Site icon BnBoi.Com

ক্রন্দসী প্রিয়া – কাসেম বিন আবুবাকার

ক্রন্দসী প্রিয়া - কাসেম বিন আবুবাকার

 

১. মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি

ক্রন্দসী প্রিয়া – ইসলামিক উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার

০১.

মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বাসে হঠাৎ অন্তরঙ্গ বন্ধু জামানের সাথে দেখা। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর বলল, তোর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হল। এখন তুই কিছু করছিস, না শুধু লেখা নিয়ে আছিস?

বললাম, আমার কথা বাদ দে। তুই লাইব্রেরীর চাকরি ছেড়ে কি যেন কেমিকেলের ব্যবসা করছিস শুনেছিলাম, সেটা এখন কেমন চলছে?

আল্লাহপাকের রহমতে ভালই চলছে। তা ছাড়াও একটা বইয়ের দোকান করেছি। একদিন ভাবি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে আয় না। বাড়ি করেছি শুনিস নি বোধ হয়?

না শুনিনি। বাড়ি যখন করেছিস তখন ব্যবসা ভালই চলছে নিশ্চয়?

হ্যাঁ বলে একটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল, কবে আসবি বল? তোর সঙ্গে তো প্রায় দশ বছর পরে দেখা হল, এর মধ্যে আমার জীবনে একটা রোমান্টিক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। তুই আগামী শুক্রবার ভাবিকে নিয়ে সকালের দিকে আসবি। তোর ভাবিকে বলে লাখবো। ও শুনলে খুব খুশি হবে। তোদের কথা প্রায় মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে। ঐদিন ঘটনাটাও শোনাব।

বললাম, ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ যাব।

গুলিস্তানে আসার পর বাস থেকে নেমে জামান আমাকে নিয়ে একটা রেষ্টুরেণ্টে ঢুকে চা-নাস্তার অর্ডার দিল।

জিজ্ঞেস করলাম, তোদের ছেলেমেয়ে কয়টা?

দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তোদের?

মৃদু হেসে বললাম, তিন বছর হল বিয়ে করেছি। এখনও হয়নি।

এমন সময় মেসিয়ার নাস্তা নিয়ে এলে জামান বলল, নাস্তা খেয়ে নিই আয়। আমার একটু তাড়া আছে। শুক্রবার আসিস, চুটিয়ে গল্প করা যাবে।

রেষ্টুরেণ্ট থেকে বেরিয়ে জামান একটা রিকশায় উঠে বলল, চলি দোস্ত। তুই কিন্তু ভাবিকে নিয়ে সকালের দিকে আসবি, একসঙ্গে নাস্তা খাব। তারপর সালাম বিনিময় করে রিকশা ওয়ালাকে বলল, সদরঘাট চল।

বাসায় এসে গিন্নীকে বললাম, আজ বহুদিন পরে বাসে বন্ধু জামানের সঙ্গে দেখা হল। তার কথা তোমার মনে আছে?

আমার স্ত্রী বলল, সেই বন্ধু তো? যে নিউমার্কেটে লাইব্রেরিতে চাকুরি করত? আমাদের বাসায় কয়েকবার এসেছে?

হ্যাঁ, সে এখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেমিকেলের ব্যবসা করে বেশ টাকার মালিক হয়েছে, একটা বাড়িও করেছে। তারপর কার্ডটা তার হাতে দিয়ে বললাম, এটা তার ঠিকানা। আগামী শুক্রবার আমাদেরকে যেতে বলেছে। না গেলে বেচার মনে খুব কষ্ট পাবে।

কার্ডের উপর চোখ বুলিয়ে ফেরৎ দেওয়ার সময় আমার স্ত্রী বলল, বেশ তো যাওয়া যাবে।

শুক্রবার সকাল নটার সময় স্বস্ত্রীক জামানদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। সালাম বিনিময়ের পর জামান ও তার স্ত্রী অভ্যর্থনা করে আমাদেরকে ড্রইংরুমে বসাল।

জামানের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি কেমন আছেন?

আল্লাহপাকের রহমতে ভাল আছি। তারপর লেখক সাহেবের পরবর্তী কি বই কবে নাগাদ বেরোচ্ছে? আপনার আগের দুটো বই কিন্তু দারুন হয়েছে।

জামানও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, সত্যি দোস্ত, তোর জওয়াব নেই।

বললাম, কতটা দারুণ হয়েছে জানি না, তবে তোরা দুজনেই যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছিস তখন মনে হচ্ছে, দারুণ না হলেও কিছু একটা হয়েছে। বর্তমানে প্রেমের পরশ নামে একটি বই লিখছি।

বন্ধুপত্নী বলল, নামটা শুনে মনে হচ্ছে এটাও দারুণ হবে।

দোয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আপনাদের মনের বাসনা পুরণ করার তওফিক আমাকে দান করেন।

তাতো করবই, তারপর আমার স্ত্রীর হাত ধরে বলল, আপা, আপনি চুপ করে আছেন কেন? আমরা পাঠক-পাঠিকারা যখন ওঁর লেখা পড়ে এত আনন্দ পাই তখন আপনার তো সব থেকে বেশি আনন্দ পাওয়ার কথা।

আমার স্ত্রী কিছু বলার আগে জামান বলে উঠল, তুমি বেচারীকে কিছু বলার চান্স দিচ্ছ কই!

তুমি থামতো বলে বন্ধুপত্নী বলল, তোমরা বসে গল্প কর, আমরা ভিতরে যাচ্ছি। তারপরে চলুন আপা বলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে উদ্দত হল।

জামান বলল, দয়া করে একটু জলদি আমার বন্ধুর জন্য কিছু পাঠাও। কত বেলা হয়ে গেছে দেখছ না?

শুধু বন্ধুর জন্য পাঠাব, আর তোমার জন্য? জানেন আপা, আমার উনি না ভীষণ পেটুক। সকাল থেকে কিছু খাওয়ার জন্য কয়েকবার তাগিদ দিয়ে বলেছে, মেহমানরা কখন আসবে তার ঠিক নেই, যখন আসবে তখন না হয় আর একবার তাদের সঙ্গে খাওয়া যাবে। এখন কিছু দাও না, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।

আমি বললাম, নটার আগে কিছু পাচ্ছ না। এর মধ্যে যদি না আসে তখন দেখা যাবে।

আমার স্ত্রী হেসে ফেলে বলল, এটা আপনার অন্যায় হয়েছে। ভাই সাহেব খিদে পেয়েছে বলা সত্বেও আপনি তাকে কিছু খেতে না দিয়ে ঠিক করেন নি।

আমি বললাম, ওর কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

ভাবি বলল, আমি আপনাদের জন্য এত করলাম, আর আপনারা দুজনেই আমার দোষ দিচ্ছেন। এ যে দেখছি-যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর।

জামান বলল, হয়েছে হয়েছে, আমার কাছে আর ক্ষমা চাইতে হবে না। তাড়াতাড়ি কর, নচেৎ দেরি করলে ক্ষমা চাইলেও কিন্তু করব না।

স্বামীর প্রতি একবার কটাক্ষ হেনে ভাবি বলল, ক্ষমা চাওয়ার মতো অন্যায় করলে তো ক্ষমা চাইব। তারপর সে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।

খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালই হয়েছিল। তখন বর্ষাকাল। দুপুরের পর মুষলধারে বৃষ্টি নামল। জোহরের নামায পড়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে যাওয়ার সময় জামান স্ত্রীকে বলল, তোমরা দুজনে গল্প কর, আমাদের কাছে এসে ডিষ্টার্ব করো না। আমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কিছু কথা। আছে। তবে এমন বর্ষামুখর দিনে মাঝে মাঝে ছোলা-কড়াই ভাজা আর চা পাঠালে খুব খুশী হব। তারপর ড্রইংরুমে এসে দুজনে মুখোমুখি সোফায় বসে সিগারেট ধরালাম।

প্রথমে আমিই বললাম, তুই কি যেন তোর জীবনের ঘটনা বলবি বলেছিলি?

জামান বলল, বলব, তবে তার আগে তোকে কথা দিতে হবে, এটাকে নিয়ে তুই একটা উপন্যাস লিখবি। তোর ফুটন্ত গোলাপ ও বিদেশী মেম বই দুটো তো খুব হীট করেছে। আশা করি, আমারটাও করবে।

বললাম, তোর ইচ্ছা পুরণ করার চেষ্টা করব।

তাহলে আরম্ভ করছি শোন–

.

বেলা তখন দুটো। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের আধাআধি। জোহরের নামাযের পর খাওয়ার পর্ব শেষ করে দোকানের সামনের আঙ্গিনায় রোদ পোহাচ্ছি। সে বছর শীত বেশ জোরে সোরে পড়েছিল। যখনকার কথা বলছি, তুই তো জানিস তখন আমি ঢাকা গভঃ নিউমার্কেটের একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলস ম্যানেজার ছিলাম। অন্যান্য দোকানের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছি। এমন সময় আমার একজন সহকর্মীর ডাকে আমি দোকানে গেলাম। তিনজন ছাত্রীকে দেখিয়ে সে বলল, ইনারা দুটো বই ফেরত দিয়ে অন্য বই নিতে এসেছেন।

ওদের মধ্যে একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, দয়া করে এই দুটো বই চেঞ্জ করে দিন। তারপর একটা বই কাউন্টারের উপর রেখে বলল, এটার ভিতরের দুটো পাতা ছেঁড়া। আর ওরা গতকাল এখান থেকে যে বইটা কিনেছিল, সেটা না দিয়ে আপনারা ভুল করে অন্য বই প্যাকেট করে দিয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় বইটাও কাউন্টারের উপর রেখে বলল, বইয়ের ভেতরে মেমো আছে।

শীতের রোদ থেকে আসতে এমনি বিরক্ত লাগছিল, তার উপর বই চেঞ্জের কথা শুনে আরো বেশি বিরক্ত বোধ করে সহকর্মীকে তাদের মেমো মোতাবেক বইটি দিতে বললাম। যে ছাত্রীটি আমার সঙ্গে কথা বলছিল, তার বইটা ছিল ইন্টারমিডিয়েটের ইংলিশের নোট। আমি ঐ বইটার অন্য এক কপি তাকে দিলাম। তারপর ফেরৎ বইটার ছেঁড়া পাতা খুঁজতে গিয়ে সেখানে এক টুকরো কাগজ ভাঁজ করা দেখলাম।

কাগজটা ছাত্রীটিকে ফেরৎ দিতে গেলে সে আস্তে করে বলল, ওটা আপনাকে দিয়েছি, পড়ে দেখবেন।

প্রথমে কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, হলুদ রঙ এর জাপানি সিফনে আবৃত দেহ থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে। দীর্ঘায়ত চোখে অপূর্ব কোমলতা।

চার চোখ এক হতে মেয়েটি স্নিগ্ধ কণ্ঠে শুধাল, আমাকে চিনতে পারছেন না?

