মোবারক শফিকে দেখে ও তার পরিচয় জেনে ভাবল, এই পিচ্ছি। ছোঁড়াটাকে ঘায়েল করতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। চেয়ারম্যান সাহেব একেই তুখোড় ছেলে বলেছেন। তিন চার মিনিটের মধ্যে ওর হাতপা ভেঙ্গে না দিয়েছি তো আমি আমার বাপের জন্মই না।
হাজার হাজার লোক এই অসম লড়াই দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রইল।
রেফারী হুইসেল বাজাতে খেলা শুরু হল। প্রথম চান্সেই শফিকে ঘায়েল করার জন্য মোবারক তার উপর আক্রমনাত্মক খেলা চালাল।
শফি আক্রমণ ঠেকাতে লাগল; কিন্তু প্রতি আক্রমণ করল না। সে চাচ্ছে মোবারক হাঁপিয়ে যাক, তারপর আক্রমণ করবে। তাই প্রায় দশ পনের মিনিট খেলা চলার পর শফি আক্রমণ শুরু করল। তবে ততো জোরাল নয়। কারণ মোবারক বুঝুক সে তত শক্তিশালী নয় এবং আক্রমণ করার কলাকৌশলও জানে না। ফলে এর মধ্যে মোবারকের বেশ কয়েকটা আঘাত তাকে হজম করতে হয়েছে। আরও পাঁচ মিনিট পর যখন শফি বুঝতে পারল মোবারক হাঁপিয়ে পড়েছে তখন শক্তভাবে আক্রমণ না করে লাঠিটা শুধু বনবন করে ঘুরাতে ঘুরাতে মোবারকের দিকে এগোল।
দর্শকরা অবাক হয়ে দেখল, শফির লাঠি দেখা যাচ্ছে না। শুধু বনবন আওয়াজ হচ্ছে। আর মোবারকও তাই দেখে অবাক হয়ে নিজের লাঠি দিয়ে আক্রমণ বাধা দিতে গেল। শফির লাঠির আঘাতে তার লাঠিটা হাত ছাড়া হয়ে উড়ে গিয়ে দর্শকদের মাথার উপর পড়ল।
মোবারকের মনে হল শফি মানুষ না। কোনো মানুষের গায়ে এত শক্তি থাকতে পারে না। হাতছাড়া হয়ে লাঠিটা দূরের দর্শকদের উপর পড়তে দেখে এত অবাক হল যে, শফির দিকে চেয়ে পাথরের মতো জমে গেল।
এই সুযোগে শফি তার বামহাতের কুনুই-এর নিচে প্রচন্ড জোরে আঘাত করল।
মোবারকের মনে হল হাতটা বুঝি জয়েন্ট থেকে খুলে পড়ে গেল। শফি তার পায়ে আঘাত করতে যাচ্ছে দেখে দু’হাত তুলে সারেন্ডার করতে চাইল; কিন্তু বাম হাত তুলতে না পেরে শুধু ডান হাত তুলল।
শফি লাঠিটা সামলে নিয়ে বলল, আমি কিন্তু আপনার চার হাত পা–ই। ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিলাম; স্যারেন্ডার করলেন বলে তা আর করব না। কারণ ন্যায় অন্যায় চিন্তা না করে লেঠেলগিরী করে যেমন অনেক টাকা রোজগার করেছেন, তেমনি সেই সাথে অনেক গুণাহও অর্জন করেছেন। এবার তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে সম্ভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ দিলাম। আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি, তবু কেন কয়েকটা টাকার জন্য কারও কথায় আমার হাত পা ভেঙ্গে আমাকে লুলা। করে দিতে চেয়েছিলেন? মওত, কবর ও হাশরের কথা মনে করে এখন থেকে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ.) এর হুকুম মেনে চলার চেষ্টা করুন। যদি টাকা পয়সার দরকার হয় আসবেন, যথাসাধ্য দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। দোয়া করি “আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিয়ে সভাবে জীবনযাপন করার তওফিক দিক।”
শফি থেমে যেতে মোবারক চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে মানুষ বলে মনে হয় না। তোমার কথা শুনে আল্লাহ আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। ওয়াদা করছি, জীবনে আর কখনও লেঠেলগিরী করে টাকা রোজগার করব না।
মোবারকের সঙ্গে লাঠি খেলার প্রতিযোগীতায় শফির ক্ষীপ্রতা ও লড়াইয়ের কলাকৌশল সর্বোপরী তার লাঠি ঘোরানো দেখে গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ জনসাধারণ অবাক। তাদেরও মনে হয়েছে, শফি মানুষ নয় অন্য কিছু। শেষে মোবারকের পরিণতি এবং শফি ও মোবারকের কথা শুনে হাততালি দিয়ে শফিকে বাহবা দিতে লাগল। বিচারকরা শফিকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন।
শফি এগিয়ে এসে মাতব্বর সুরুজমিয়াকে কদমবুসি করে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদু, আল্লাহর মেহেরবানীতে ও আপনার নেক দোয়ার বরকতে আমি সফল হয়েছি।
মাতব্বর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে দোজাহানে সফলতা দান করুক।” তারপর দশহাজার টাকার বান্ডিলটা তার হাতে তুলে দিলেন।
শফি সেটা নিয়ে মোবারকের হাতে দিয়ে বলল, লেঠেলগিরী ছাড়াবার জন্য আপনার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছি। আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে মাফ করে দিন। আর এই টাকা দিয়ে হাতের চিকিৎসা করাবেন।
প্রথম থেকে শফি চেয়ারম্যান ও মহসিনকে দেখলেও এতক্ষণ না দেখার ভান করে ছিল। এবার কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করে চেয়ারম্যান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাদের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে সফলতা দিয়েছেন। সেজন্যে তাঁর পাক দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি। এবার আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ করছি, লেঠেল বা অন্য কোন কাজে গরিব লোকদেরকে নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য কোনো অন্যায় কাজে ব্যবহার করবেন না। বরং কারও সঙ্গে কারও বিরোধ ঘটলে, উভয়পক্ষ এক সঙ্গে বৈঠক করে মিমাংসা করে নেবেন। এটাই হল ইসলামের হুকুম।
শফির কথা শুনে সবাই হাত তালি দিতে লাগল।
মাতব্বর সাহেব সবাইকে চুপ করতে বলে চলে যেতে বললেন।
.
সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান ফেরার পথে ছেলেকে বললেন, আমি যে মোবারককে টাকা দিয়ে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে বলেছি, তা বোধ হয় শফি জানতে পেরেছে।
মহসিন বলল, তা কী করে সম্ভব?
চেয়ারম্যান বললেন, তা তো আমিও জানি; কিন্তু ওর কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। তোরও তো বোঝা উচিত ছিল। যাই বলিস, জীবনে অনেক লেঠেলের লাঠি খেলা দেখলাম; কিন্তু শফির মতো কাউকে দেখিনি।