেকে ফিরছিল তখন জুলহাস তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পথ আগলে তার নাম ও পরিচয় জিজ্ঞেস করল।
অনেকের গায়ের রং কালো হলেও মুখের চেহারা ভালো হয়; কিন্তু জুলহাসের গায়ের রং যেমন কালো, মুখের চেহারাও তেমনি কুতসিৎ। তাই তাকে দেখে রাহেলা চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, আপনি কে যে, নাম পরিচয় বলতে হবে?
জুলহাস ঘেঁতো হাসি হেসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, এবার আপনারটা নিশ্চয় বলবেন?
তাদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য রাহেলা নাম পরিচয় বলে হাঁটতে শুরু করল।
জুলহাস তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে নিতম্বের উত্থান পতন দেখতে দেখতে বন্ধুদের বলল, এই মেয়েকে বিয়ে করতেই হবে। তারপর ঘরে এসে মাকে রাহেলার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তুমি বাবাকে ব্যবস্থা করতে বল।