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, এখানে আমার চেনা জানা কোনো মেয়ে নেই। তবে আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।

মেয়েটি তখন মিনতি সুরে বলল, আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা আছে। এই চিঠিটা পড়ে সেইমতো আমার সঙ্গে দেখা করলে খুব উপকৃত হব।

কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না

মৃদু হেসে মেয়েটি জওয়াব দিল, দয়া করে তর্ক করবেন না। প্লীজ, মনে করুন এটা একটা আপনার খুব আপনজনের ঐকান্তিক মিনতি।

আমি কিছু বলার আগে তার সঙ্গিনীরা তাকে ডেকে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটির স্পর্ধা দেখে যদিও রাগে আমার আপাদমস্তক রি রি করে উঠল, তবু কাগজটায় কি লেখা আছে তা জানার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে দোকানের ভিতরে গেলাম। সেখানে অফিসিয়াল কাজের জন্য টেবিল, চেয়ার, লাইট, ফ্যান সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। বইয়ের আলমারী দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। কাগজটা খুলে পড়লাম

মাননীয় ম্যানেজার সাহেব, আপনি যদি আগামী সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল আটটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসেন, তাহলে আমি খুব বাধিত হব।
ইতি-সেলিনা।

প্রথম থেকেই মেয়েটির কথা বার্তায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সবকিছু যেন গায়ে-পড়া ভাব। তারপর এই চিঠি পড়ে বেশ অসন্তুষ্ট হলাম। কারণ আমি ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। অন্য যে কোনো লোক হলে হয়তো রোমান্টিক কিছু অনুভব করত। এই রকম চিন্তা করা যে পাপ, তা আমি জানতাম। সিগারেট ধরিয়ে কাগজটা পুড়িয়ে ফেললাম। মনে হলো সব অসন্তোষ দুর হয়ে গেল। তারপর বেমালুম সব কিছু ভুলে গেলাম।

আমি যে দোকানে চাকরি করতাম সে দোকানের মাঝখানের দেয়াল ভেঙ্গে দুটোকে একটা করা হয়েছে। আমি ছাড়াও তিনজন সেলসম্যান ছিল। কর্মদক্ষতায় সকলের চেয়ে সিনিয়ার ছিলাম। আর ঠিকমতো নামায রোযা করতাম। সেই জন্য আমার সহকর্মীরা আমাকে খুব সমীহ করে চলতো। আমি তাদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম। এই দোকানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ ও আইনের দেশী-বিদেশী এবং নানারকম ধর্মীয় পুস্তক ছিল।

দোকানের অর্ডার লিষ্ট তৈরির কাজে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ঐ চিঠির কথা হয়তো কোনো দিন আর মনেই পড়ত না। কিন্তু বিধির বিধান অন্য রকম। উক্ত ঘটনার দিন পনের পর একদিন মার্কেটের ভিতরের একটি ঘড়ির দোকানে আমার রিষ্ট ওয়াচটা ওয়েলিং করতে দিয়ে ফিরছি, হঠাৎ ঐ মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। বলল, আমার সঙ্গে একটু আসুন।

মেয়েটিকে দেখে তার নাম ও চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। আর তার স্পর্ধার বহর দেখে রাগে চোয়ালটা আপনা হতেই শক্ত হয়ে উঠল। তথাপি নিজেকে সংযত করে সৌজন্য রক্ষা করার জন্য বললাম, আমার এখন সময় নেই।

মিনতি ভরা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আপনার বেশি সময় নষ্ট করব না। দয়া করে যদি আসেন, তাহলে দুএকটা কথা বলেই ছেড়ে দেব।

আমাকে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অন্যান্য দোকানের পরিচিত কয়েকজন সেলসম্যান আমাদেরকে বিশেষ ভাবে যে লক্ষ্য করছে, তা আমি এদিক ওদিক তাকাতেই বুঝতে পারলাম। বললাম, ঠিক আছে চলুন।

সেলিনা আমাকে নভেল ড্রিংক রেষ্টুরেণ্টের দোতলার একটি কেবিনে বসিয়ে বলল, কি খাবেন? ঠান্ডা না গরম?

কোনো কিছুই এখন আমি খাব না, যে জন্য ডেকেছেন বলুন।

আপনি যদি কিছু না খান, তবে ভাববো আমার উপর খুব রেগে আছেন।

বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠান্ডা।

তাহলে আপনিই অর্ডার দিন।

যদিও তখন শীতকাল তবু বেয়ারাকে ডেকে রাগের চোটে চারটে ঈগলু দিতে বললাম। বেয়ারা চলে যেতে ওকে বললাম, আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।

আপনি যেভাবে রেগে আছেন, তাতে কিছু বলতে সাহস হচ্ছে না।

তাহলে বলার দরকার নেই, চললাম। দয়া করে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করবেন না। এই কথা বলে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

তখন সেলিনাও দাঁড়িয়ে আমার একটা হাত খপ করে ধরে বলল, প্লীজ, যাবেন না। একটু বসুন।

আহ, কি করছেন, হাত ছাড়ুন। সেলিনা লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে দিতে আমি বসলাম। এমন সময় বেয়ারা দুটো ঈগলু টেবিলের উপর রাখল। তাকে বললাম, তুমি কেমন মেসিয়ার? অর্ডার দিলাম চারটে, আর দিলে দুটো। অথচ অন্যেরা খদ্দেরকে বেশি খাওয়াবার চেষ্টা করে।

বেয়ারা কিছু বলার আগেই সেলিনা বলল, আমরা যখন এখানে আসি তখন দোকানের মালিক দেখেছেন। উনি জানেন আমি ঈগলু খাইনা। তবু যখন আমার কাছ থেকে অর্ডার গেছে তখন কম করে দিয়েছেন।

বুঝতে পারলাম দোকানের মালিকের সাথে সেলিনার ঘনিষ্ঠতা আছে। বললাম, আপনি ঈগলু না খেয়ে অন্য কিছু খান।

আগে কখনো না খেলেও এবার থেকে খাব বলে সেলিনা খেতে আরম্ভ করল। তারপর বলল, আজ তো আপনার সময় নেই। তাই আপনাকে আগামী ছুটির দিন কিংবা যেদিন আপনার সময় হবে সেদিন আমার সংগে এক জায়গায় যেতে হবে। বিশেষ জরুরী কিছু কথা আমি আপনাকে বলতে চাই। গত ঐ ছুটির দিন আমি সকাল আটটা থেকে বেলা বারটা পর্যন্ত আপনার জন্য মার্কেটের গেটে অপেক্ষা করেছিলাম।

কথাটা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যে আসবো সেটা আপনি ভাবলেন কি করে? একজন অপরিচতি লোককে একটা চিঠি লিখে আসতে বললেই সে যে আসবে, সেটাই বা বিশ্বাস করলেন কেমন করে?

জানি না, তবে আমার বিশ্বাস ছিল আপনি আসবেন। আর আমি আপনার কাছে অপরিচিতা হলেও আপনাকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি।

সেলিনার উত্তর শুনে আরও অবাক হয়ে বললাম, কি কথা। এখানে বলা যাবে না?

সে অনেক কথা, এখানে অত কথা বলা সম্ভব নয়।

একটু চিন্তা করে বললাম, একটা শর্তে যেতে রাজি আছি।

একটা কেন, যদি শত শর্ত দেন, সবগুলো মানতে রাজি।

আপনি এরপর ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আর কোনো রকম যোগাযোগ করবেন না।

ভবিষ্যতের কথা আল্লাহপাক জানেন, তবে আপনার শর্ত মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করব।

আগামী ছুটির দিন বেলা নটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসব বলে দোকানের মালিকের নিকট বিল দেওয়ার জন্য গেলাম। উনি বললেন, বিল আগাম দেওয়া আছে। চলে আসার জন্য ঘুরে দেখি, সেলিনা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সঙ্গে কোনো কথা না বলে দোকানে চলে আসি।

.

ছুটির দিন বেলা নটায় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি, সেলিনা একটা প্রাইভেট কারের ডাইভিং সিটে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়িটার নাম কার্ডিলাক। সবুজ রং এর সুন্দর গাড়িটা খুব দামী বলে মনে হল।

আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিয়ে বলল, আপনি রাইট টাইমে এসেছেন। এ দিন সে প্রথম আমাকে সালাম দেয়।

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে বললাম, মানি, টাইম এন্ড ক্যারেক্টার এই তিনটি জিনিষ খুব মূল্যবান। মনিষিরা বলেন, মানি ইজ লষ্ট, নাথিং ইজ লষ্ট; টাইম ইজ লষ্ট, সামথিং ইজ লষ্ট; বাট ক্যারেক্টার ইজ লষ্ট, এভরীথিং ইজ লষ্ট। আর ইসলামের আইন অনুযায়ী এই গুলি অমূল্য রতনচরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই ইসলামী জিন্দেগীর সারকথা। প্রত্যেক মানুষের উচিত, এই তিনটি জিনিসের মর্যাদা দেওয়া। যদি পৃথিবীর মানুষ এইগুলির অপব্যবহার না করত, তাহলে তাদেরকে কোনো অশান্তির আগুন স্পর্শ করতে পারত না।

সেলিনা মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনল, তারপর আসুন বলে নিজে ড্রাইভিং সীটে বসে পাশের গেট খুলে দিয়ে আমাকে বসতে বলল।

বললাম, আমি পিছনের সীটে বসব।

কক্ষনো না, আপনাকে সামনের সীটে বসতেই হবে।

তার কথার জোর দেখে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলাম, তারপর আর কিছু না বলে মাঝখানে বেশ ব্যবধান রেখে বসে পড়লাম।

গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, আপনি স্বচ্ছন্দে সিগারেট খেতে পারেন। তাতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না।

বেশ অবাক হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবলাম, মেয়েটা অন্তর্যামী না কি? কারণ সত্যিই ঐ সময় আমার সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। হঠাৎ চিন্তা হল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে আর কি কথাই বা বলবে? গাড়ি, পোশাক পরিচ্ছদ ও চাল-চলন দেখে মনে হচ্ছে খুব বড় লোকের মেয়ে। বন্ধুদের কাছে বড়লোকের মেয়েদের অনেক খামখেয়ালীর গল্প শুনেছি। তখন আর একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ল।

প্রায় বছর দুই আগে একদিন ইউনির্ভাসিটির দুটি ছাত্রী বই কিনতে আসে। কথায় কথায় একজন হঠাৎ আমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করল। আমি আমার ঠিকানা বললাম। যাওয়ার সময় তাদের একজন কাগজে কিছু লিখে আমার হাতে দিয়ে বলল, ঠিকানা দিলাম, সময় করে একদিন বেড়াতে আসবেন।

কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখি, উনি জনৈক জর্জের মেয়ে, ঠিকানা ধানমন্ডি। ওরা চলে যাওয়ার পর কাগজটা হাতের মধ্যে গুলি পাকিয়ে ড্রেনে ফেলে দিই। চিন্তায় এমনই ডুবে ছিলাম যে, গাড়ি পৌঁছে কখন থেমে গেছে বুঝতে পারিনি। সেলিনা যখন গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, কই, নামুন তখন খেয়াল হল। দেখলাম, একটা চারতলা বিল্ডিং এর করিডোরে গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নামতে আমাকে উপরের তলায় নিয়ে গেল। সিঁড়ির মাথা থেকে গোটা বারান্দায় কার্পেট বিছান। পরপর চারটে দরজায় ভেলভেটের ভারি পর্দা। বারন্দার শেষ মাথায় দুটি দরজায় পর্দা নেই। উপরে উঠে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপে এগোচ্ছি। প্রথম দরজা পার হয়ে দ্বিতীয় দরজার কাছে এসে সেলিনা পর্দা সরিয়ে বলল, ভিতরে আসুন। ভিতরে ঢুকবো কিনা চিন্তা করে ইতস্ততঃ করছি দেখে সেলিনা আমার একটা হাত ধরে একেবারে খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার দুহাত ধরে একরকম জোর করে বসিয়ে দিয়ে বলল, একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।

আমাকে যে খাটে বসাল সেটা ডবল বেডের স্প্রীংএর তাতে খুব নরম গদী থাকায় আমার শরীরের কিছু অংশ দেবে গেল। মনে হল জীবনে এত নরম বিছানায় কোনোদিন বসিনি। ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সত্যিই এরা খুব বড়লোক। ঘরের মেঝেতেও কার্পেট বিছান। জানালা গুলোতে ভারী পর্দা ঝুলছে। একটা বুককেসও মেহগিনি কাঠের একটা বড় আলমারী রয়েছে। আলমারীর একটা পুরো পাল্লায় বেলজিয়াম গ্লাস। আমি যেখানে বসেছিলাম তার সোজাসুজি আলমারী থাকায় আয়নায় নিজের ছবি দেখতে পেলাম। আমার পোশাক দেখে এই পরিবেশের সঙ্গে বেমানান মনে হল। ড্রেসিংটেবিলের পাশে একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার দুপাশে দুটো চেয়ার রয়েছে। ভাবলাম, চেয়ারে না বসিয়ে খাটে বসাল কেন? চেয়ারে বসাই ভাল। এই মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেলাম, একজন মধ্যবয়স্কা সুন্দরী স্বাস্থবতী মহিলা পর্দা সরিয়ে আমার দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই বললেন, কে তুমি? এখানে কেন এসেছ? বেরিয়ে যাও। আবার যদি কোনো দিন আসতে দেখি, তাহলে পুলিশের হাতে তুলে দেব। স্কাউড্রেল, বদমাশ, জোচ্চোর, লোফার, শিঘ্রী বেরিয়ে যাও।

আমি লজ্জায়, ঘৃণায় ও অপমানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আর সেলিনার বোকামীর জন্য ওর উপর খুব রেগে গেলাম।

আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মহিলাটি আবার বললেন, যাবে? না পুলিশে ফোন করব?

আমি তখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। নিজেকে কঠোরভাবে সংযত করে বললাম, দেখুন, কাউকে সাজা দেওয়ার আগে সত্যি সে অপরাধী কিনা সেটা অনুসন্ধান করা এবং তাকে তার অপরাধ জানিয়ে দেওয়া উচিত।

স্টুপিড, আই সে গেট আডট, বলে ভদ্রমহিলা টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন।

থামুন, পুলিশ ডাকতে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি! এই কথা বলে যখন আমি দরজার কাছে এসেছি, সেই সময় সেলিনা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বলল, আপনি যাবেন না। তারপর ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মা, তুমি কাকে কি বলছ? আমি যে ওঁকে অনেক সাধ্য সাধনা করে এখানে এনেছি; আর তুমি অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছ?

আমি একটও অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে এগোলাম, তখনও সেলিনা বলছে, আম্মা, তুমি ওঁকে যেতে মানা কর, তোমার পায়ে পড়ি আম্মা। তুমি না ডাকলে উনি ফিরে আসবেন না। আমি ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এসে একজন রোগামতো বুড়োকে গাড়ি মুছতে দেখলাম।

গাড়ির কাছে পৌঁছেছি, তখন সেলিনা ছুটে এল। আমি বাধা দেওয়ার আগেই আমার একটা হাত ধরে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে জোর করে আমাকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে নিজেও উঠে আমার পাশে খুব ঘনিষ্ট হয়ে বসল। তারপর সেই বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদু, নিউমার্কেট চলুন।

আমি সরে বসে বললাম, আমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দেবেন।

সেলিনা তখনও কাঁদছিল। বলল, না দাদু, বরং রমনা রেস্টুরেন্টে চলুন। কথাটা শুনে খুব রেগে গিয়ে তার দিকে তাকালাম, তার করুণ অবস্থা দেখে রাগটা আপনা থেকেই কেন যেন পড়ে গেল। বললাম, আমাকে আপনার বেডরুমে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, ড্রইংরুমে বসাতে পারতেন।

আপনাকে কখনও আমি ড্রইংরুমে বসাতে পারব না! বিশ্বাস করুণ, আম্মা যে আপনার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

গাড়ি রমনা রেস্টুরেন্টের গেটে থামার পর আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় সেলিনা ড্রাইভারকে বলল, দাদু, আপনার কোনো কাজ থাকলে সেরে আসুন। আমার ফিরতে ঘন্টা দুই দেরি হবে। কেবিনে ঢুকে সেলিনা বেল টিপে বেয়ারাকে দুগ্লাস লস্যির অর্ডার দিল। দুতিন মিনিটের মধ্যে বেয়ারা লস্যি নিয়ে এলে তাকে বলল, আমারা এখানে ঘন্টা দুই পরে ডিনার খাব। এর মধ্যে তোমাকে আসতে হবে না। দরকার হলে বেল বাজাব, আর যাওয়ার সময় বখশিস পাবে।

ঠিক আছে মেমসাব বলে বেয়ারা চলে গেল!

আমি তখন চিন্তা করছি ওর কথা শোনার পর ফাইনাল বোঝাপড়া করে নিতে হবে, ভবিষ্যতে যেন আমার সঙ্গে কোনোরকম সম্বন্ধ না রাখে।

সেলিনা হঠাৎ উঠে এসে মেঝের উপর বসে পড়ে আমার দুপা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমার বোকামীর জন্য আপনি খুব অপমানিত হয়েছেন, সেজন্য আমি মাফ চাইছি। বলুন আমাকে মাফ করেছেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় ভীষণ আশ্চর্য হলাম। তারপর রাগতস্বরে বললাম, পা ছাড়ুন, উঠুন। চরম গুরুজন ছাড়া কারও পায়ে হাত দেওয়া উচিত না।

আপনি আগে বলুন, মাফ করে দিয়েছেন?

বললাম, পাগলামি করবেন না; পাগলামিরও একটা সীমা আছে। তবু যখন পা ছাড়ল না তখন আমি দাঁড়িয়ে ওর দুটো হাত ধরে জোর করে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বললাম, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এক্ষনি চলে যাব, যে কথা বলার জন্য এনেছেন বলুন।

সেলিনা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কি করব বুঝতে না পেরে চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, যা গত হয়ে গেছে তাকে নিয়ে আপনি অত মন খারাপ করছেন কেন? সেটা ভেবে বরং আমারই বেশি রাগ ও মন খারাপ হওয়ার কথা। আপনাকে আমি অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। নচেৎ আপনার সঙ্গে এখানে আসতাম না। মায়েরা সন্তানদের ওরকমভাবে অনেক বকাঝকা করে। আমি সে জন্য মনে কোনো কষ্ট নিইনি। তবে আপনার নির্বুদ্ধিতার জন্য সে সময় আপনার উপর খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। কারণ আপনি যে কাজ করেছেন, সেটা যে মস্তবড় অন্যায়, এই জ্ঞানটাও আপনার নেই।

সেলিনা উঠে গিয়ে বেসিন থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আমার দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে চুমুক দিল। তারপর বলল, ব্যারিষ্টার মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে চেনেন?

নামটা শুনেই মনে হোঁচট খেলাম। তখন প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা আমার মনের পাতায় ভেসে উঠল।

১৯৭০ সালে ব্যারিষ্টার সাহেব প্রথম যেদিন আমাদের দোকানে আইনের বই কেনার জন্য আসেন তখন সালওয়ার কামিজ পরে এই মেয়েটিও সঙ্গে ছিল। উনি সেদিন অনেক বই কিনেছিলেন। দেরি হচ্ছে দেখে আমি মেয়েটিকে একটি চেয়ার দিয়ে বলেছিলাম, খুকি, তুমি এখানে বসো। তারপর থেকে মেয়েটি ব্যারিষ্টার সাহেবের সাথে প্রায় আসত।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিনা আবার বলল, উনি আমার আব্বা।

বললাম, ওঁকে আমি খুব ভালভাবে চিনি। প্রায় এক বছরের বেশী হয়ে গেল দেখিনি।

৭১ সালে পাক হানাদাররা আব্বাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এই বলে সেলিনা আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

ওঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমিও খুব দুঃখ পেলাম। বললাম, মাফ করবেন, না জেনে আপনার মনে ব্যাথা দিলাম। সেলিনা কাঁদছিল। আমার তখন অনেক কথা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ব্যারিষ্টার সাহেব সেদিন দোকানে এসেই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের ম্যানেজার সাহেব কে?

একজন সহকর্মী আমাকে দেখিয়ে দেয়। আমি তখন একজন কাষ্টমারের বই মেমো করছিলাম। উনি আমার নিকটে এসে একটি লিষ্ট দিয়ে বললেন, দেখুন তো এই বইগুলো আপনার দোকানে আছে কিনা? কথাগুলো এমনভাবে বললেন, যেন আমি লিষ্ট দেখার উপযুক্ত না।

আমি লিষ্টটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, অর্ধেক বই আছে, আর বাকিগুলো অন্য লেখকের আছে। উনি সব বইগুলী দুইভাগে নামাতে বললেন। ওঁর কথামত বইগুলো কাউন্টারের উপর নামালাম। কাজটা করতে আমার দুতিন মিনিট লেগেছিল।

অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতদুর লেখাপড়া করেছেন?

বললাম, অল্পকিছু করেছি।

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, বিদেশ থেকে নতুন বই এলেই আমাকে অনুগ্রহ করে জানাবেন। সেই থেকে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। এইসব ভাবছিলাম, সেলিনার কথায় সম্বিত ফিরল।

ও তখন বলছে, আমি যখন প্রথম দিন আব্বার সঙ্গে আপনাদের দোকানে যাই তখন আপনাকে দেখেই প্রেমে পড়ি। কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তবে প্রেম কি জিনিস তখন আমি জানতাম না। শুধু আপনাকে দেখতে, আপনার কথা শুনতে খুব ভালো লাগত। সেই জন্য আব্বা যখনই মার্কেটে যেতেন, আমিও যেতাম! অনেক সময় আব্বা মার্কেট থেকে কাপড়-চোপড় কিনে যখন বাসায় ফিরতেন, সেই সময় আপনাকে দেখার জন্য মন খুব ছটফট করত। ঐ দিন যখন আপনি আমাকে চেয়ার দিয়ে বললেন, খুকী এখানে বস, তখন আমি চমকে উঠি। ভাবলাম, আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? কারণ, আমার ডাক নাম খুকী। সেদিন আমারও কয়েকটা বই কেনার দরকার ছিল। একটা লিষ্টও আপনার হাতে দিয়েছিলাম। লিস্ট দেখে আপনি বললেন, আমাদের দোকানে স্কুলের বই নেই। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। আব্বা তখন বললেন, খুকীকে একটা ভালো গল্পের বই দিন। আপনি মোসলেম পঞ্চসতী বইটি আব্বার হাতে দিয়ে বললেন, বইটি খুব ভালো। এতে। রিলিজিয়াস জ্ঞান অনেক আছে। আব্বা খুশি হয়ে বলেছিলেন, ছাত্র ছাত্রীদের এই রকম বই পড়া খুব দরকার। বইটা তখন আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাসায়। এসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যতই পড়তে লাগলাম ততই ভালো লাগল। মুসলমান নারীদের মধ্যে যে ঐ রকম আদর্শ চরিত্রবতী নারী ছিলেন, তা আমি এর পূর্বে কখনও শুনিনি। বইটি পড়ে ধর্মের অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয় এবং বুঝতে পারলাম আপনি ধার্মিক। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আম্মার সঙ্গে আমি ও আমার ছোট বোন জরিনা আপনার কাছে গল্পের বই কেনার জন্য গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছে আপনি আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেছেন। পরে সে ভুল। ধারণা আমার ভেঙে যায়। সব সময় আমি আপনার প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলাম। আপনি একবারও ভালো করে আমার দিকে তাকালেন না। তারপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে বই কেনার জন্য গিয়ে লিষ্টটা আপনার হাতে দিলাম! আপনি অন্য একজনকে লিষ্টটা দিয়ে বইগুলি দিতে বললেন। মেমো করে যখন টাকাটা আমার কাছ থেকে নিচ্ছিলেন তখন আমি ইচ্ছা করে আপনার হাতের সঙ্গে আমার হাত ঠেকিয়ে দিলাম। এই প্রথম আমার প্রেমিকের ছোঁয়া পেয়ে আমি শিহরিত হই। আপনার দিকে ভীরু চোখে তাকালাম। কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। এতক্ষণ কথা বলে সেলিনা চুপ করল।

আমি বললাম, আপনার আসল কথাটা কি স্পষ্ট করে বলুন।

সেলিনা আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আজ তিন বছর আগে থেকে ভালবেসে আসছি।

তার কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠি। তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেম-ভালবাসা এই শব্দগুলোর ডেফিনেশান জানেন?

ডেফিনেশান টেফিনেশান আমি বুঝি না। যা বললাম তা ধ্রুব সত্য। এর মধ্যে কোনো বাচালতা নেই। বাচালতাকে আমি ঘৃণা করি। সোজা পথে চলি। বাঁকা পথ চিনি না। আমার বিবেক যখন প্রেমকে এই বলে বোঝাতে চেয়েছে, একজন অজানা অচেনা লোককে ভালো লাগলেও তার সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে কিছুতেই আবদ্ধ হওয়া যায় না। তখন আমার প্রেম বিদ্রোহ করে বলেছে, প্রেম কোনোদিন পাত্র বিচার করে না। যে পাত্রের বিচার করে, সে আসল প্রেম থেকে বঞ্চিত। আসল প্রেমিক অনল জেনেও তাতে ঝাঁপ দেয়, যদিও সে জানে অনলে ঝাপ দিলে পুড়ে যাবে তবুও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার প্রেম সত্য। একদিন না একদিন তার জয় হবেই হবে। কথা শেষ করে চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তার কথা শুনতে শুনতে হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকেই চেয়ে ছিলাম। চোখে, চোখ পড়তে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলাম। ভাবলাম, এই সমস্ত কথা ও শিখল কোথায়? নিশ্চয় আউট বই অনেক পড়েছে। গত কয়েকদিনের ব্যবহারে এবং আজকের ঘটনা দেখে মনে হল, তার মধ্যে কোনো মিথ্যা বা অভিনয় নেই। হয়তো, সত্যিই অনেকদিন থেকে আমাকে ভালবেসে আসছে। কখাটা চিন্তা করে আমার খুব দুঃখ হল। কারণ সে অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেছে। আমার দিক থেকে সবচেয়ে প্রথম এবং বড় বাঁধা, আমি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। দ্বিতীয়তঃ আমি একটা লাইব্রেরীর সেলস ম্যানেজার। মাত্র পাঁচশো টাকা বেতন পাই। যদিও আমার একটা সাইড বীজনেস থেকে মাসে এক হাজার টাকা আসে। তবুও এদের সঙ্গে আমার কোনো তুলনা হয় না। আমার স্ত্রী স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র মেয়ে। সে সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। আমাদের দাম্পত্য জীবনে এতটুকু অশান্তি নেই। আমরা উভয় উভয়েকে খুব ভালবাসি। তাকে ছাড়া জীবনে অন্য কোনো মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিনি। আমার স্ত্রীর মধ্যে এমন কোনো খুঁৎ নেই, যেটা নিয়ে আমি অন্য মেয়ের দিকে চেয়ে তুলনা করব। আমার দেহের গড়ন একহারা হলেও খারাপ না। ছেলেবেলা থেকে আমি খুব কর্মঠ, মাঠে ফসল ফলিয়েছি। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ এবং বিয়ের চার বছর পর পর্যন্ত ব্যায়ামবীর মনোতোষ রায়ের ছাত্র ছিলাম। এই সর্ব প্রথম সেলিনাকে ভালো করে দেখার ইচ্ছা হওয়ায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম। দেখতে সুন্দরী, কিন্তু গুণবাচক নয়। রংটা বেশ ফর্সা। মনে হল আঠার বিশ বছরের মেয়েরা যে সমস্ত কারণে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, তার সব কয়টা গুণ তার শরীরে আছে। আমার কাছে সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল তার চোখ। যেন কত গভীর প্রেম ঐ চোখের চাহনীর মধ্যে রয়েছে। আমি সেই চোখের দিকে চেয়ে প্রেমের সাগরে বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।

সেলিনা আমার দিকে চেয়ে চোখের ভাষা পড়ে নিচ্ছিল। সে নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, আপনি এতক্ষণ ধরে কি ভাবছেন? কিছু বলুন। আমার কথা আমি বলেছি, আপনার কথা শোনার পর আরও কিছু বলব।

আমি কি বলব চিন্তা করতে করতে ঘড়ি দেখলাম, বেলা এগারটা।

আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে সেলিনা বলল, আমার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে, আপনাকে নাস্তা খাওয়ান হয়নি।

তার আর দরকার নেই। নাস্তা আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। এখন কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আমার মধ্যে কি এমন জিনিস দেখলেন, যার ফলে প্রেমে পড়ে গেলেন? আমি দেখতে তেমন সুন্দর নই, স্বাস্থ্যও খুব ভাল নয়, যা মেয়েদেরকে সর্ব প্রথম আকর্ষণ করে। তাছাড়া আমি দোকানের একজন সামান্য : কর্মচারী, তাতেই নিশ্চয় বোঝেন আমার আর্থিক অবস্থা।

আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কিছুক্ষণ আগে বলেছি। আবার যদি শুনতে চান তাহলে ঐ একই কথা বলব।

আর কোনো প্রশ্ন না করে প্রায় আদেশের স্বরে বললাম, আমার পরিচয় বলছি, মন দিয়ে শুনুন। তারপর চিন্তা করে দেখবেন, কি করবেন।

আমি আপনার পরিচয় শুনতে চাই না।

ধমক দিয়ে বললাম, আপনি শোনতে না চাইলেও আমি শুনাব। কারণ আমার। পরিচয় জানা আপনার একান্ত কর্তব্য। আমি আপনার এত কথা শুনলাম, আর আপনি আমার সামান্য পরিচয়টুকুও শুনতে চান না? সেলিনা আর কোনো আপত্তি না করায় বলতে আরম্ভ করলাম।

১৯৬৫ সালে আমি একজন রিফিউজী হিসাবে পশ্চিম বাংলা থেকে স্বস্ত্রীক ঢাকায় আসি। আমি ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী শুরু করি। আর নাইট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে থাকি। সে বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সতের দিনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার কয়েক মাস পর আমার ছোট বোনের স্টুল পরীক্ষা করার জন্য তার স্বামীর সঙ্গে গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কলিকাতার এক বড় ডাক্তারের কাছে যাই। আমাদের গ্রাম থেকে কলিকাতার দূরত্ব পঁয়ত্রিশ মাইল। কলেজ স্ট্রীটের মোড়ের এক দোকান, থেকে সিগারেট কেনার সময় এক ভদ্র লোককে ডাক্তারের ঠিকানা দেখিয়ে লোকেশানটা জিজ্ঞেস করলাম। এমন সময় সেখানে কয়েকজন গুণ্ডা ধরনের লোক এল। তাদের মধ্যে একজন আমাকে লক্ষ্য করে বলল, শালা নেড়ে এখনও পাকিস্তান যায় নি? এই কথা বলে আমাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে একটা বড় বাড়ির আঙ্গিনায় একধারে দাঁড় করিয়ে বলল, শালা নেড়েকে কেটে ফেলব। ঐ দেশের হিন্দুরা মুসলমানদেরকে সাধারণতঃ নেড়ে বলে বিদ্রুপ করে থাকে। আমার তখনও দাড়ী ছিল। জীবনের প্রথম থেকেই দাড়ী রেখেছি। তার উপর পাজামা। পাঞ্জাবী পরেছিলাম। তাই তারা আমাকে সহজে মুসলমান বলে চিনেছিল। আমার ছোটবোনের স্বামী ধুতি ও শাট পরেছিল বলে তাকে সন্দেহ করে নি। যাই হোক, রাখে আল্লাহ মারে কে? হঠাৎ কোথা থেকে চার পাঁচজন ছাত্র ধরনের ছেলে এসে তাদের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করে দিল। তাদের মধ্যে থেকে একজন আমার হাত ধরে গেটের বাইরে এনে বলল, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। দেখলাম, তখনও ছোট বোনের স্বামী করুণ দৃষ্টিতে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। আসার সময় ভিতরের ঘটনা তাকে বললাম। সেদিন স্টুল পরীক্ষা না করেই আমরা বাড়ি ফিরে আসি। তারপর সবাইকে জানালাম; আমি আর এখানে থাকব না, পাকিস্তান চলে যাব। কারণ জিজ্ঞেস করলে সবাইকে উক্ত ঘটনা বলতাম। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। আমি বাপের বড় ছেলে। ছোট ভাইটি তখন ক্লাস টেনে পড়ে। বোনেদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের সংসার মোটামুটি স্বচ্ছল। চাষের ধান ও তরি-তরকারী, পুকুরে মাছ এবং ঘরের গরুর দুধ কোনোটারই অভাব ছিল না। কিছুদিন আগে থেকে আম্মা আব্বাকে বলে আসছিল, খোকার বিয়ে দিয়ে বৌ আন। আমি আর কত দিন তোমাদের সংসারের ঘানি টানব? শুধু আব্বা আম্মা -আমাকে খোকা বলে ডাকেন। আব্বা তখন বললেন, পঁচিশ বছরের নিচে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া উচিত না। আমার বয়স তখন বিশ বছর। আমি যখন (পুর্ব পাকিস্তানে) বর্তমানে বাংলাদেশে চলে আসব বললাম। তখন হঠাৎ করে আব্বা তার ফুপাতো ভাইয়ে সঙ্গে শলা পরামর্শ করে একরাতে তার মেয়ের সঙ্গে আমার জবরদস্তি বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দুঘন্টা আগেও তাদের পরামর্শের কথা জানতাম না। আমি খুব ছেলেবেলা থেকে ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। আমার দাদাজী বলতেন, ভাই, জীবনে কোনোদিন কোনো কারণেই নামায রোযা ত্যাগ করো না। আর আব্বা বলতেন, অনেষ্টী ইজ দা বেষ্ট পলিসি। আমি তাদের উপদেশ সামনে রেখে সব সময় চলে আসছি। তাই মনে হয় আল্লাহপাকের রহমতে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হইনি। আমার বিয়ে দিয়েও তারা আমাকে ধরে রাখতে পারলেন না। সুযোগমতো স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসি। সব কথা বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে, তাই সংক্ষেপে বললাম। এখানে আসার পর থেকে এই লাইব্রেরীতে চাকরি করছি।

আমার পরিচয়তো শুনলেন! এখন চিন্তা করে দেখুন, আমি কি আপনার উপযুক্ত? আপনার এত ভালবাসার মুল্য কি করে আমি দেব? আপনি বিরাট বড়লোকের মেয়ে। আমার মত দীন-হীনকে ভালবেসে সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভাসবেন। আমি বিবাহিত ছেলেমেয়ের বাবা। সেটা সবচেয়ে বিরাট বাধা বলে আপনার মনে হওয়া উচিত। আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন শুনে আমার অন্তর গর্বে ফুলে উঠতো, যদি আমি আপনার উপযুক্ত হতাম। তবে আপনার ভালবাসার কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। কুল ব্রেনে আপনাকে জানাচ্ছে, আমি আপনার কোনো উপকারে আসব না। একটা কথা আপনাকে বলি শুনন, আমার জানাশোনা আপনাদের সমপর্যায়ভুক্ত অনেক ভাল ছেলে আছে। আপনার ভালবাসার মুল্য বাবদ তাদের একজনের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ করে দিতে পারি। এই কয়েকদিনের মধ্যে আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে করে আপনার মনের মত ছেলে চয়েস করে দিতে আশা করি পারব। মনে হয় তাতে ঠকবেন না। বাকিটা আপনার তকৃদির। মানুষ সুখ-শান্তির জন্য যত চেষ্টাই করুক না কেন, সব কিছুর চাবিকাঠি সেই উপরওয়ালার হতে।

ঠিক আগের মত আদেশের স্বরে সেলিনা বলে উঠল, থামুন, আমি আর ঐ সমস্ত কথা শুনতে পারছি না। আশা করি, আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে?

আপনি যদি কথা না বাড়ান, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেলিনা বলল, বারটা বেজে গেছে, ডিনার খাওয়া যাক বলে কলিং বেলে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন?

বললাম, এখানে কিছু খাব না; বাসায় গিয়ে খাব।

এমন সময় বেয়ারা এলে তাকে সেলিনা দুপ্লেট মুরগীর বিরানী অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যেতে বলল, প্রতিদিন তো বাসায় খান, আজ আমি আপনাকে আমন্ত্রণ করে এনেছি, এখানে খেতেই হবে, কোনো কথা শুনবো না।

আবার কি করতে কি করে বসবে ভেবে কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম।

বেয়ারা খাবার নিয়ে এলে তাকে সেলিনা গাড়ির নাম্বার ও কালারের বর্ণনা দিয়ে বলল, এই গাড়ি যদি গেটে থাকে, তাহলে ড্রাইভারকে খেয়ে নিতে বলুন। তারপর তাকে আরও কি সব অর্ডার দিয়ে নিজের প্লেট থেকে এক টুকরো মাংস আমার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, নিন শুরু করুন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও অল্প কিছু খেলাম। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। আবার কি বলবে না কোথাও যাবে এইসব মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম।

আমাকে অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়া শেষ করতে দেখে সেলিনা বলল, আপনি এত তাড়াতাড়ি খান কি করে? আপনার ঠিকমত হজম হয়?

কেন? আমাকে দেখে কি পেটের অসুখের রুগী বলে মনে হয়?

না তা হয় না, তবে খাবার সময় ধীরে সুস্থে খেতে হয়।

তা ঠিক, তবে আমার জীবনের অভিধানে স্লো বলে কোনো কথা লেখা নেই। শুধু নামাযের বেলায় এর ব্যতিক্রম হয়।

কেন নামাযের সময় ব্যতিক্রম হয় কেন?

নামায হল মোমেনদের (বিশ্বাসীদের) মেরাজ স্বরূপ। অর্থাৎ স্কুল মোখলুকাতের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দিদার। তাঁর স্ততি গেয়ে নিজের অপরাধ ও অপারগতা স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে করুণা ভিক্ষা করা। এই কাজ কি আর তাড়াতাড়ি করা যায়? হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যারা অনেক ধন দৌলত চুরি করে, তারা বড় চোর নয়। বরং তারাই বড় চোর, যারা নামাযের সবকিছু আদায় না করে তাড়াতাড়ি নামায পড়ে।

সেলিনা খাওয়া বন্ধ করে আমার কথা শুনল। তারপর লজ্জায় হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক আর খেল না।

খাওয়া শেষে হওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, চলুন উঠা যাক। আশা করি, আপনি আমার কথা চিন্তা করে আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবেন।

সেলিনা বলল, আপনার বলার পর আমি কিছু বলব বলেছিলাম; কিন্তু আপনি যে রকম তাড়াহুড়া করছেন, বলতে সাহস পাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে আগামী ছুটির দিনে এখানে আসবেন।

এখানে আসবার আর কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া প্রত্যেক ছুটির দিন আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সপ্তাহে মাত্র একদিন ছুটি পাই, সংসারে নানা রকম কাজ কর্ম থাকে।

মিনতি স্বরে সেলিনা বলল, শুধু আর একটা দিন। পরে আর কোনো দিন অনুরোধ করব না।

একটু ভেবে বললাম, এই কথা যেন মনে থাকে। আর আগামী ছুটির দিন। নয়, তার পরের সপ্তাহের ছুটির দিন পার্কের দক্ষিণ দিকের গেটে বিকেল তিনটেয় আসব।

আমরা কথা শুনে তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর চোখ দুটো পানিতে ভরে গেল। ফেরার সময় সেলিনা বিলের সঙ্গে বেয়রাকে দশ টাকা বখশিস দিল। তারপর আমার কথামতো আমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

বাসায় ফেরার জন্য রিকশায় উঠলাম। মনের মধ্যে তখন নানা রকম চিন্তা হতে লাগল। বাসায় এসে স্ত্রীকে বললাম, হোটেলে খেয়ে এসেছি, শরীরটা ভাল লাগছে না, আমি এখন ঘুমোব। ঘুমোতে গিয়ে চোখ বন্ধ করা সার হল। শুধ সেলিনা ও তার মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল। মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হতে বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলাম। তারপর লুংগীর উপর পাঞ্জাবী চড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন আমি বাংলা বাজারে থাকতাম। সবকিছু অস্বস্তি লাগছিল। কেবলই মনে হতে লাগল স্ত্রীর কাছে যেন কত বড় অন্যায় করে ফেলেছি। হাঁটতে হাঁটতে সদর ঘাটে নদীর ধারে গিয়ে একটা নৌকা ভাড়া করে মাঝিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে যেতে বললাম। নদীতে কত রকমের নৌকা, ষ্টিমার, লঞ্চ দেখতে দেখতে মন থেকে চিন্তা দুর করার চেষ্টা করলাম। তাতে বিশেষ ফল হল না। আসরের আজান শুনে পাটুয়াটুলির বড় মসজিদে নামায পড়ে আল্লাহপাকের দরবারে ক্ষমা চেয়ে শান্তি প্রার্থনা করলাম। মনটা বেশ হালকা হল; কিন্তু বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারলাম না। তাকে দেখে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। আমার স্ত্রী শরীরের কথা জিজ্ঞেস করতে বললাম, শরীরটা ভালো না। সেইজন্য মনটাও খারাপ। কিছু যেন ভালো লাগছে না। এই কথা বলার পর অস্বস্তি ভাবটা আরও বেড়ে গেল। স্ত্রীর কাছে কখনও মিথ্যা বলিনি। আজ মিথ্যা বলে নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে গেলাম। এই অস্বস্তি ভাবটা দুতিন দিন ছিল। শেষে চিন্তা করলাম, যে ভাবেই হোক সেলিনাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দুরে সরিয়ে দিতে হবে, তাহলে আমি আবার শান্তি ফিরে পাব।

 ২. নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময়

নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বললাম, আমার ফিরতে হয়তো একটু রাত হতে পারে, তুমি কোনো চিন্তা করো না।

সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো এভাবে বলে কখন কোথাও যাওনি? মনে হচ্ছে এই কদিন যেন কিছু ভাবছ?

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, পাগলী, তোমাকে কি করে সুখী করব সেই কথা ভাবছি। এই অকাট্য মিথ্যা বলতেই আমার মনের মধ্যে সুঁচের মতো বিঁধল।

আদরের প্রতিদান দিয়ে আমার স্ত্রী বলল, আমি এর চেয়ে বেশি সুখ চাইনি। তোমার হাসি মুখ দেখলেই শান্তিতে আমার মন ভরে যায়। আল্লাহপাক যেভাবে রেখেছেন তাতেই আমরা শোকর করে থাকব। আমার জন্য তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।

স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনটের অনেক আগেই পার্কের গেটে পৌঁছলাম। ইচ্ছা ছিল পার্কটা একটু ঘুরে দেখব। কিন্তু রিকশা থেকে নেমেই সেলিনাকে একটি মেয়ের সঙ্গে গেটের ভিতর কথা বলতে দেখলাম। তাদের সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোকও রয়েছেন।

আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে আমাকে সালাম দিয়ে বলল, এখন আড়াইটা বাজে। আমি জানতাম, আপনি ঠিক তিনটেয় আসবেন। কেমন আছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবুজ রং এর শাড়ী ও ব্লাউজে খুব সুন্দর মানিয়েছে।

চোখে চোখ পড়তে সেলিনা বলল, কি দেখছেন? কথা বলছেন না কেন?

বললাম, ওরা কারা?

ভদ্রলোক আমার খালু, আর মেয়েটি খালাতো বোন। গতকাল সিলেট থেকে আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওরা পার্ক দেখে কোথায় যেন যাবে। আমাকে সঙ্গে থাকতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। বলেছি একজনকে তিনটের সময় এখানে। আসতে বলেছি, তার সঙ্গে বিশেষ দরকার আছে। রেষ্টুরেণ্টে যাই চলুন।

না, বরং কোনো নির্জন জায়গায় বসা যাক। হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে আড়াল দেখে ঘাসের উপর দুজনে পাশাপাশি বসে পড়লাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, চিন্তা ভাবনা করে কি ঠিক করলেন?

সেলিনা লেকের পানির দিকে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে চেয়ে রইল। তারপর ঘুরে আমার মুখোমুখি বসে বলল, আমি আমার ফাইন্যাল মতামত বলছি শুনুন, মরে গেলেও আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারব না। আমাকে কোনো কারণ দেখিয়ে ভুলাতে পারবেন না। আমি আপনাকে ভালবেসেছি, আপনার পরিচয়কে নয়। সে জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় করব, যত দুঃখ সহ্য করতে হয় করব, তবু আপনাকে হারাতে পারব না।

অবাক হয়ে বললাম, আপনি পাগলের প্রলাপের মত কথা বলছেন। কোনো সুস্থ মানুষ এই রকম কথা বলতে পারে না। আমার কাছ থেকে আপনি দৈহিক, মানষিক ও আর্থিক কোনো দিক থেকেই এতটুকু সুখ-শান্তি পাবেন না, বরং পাবেন শুধু অবহেলা আর অশেষ দুঃখ। আপনি ধনীর দুলালী, এইসব সহ্য করতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো মেয়েই প্রেম দিয়ে এইগুলো ক্রয় করতে চাইবে না। অনেকে শত দুঃখ সহ্য করতে পারলেও স্বামীর অবহেলা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।

সেলিনা আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, আপনি এইসব কথা বলবেন না। পৃথিবীর মেয়েরা প্রেম দিয়ে কি খরিদ করে তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, প্রেম দিয়ে প্রেম খরিদ করব। সে জন্য আপনি আমাকে যত দুঃখ দেন, যত অবহেলা করুন না কেন, সবকিছু আমি নীরবে সহ্য করব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে আমি প্রেম দিয়ে একদিন না একদিন জয় করবই করব। পৃথিবীর কোনো বাধাই আমি মানব না। প্রয়োজন হলে চির কুমারী থাকব। যদি তা না পারি অন্যের অঙ্কশায়িনী হওয়ার আগে আত্মহত্যা করব। জানব, এটাই আমার তকৃদির। দেশী বিদেশী অনেক বই পড়েছি। জেনেছি, প্রেম মানেই দুঃখ। লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স। সুতরাং দুঃখের কথা বলবেন না। আমাকে বিয়ে করতে হয়তো আপনার অনেক বাধা থাকতে পারে। অথবা আমাকে নষ্ট চরিত্রের মেয়ে ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরে যেতে পারেন। তবু আমি আমার প্রেমকে চিরকাল বাচিয়ে রাখব। তাতে অক্ষম হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেব।

ভাবলাম, ও আমাকে এত বেশি ভাল বেসে ফেলেছে যে, যদি আমাকে না পায়, তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে ফেলবে। খুব চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে। আমি আপনাকে একটা চিঠি দেব, তার উত্তর পাওয়ার পর ভবিষ্যতে কি করব জানব। কথাগুলো বলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার মুখের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সেলিনা আমার ডান হাতটা দুহাতে ধরে প্রথমে চুমো খেল, তারপর নিজের দুগালে ঘষতে লাগল।

আমার হাত তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল। আমার কাছ থেকে নাম মাত্র আশ্বস পেয়ে সেলিনা আনন্দ অশ্রু ফেলতে লাগল। তার গভীর প্রেমের পরিচয় পেয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। অনুভব করলাম, আমি তার গভীর প্রেমের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি? পরক্ষণে আমার স্ত্রীর মুখ মনে পড়তে স্বজ্ঞানে ফিরে এলাম। হাতটা টেনে নিয়ে বললাম, ইসলাম এইজন্য মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছে। আর নির্জনে যুবক যুবতীর সাক্ষাৎও হারাম। করেছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কখনও কোনো বেগানা মেয়েকে স্পর্শ করি নি। জানি না, আল্লাহপাক আমাকে ক্ষমা করবেন কি না। আমি আপনার ডাকে আসতাম না। যদি না আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করতেন। আর এই যোগাযোগ বন্ধ করার জন্যই আজ এসেছি। ভেবেছিলাম, আমার পরিচয় পেয়ে ঘৃণা করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এখন দেখছি সে ধারণা ভূল। আপনাকে আমার সত্য পরিচয় দিয়ে শত বাধা বিপত্তির কথা বলে যতই দুরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি, আপনি ততই প্রেমের জাল বিস্তার করে আমাকে ঘিরে ফেলছেন। উপরের মালিকই জানেন আমার কি হবে?

সেলিনা রুমালে চোখ মুখ মুছে বাদাম ওয়ালার দিকে গেল। আমি লেকের। পানিতে অজু করে ঐখানেই ঘাসের উপর আসরের নামায পড়লাম। সেলিনা ফিরে এসে আমার নামায পড়া দেখছিল। নামায শেষ করে টুপিটা পকেটে রেখে বললাম, যাবেন না বসবেন?

কিছু না বলে সেলিনা বসে পড়ল। তারপর বাদামের ঠোঙাটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, নিন খান।

বাদাম নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা নামায পড়েন?

আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে না।

আসরের নামায পড়বে না?

কথাটা শুনে সেলিনা প্রথমে চমকে উঠল। তারপর আমার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে কেমন করে পড়ব? বাসায় গিয়ে পড়ব।

তার চমকে উঠার কারণটা বুঝতে পারলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে নামায পড়ছ?

যখন থেকে আপনার প্রেমে পড়েছি।

প্রেমের সঙ্গে নামাযের কি সম্পর্ক?

তা বলতে পারব না। শুধু এইটুকু মনে হয়েছে, নামায পড়া আল্লাহপাকের হুকুম। তার হুকুম পালন করলে আপনি নিশ্চয় খুশী হবেন। তাই আমার প্রেম নামায পড়তে বলেছে।

মেয়েদের মাথায় কাপড় বা রুমাল দিয়ে চুল ঢেকে রাখাওতো আল্লাহপাকের হুকুম।

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনা শাড়ীর আঁচল মাথায় দিল। তারপর থেকে তাকে কোনোদিন মুহুর্তের জন্যও খালি মাথায় দেখিনি। তারপর বললাম, চল উঠা যাক, নচেৎ তোমার আসরের নামায কাযা হয়ে যাবে। কেউ যদি ইচ্ছা করে এক ওয়াক্ত নামায কাযা করে (না পড়ে), তবে তাকে আশী হোকবা দোজখে জ্বলতে হবে। (এক হোকবা সমান দুই কোটি অষ্টআশী লক্ষ বছর)।

সেলিনা, উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে বলল, একটা অনুরোধ করব রাখবেন?

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

এতক্ষণ যে সম্বোধনে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সব সময় সেই সম্বোধনে বললে খুব খুশী হব।

চিন্তা করলাম, সে আমার অন্তরের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। ফলে মনের অজান্তে তাকে এতক্ষণ তুমি করে সম্বোধন করেছি। আর সেই কারণে সেলিনা বোধ হয় তখন চমকে উঠেছিল।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবেন?

বললাম না, আমার মাথার মধ্যে তখন চিন্তার পোকাগুলো কিলবিল করতে আরম্ভ করেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, সেলিনা বুঝতে পেরেছে যে, সে আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে। নিজের উপর খুব রাগ হতে লাগল এবং তার সূত্রটা খুঁজতে গিয়ে সেলিনাই দায়ী বলে মনে হল। তখন সমস্ত রাগটা তার উপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। কারণ রাগের সঙ্গে কিছু বললে, তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। আর সেলিনার ক্রন্দসী মুখটা আমাকে বড় বেশি ব্যথা দেয়। অনেক কষ্টে সম্বরণ করে নিলাম।

গেটে এসে সেলিনা বলল, আপনাকে কোথায় পৌঁছে দেব বলুন?

আচ্ছা, আপনি আমাকে কি মনে করেন? কোথাও পৌঁছাতে হবে না, আমি নিজেই যেতে পারব। রাগান্বিত অবস্থায় চিন্তিত ছিলাম বলে কথাগুলো একটু রাগের সঙ্গে বলে ফেলেছি। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো বর্ষায় পুরিপূর্ণ। নিজেকে সংযত করে বললাম, আমি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। অন্যমনস্কতায় একটু রেগে বলে ফেলেছি। এবার আসি, আল্লাহ হাফেজ বলে একটা রিকশায় উঠে বায়তুল মোকাররাম যেতে বললাম। সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, আর তার চোখ থেকে শ্রাবণের ধারা ঝরছে। বায়তুল মোকাররামে মাগরিবের নামায পড়ে অনেকক্ষণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে মোনাজাত করলাম

আয় পরওয়ারদেগার রহমানুর রাহিম, তোমার মোবারক নামে শুরু করিতেছি। তুমি অনাদি অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তুমি সর্বত্র সব সময় বিরাজমান, তুমি অসীম করুণাময়, ধৈৰ্য্য ও ক্ষমার আধার। আমি তোমার আঠার হাজার মাখলুকের শ্রেষ্ঠ মাখলুকের একজন নাদান বান্দা। তোমাকে আমার রেজেক যোগাতে হবে, আমার আশা-আকাঙ্খার কথাও শুনতে হবে। সর্ব প্রথম পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর রুহমোবারকের উপর তোমার রহমতের ধারা বর্ষণ কর। তারপর দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর-নারীর উপর তোমার রহমতের দরজা উম্মুক্ত করিয়া দাও। দয়াময়, তুমি আমার মনের খবর জান। এই পাপী বান্দা বিবাহতি হইয়াও একটি নারীর প্রেমে দিন দিন আসক্ত হইয়া পড়িতেছি। তুমি উত্তম ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি উত্তম সৎপথ প্রদর্শনকারী, আমাকে সৎপথে চলার তওফিক দান কর। হে রাব্বল আলামিন, আমি কি করব বলে দাও। একদিকে আমার স্ত্রীর গভীর ভালবাসা, আর অন্যদিকে একটি মেয়ে প্রেমের দাবীতে আত্মহত্যা করতে চাইছে। তুমি উত্তম ফায়সালাকারী, আমি তোমার কাছে ফায়সালা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি ফায়সালা করে দাও। জানি তোমার আইন : অনুযায়ী চারটে পর্যন্ত বিবাহ হালাল। কিন্তু সেটাও তো প্রয়োজনের তাগিদে। আরও জানি তুমি বলেছ বান্দা যদি সব স্ত্রীকে সমানভাবে রাখতে না পারে তবে যেন সে একটাতে সন্তুষ্ট থাকে। হে গাফুরুর রাহিম, তুমি সবকিছু জান, সারা জাহানে যা কিছু হচ্ছে তোমার হুকুমেই হচ্ছে। তুমি আমার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে আমার এই দোয়াকে কবুল কর। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর এবং সমস্ত আম্বিয়া (আঃ)-এর উপর শান্তি বর্ষণ কর। আমিন সুম্মা আমিন।

তারপর এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরি।

.

দোকানে কয়েকদিন ধরে অবসর সময়ে সেলিনাকে একটা চিঠি লিখলাম— সেলিনা,

এই চিঠি পড়ে তুমি যদি আমাকে ঘৃণা করে ও কাপুরুষ ভেবে তোমার মন থেকে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে আমি অত্যন্ত খুশী হয়ে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করব। অনেক চিন্তা করে দেখেছি, তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আমার স্ত্রীর ভালবাসাকে অপমান করে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। তোমাকে বিয়ে করলে আমি, আমার স্ত্রী ও তুমি, তিনজনেই সারাজীবন অশান্তির আগুনে জ্বলব। মেয়ে হয়ে তুমি নিশ্চয় জান, মেয়েরা সবকিছু। দিতে পারে; কিন্তু স্বামীর ভাগ কিছুতেই দিতে চায় না। তাছাড়া এই বিয়ে হলে তোমার সব গার্জেন তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বিয়ের প্র হয়তো তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তুমিই বল, তোমাকে তখন আমি রাখব কোথায়? নিজের বাসাতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়; আর বাসা ভাড়া করে অন্য জায়গায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হলেও আমি তা পারব না। এই কয়েকদিনের মধ্যে বুঝেছি তুমি বড় একরোখা। যা মনে আসে তাই কর। একরোখা স্বভাবটা ভাল, তবে সবক্ষেত্রে নয়। তোমার বয়স কম, দুনিয়াদারীর অভিজ্ঞতাও কম। সংসার এমন জটিল জায়গা যে, সেখানে সব ক্ষেত্রে একরোখা ভাবে চললে বহু ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। যা সারাজীবনেও পুরণ করা যায় না। আমি স্বীকার করছি, তুমি নিষ্কলুসভাবে আমাকে ভালবাস। তাই বলে আমাকে বিয়ে করতে হবে এমন কথা ভাবছ কেন? অন্য যে কোনো সম্পর্কে আমরা আবদ্ধ হতে পারি। তুমি ধনী ঘরের মেয়ে। তোমার চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-পরিচ্ছদ সবকিছু আমাদের সঙ্গে আকাশ পাতাল তফাৎ। তুমি লেখাপড়া করেছ, তোমার একরোখা ভাবটা দূরে সরিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করে দেখ, আমি তোমার ভাল চাই, না মন্দ চাই? যদি জানতে চাও আমি তোমাকে ভালবাসি কি-না? তার উত্তরে বলব, তোমার মত মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। উপন্যাসের নায়িকাদেরকেও তুমি হার মানিয়েছ।
বিয়ের আগে কোনো মেয়েকে ভালবাসার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিয়ের পর, নিজের স্ত্রীকে মনে প্রাণে ভালবেসেছি। কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যে তুমিও আমার অন্তরে কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছ। এটা হয়তো নিয়তির একটা নির্মম পরিহাস। তোমাকে কিছুটা ভালবেসে ফেলেছি বলে আন্তরিকভাবে তোমার ভালো চাই। আমার সঙ্গে তোমাকে জড়ালে আমার ভালবাসাকে বিষপান করান হবে। তাই তোমাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। ভালবাসার খাতিরে তোমার কিসে ভালো হবে আমি যেমন চিন্তা করছি, তুমিও তো আমাকে ভালবেসেছ, তোমারও কী চিন্তা করা উচিত না, কিসে আমার ভালো হবে? এই সমস্ত কারণে তোমাকে তোমার একগুয়েমী জিদ ছাড়তে হবে। জানি, তুমি এই চিঠি পড়ে কাঁদবে, তবু লিখলাম। ফারণ না লিখে আমার আর কোনো উপায় নেই। সবশেষে আর একটা কথা বলি, আমাকে যদি তুমি সত্যিই ভালবেসে থাক, তবে যা মনে আসে তা করো, কিন্তু আত্মঘাতিনী হয়ো না। এটা তোমার প্রেমের কসম। কেন না যারা আত্মহত্যা করে, তারা চির জাহান্নামী। আমি চাই না, আমার কারণে তুমি আত্মঘাতী হও।
আশা করি, চিঠিটা ধৈৰ্য্য ধরে পড়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।
ইতি—

চিঠিটা শেষ করে দোকানে আমার নিজস্ব ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখলাম। প্রায় দশ বার দিন পর একদিন আমি জোহরের নামায পড়ার জন্য মার্কেটের ভিতরের মসজিদে যাওয়ার পথে সেলিনাদের ড্রাইভারের সাথে দেখা। সে আমাকে একটা ছোট কাগজ দিয়ে বলল, খুকীভাই গেটের বাঁ দিকে গাড়িতে বসে আছে। কথা শেষ করে ড্রাইভার চলে গেল। আমি কাগজটা পকেটে রেখে অযু করে নামায পড়লাম। তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে কাগজটা পড়লাম

সালামান্তে আপনার কাছে আরজ, এক্ষুনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
ইতি–
আপনার সেলিনা

দোকানে এসে ড্রয়ার থেকে চিঠিটা নিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে সালাম বিনিময়। করলাম তারপর চিঠিটা সেলিনার হাতে দিয়ে বললাম, সোজা বাড়ি চলে যাও।

আমাকে দেখে তার চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল; কিন্তু আমার কথা শুনে তা ম্লান হয়ে গেল। তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি দোকানে। ফিরে আসি।

এরপর প্রায় এক মাস সেলিনা আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তাতে করে মনটা বেশ হালকা হয়ে এল। ভাবলাম, চিঠিটা পড়ে হয়তো আমাকে কাপুরুষ ভেবে ভুলে যেতে চেষ্টা করছে।

সাহেবদের গাড়ি খারাপ থাকায় স্কুটারে করে তীতুমীর কলেজে একদিন বেলা দশটার সময় বই সাপ্লাইয়ের বিল আদায় করার জন্য যাচ্ছিলাম। মহাখালির রেল ক্রসিং পার হওয়ার আগে ট্রেন আসছিল বলে গেট বন্ধ ছিল। থামার সময় স্কুটারের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। গেট খুলে যাওয়ার পর আর স্টার্ট নিল না। তখন ড্রাইভার একটা রিকশা ঠিক করে দিল। রিকশা যখন মহাখালির দিকে বাঁক নেবে, ঠিক সেই সময় একটা প্রাইভেট কারকে আমার রিকশার দিকে দ্রুত আসতে দেখে খুব ভয় পেলাম। মনে হয়েছিল ভীষণ এ্যাকসিডেন্ট হবে। কিন্তু যখন গাড়িটা নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে গেল তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। তবু ড্রাইভারের উপর খুব রাগ হওয়ায় তাকিয়ে দেখি, সেলিনাদের গাড়ি। পিছনের সীট থেকে সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

রিকশাওয়ালা ড্রাইভারের সঙ্গে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে, তাকে থামিয়ে তার ভাড়া দিয়ে বললাম, ঝগড়া করে কাজ নেই। তারপর গাড়ির কাছে যেতে সেলিনা দরজা খুলে সালাম দিয়ে বলল, উঠে আসুন।

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে গাড়িতে উঠে বললাম, তীতুমীর কলেজে যাব। ড্রাইভার তা শুনতে পেয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। কলেজে পৌঁছে আমি একাই ভিতরে গেলাম। কাজ সেরে ফিরে এসে গাড়িতে বসার পর সেলিনা বলল, দাদু কন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) হোটেলে চলুন।

দাদু গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর বললাম, এখন কোথাও যেতে পারব না। আমাকে দোকানে যেতে হবে। গাড়ি যখন ক্যন্টনমেন্টের গেট পার হয়ে পুরান এয়ারপোর্টের কাছে এল তখন সেলিনা দাদুকে বলল, বাঁদিকের ঐ হোটেলটার সামনে রাখুন।

গাড়ি থামার পর নামার সময় জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

টুঙ্গী থেকে। খালার সঙ্গে তার দেওরের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি কুর্মিটোলা, এয়ারপোর্টে কন্ট্রাকটারী করেন। সেখানে একটা বাড়ি করে স্বপরিবারে থাকেন। আমরা কেবিনে গিয়ে বসলাম। সেলিনা বলল, খালাআম্মা নাস্তা করে আসতে বলেছিল। অত সকালে আমি কিছু খেতে পারি না, তাই চা বিস্কুট খেয়ে এসেছি। এখন নাস্তা করব বলে বেয়ারাকে দুপ্লেট মুরগীর মাংস ও পরোটার অর্ডার দিল।

বললাম, আমি কিছু খাব না, নাস্তা খেয়েছি।

আপনি না খেলে আমিও কিছু খাব না। আমার জন্য না হয় অল্প কিছু খান। বেয়ারাকে মুরগীর মাংস ও পরোটার বদলে দুটো করে বড় মিষ্টি ও স্লাইস রুটি দিতে বলল।

নাস্তা শেষে চা খেতে খেতে বলল, জানেন, আপনার চিঠি পড়ে কোনো কাজ হয়নি। বরং আপনাকে আরও বেশি ভালবেসে ফেলেছি। মনে হয়েছে আমাকে কাঁদাবার জন্য আর পরীক্ষা করার জন্য এই চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটা পড়ার সময়। আল্লামা ইকবালের একটা বয়েত আমার মনে পড়ে

জফা জো ইস্কমে হোতা হ্যায়
ওহ জফাহি নেহী,
সিতম না হো তো মহব্বত মে
কুছ মজা হি নেহী।

আমি ইডেন কলেজে পড়ি। অতএব আপনি সারাদিন আমার কাছেই থাকেন। যখন মন চায়, ক্লাসের অফ পিরীয়ডে মার্কেটে গিয়ে দূর থেকে আপনাকে দেখে আসি। আপনি যে এই রকম, চিঠি দেবেন। তা অনেক আগেই জানতাম। আমার প্রেম আপনার মনের সকল খবর বলে দেয়।

সেলিনার কথা শুনে খুব আশ্বৰ্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আমি কি ভাবছি বল তো?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ঐ চিঠি লেখার সময় যা ভেবেছিলেন, এখনও তাই ভাবছেন।

আরও বেশি আশ্বৰ্য্য বোধ করে আবার জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কী?

কেন, আপনি কী ঐ চিঠি লেখার সময় ভাবেন নি? এই চিঠিতে যদি কাজ না : হয়, তবে আরও একটা চিঠিতে জঘন্যতর কিছু লিখে আমার মনে ঘৃণা তৈরি করার চেষ্টা করবেন। এখনও আপনি সেই কথা ভাবছেন। কী? আমি সত্য বললাম কিনা বলুন?

আশ্চর্য ক্রমশঃ বেড়েই চলল। বললাম, তুমি নিশ্চয় সাইকোলজী ও এ্যাসট্রোলজীর অনেক বই পড়েছ?

আমি ঐ সব কিছুই পড়িনি। আমার প্রেম আমাকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। বলুন না, আমার কথা ঠিক কিনা?

স্বীকার করে বললাম, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি ড্রাইভারের পাশে বসলাম। মাথার মধ্যে তখন সেলিনার চিন্তা শক্তির কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।মনে হল। তার কাছে সব দিক থেকে হেরে যাচ্ছি। কিন্তু কেন? তবে কি সেলিনার গভীর প্রেম এর জন্য দায়ী? না আমিও তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলছি? আমি যখন, ঐসব ভাবছি তখন সেলিনা ড্রাইভার দাদুকে বলল, ওঁকে নিউ মার্কেটে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলুন।

তারপর প্রায় তিন মাস হয়ে গেল এর মধ্যে তেমন কিছু ঘটেনি। মাঝে মাঝে সেলিনা দোকানে এসে বই কিনে নিয়ে গেছে।

একদিন এসে বলল, আমাকে কয়েকটা ধর্মীয় বই দিন।

আমি মাওলানা আসরাফ আলি থানভীর (রা:) এর কুরআনের তফসীর ও গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী দিলাম। সেলিনা দুটোই কিনল। সে যখন দোকানে। আসত তখন আমি তাকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম, আর তার মুখের দিকে মোটেই তাকাতাম না।কারণ হঠাৎ করে যদি কিছু বলে বসে। তবে তাকে দেখার খুব ইচ্ছা হত। ইচ্ছাটাকে কঠোরভাবে দমন করে রাখতাম।

একদিন কাউন্টারের উপর বই দেখতে দেখতে ঝুকে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল,প্রতিজ্ঞা করেছেন বুঝি আমার মুখ দেখবেনা না? আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বলল, আমাকে আপনি বাইরের চোখে না দেখলে কি হবে, অন্তরের চোখে সব সময় দেখেন। তাই বাইরের দৃষ্টিকে সংযত রাখতে পেরেছেন। একটা কথাও বলবেন না? শেষের কথাটা কান্নার মত, শোনাল।

আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের বইটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নেবেন?

ছলছল চোখে সেলিনা বলল, হ্যাঁ।

আমি বইটা মেমো করে তার পিছনে লিখলাম, তোমার হাতের বইটি তো। তোমার সঙ্গে কথা বলছে না, কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলে ওটা থেতে অনেক কিছু। জানতে পার। তারপর মেমোটা তার হাতে দিলাম।

কিছু না বলে মেমো ও বইটা নিয়ে সেলিনা চলে গেল।

এই ঘটনার কিছুদিন পর ড্রাইভার একদিন আমাকে একটা বড় খাম দিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর খুলে দেখি বেশ বড় চিঠি পড়তে শুরু করলাম—

প্রিয়তম,
প্রথমে এই দীনহীনার শতকোটি সালাম নেবেন। আশা করি, পরম করুণাময় আল্লাহপাকের রহমতে আপনি ও আপামনি ছেলেমেয়েসহ ভালো আছেন। এই চিঠি পড়ে আপনি আমাকে হয়তো স্বার্থপুর ভেবে গৃণা করবেন। তবু আপনাকে আমার ইতিহাস বলা দরকার, তাই লিখছি। এর আগে অনেকবার বলতে ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু এতকথা শোনার সময় আপনার ছিল না, তাই বলিনি।
আমাদের আসল বাড়ি সিলেট শহরে। আব্বা পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। দাদুর আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। ছোট বেলা থেকে আব্বা খুব মেধাবী ছিলেন। স্কুল কলেজে সব সময় প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছেন। উনি যখন ডিগ্রীতে পড়েন। তখন তার ফুপাতো বোনের সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়। দুজনে একই কলেজে পড়তেন। আব্বা যখন ফাইনাল ইয়ারে আম্মা তখন ইন্টারমিডিয়েটে। আমাদের বাড়ির কাছে আব্বার ফুপার বাড়ি। মেয়েকে ভর্তি করে এসে উনি আব্বাকে বললেন, তুমি সময় করে আমার মেয়ে আয়েশাকে পড়াশুনার ব্যাপারে একট সাহায্য করো। তারপর থেকে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এই ব্যাপারটা উভয় ফ্যামিলির সবাই জানত। আব্বা যখন ব্যারিষ্টারী, পড়ার জন্য বিলেতে যেতে চাইলেন তখন দাদু বললেন, এত টাকা আমার নেই। তারচেয়ে তুমি বরং এল, এল, বি পাশ করে ঢাকায় প্রাকটীস কর। কথাটা আব্বার ফুপার কানে যায়। তাদের অবস্থা খুব ভালো। কিসের যেন ব্যবসা ছিল। একদিন তিনি এসে দাদুকে বললেন, মিঞা ভাই, আমার মেয়ে আয়েশার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মাঈনুলকে আর্মি রিলেত পাঠাব। আশা করি, আপনি দ্বিমত করবেন না। দাদু এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। আর আব্বার কথাই তো আলাদা। বিয়ের তিন মাস পর আব্বা বিলেত চলে যান। আম্মাও পরের বছর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আব্বার কাছে চলে যায়। ব্যারিষ্টারী পাশ করে আব্বা সেখানে প্র্যাকটীস শুরু করেন। আর আম্মাও গ্রাজুয়েসন নিয়ে একটা নার্সারী স্কুলে মাষ্টারী করত। আমাদের দুই বোনের জন্ম লন্ডনে। আমি সেখানে প্রায় দশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করি। দাদু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তারপর ঢাকায় হাইকোর্টে ওকালতি করতে থাকেন। বছর দুইয়েকের মধ্যে মালিবাগে জায়গা কিনে এই বাড়িটা করেন। বিলেত থেকে আসার সময় এই গাড়িটাও আনেন। আব্বা আমাকে বেশি আদর করতেন। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আমাদের কোনো ভাই নেই। আব্বা আমাদের দুই বোনের নামে এক লাখ টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখেন। উনি মারা যাবেন বলে হয়তো উইলও করে গেছেন। ব্যাংকের টাকা বিয়ের পর আমরা দুবোন স্বত্ত্বাধিকারী হব। তার আগে নয়। বাড়িটা আম্মার নামে হেবানামা করে গেছেন। আম্মা যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন আমরা এই বাড়িতে কোনো দাবী করতে পারব না। আম্মার মৃত্যুর পর আমরা দুবোন পাব। আম্মা ইচ্ছা করলে বাড়ি বিক্রী অথবা দানপত্র কোনোটাই করতে পারবে না। বাড়ির আয় থেকে প্রতি মাসে আমারা দুবোন প্রত্যেকে হাত খরচ বাবদ দুইশত টাকা পাই।
বিলেত থেকে এসে আমরা কিছুদিন দেশের বাড়িতে ছিলাম। আব্বা একা ঢাকায় থাকতেন। সেই সময় আম্মা দাদির সঙ্গে যুক্তি করে আব্বাকে না জানিয়ে তার বড় ভাইয়ের ছেলে সহিদের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন আমার বয়স। এগার বছর হবে। বিয়ে কি জিনিস আমি তখন জানতাম না। তবে কেমন যেন একটু কৌতূহল হয়েছিল। কানাঘুসো শুনেছিলাম, আব্বা বাড়িতে এলে খুব গোলমাল হবে। সে সব অনেকদিন আগের কথা; তবু কিছু কিছু মনে আছে! আব্বা ঢাকায় বাসা ভাড়া ঠিক করে আমাদেরকে নিয়ে যেতে আসলেন। রাত্রে খাওয়ার পর আব্বা দাদির ঘরে গেলেন। আমিও আব্বার সঙ্গে ছিলাম। দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, খুকীর বিয়ে আমি তোমার বড় সমন্ধির ছেলে সহিদের সঙ্গে দিয়েছি।
কথাটা শুনে আব্বা চমকে উঠলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমাকে না জানিয়ে এই কাজ করা ঠিক হযনি। তারপর দাদির ঘর থেকে আব্বা যখন নিজের ঘরে এলেন তখন আম্মা আব্বার পায়ে ধরে বলল, এই কাজ তোমাকে না জানিয়ে করে মস্ত বড় অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে। ক্ষমা করে দাও।
আব্বা ভিজে গলায় বললেন, আমাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। খুকীকে বেশি লেখাপড়া করার জন্য বিলেত পাঠাব বলে ভেবে রেখেছিলাম। সে আশা তুমি ভেঙ্গে চুরমার করে দিলে। তোমাকে আর কি বলব, সবই তকদিরের লিখন।
আম্মা বলল, সহিদ খুব মেধাবী। এ বছর ম্যাট্রিক দেবে। তারপর তাকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করব। ওদের দুজনের যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, সেই রকম ব্যবস্থা করে আমাদের মত ওদেরকেও বিলেত পাঠাব।
আব্বা বললেন, ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস। যেমন আমি ভেবে ছিলাম এক আর হয়ে গেল এক। জানি না, তোমার ইচ্ছা কতদূর সফল হবে। তারপর আর তেমন কিছু ঘটল না।
কয়েকদিন পর আমাদের সকলকে নিয়ে আব্বা ঢাকায় চলে আসেন। দাদিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চাইলে উনি বললেন, আমি আমার স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না।
পরের বছর আমি অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম। এদিকে সহিদ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতেই ছিল। আম্মা চিঠি দিয়ে ঢাকায় ডেকে পাঠায়। আল্লাহপাকের ইচ্ছা অন্য রকম। তাই সহিদ যেদিন ঢাকায় আসবে বলে ঠিক করেছিল, তার আগের দিন। রাত্রে হঠাৎ কলেরা হয়ে মারা যায়। ট্রাংকলে খবর পেয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে সিলেটে যান। আম্মার সেকি কান্না। সকলের কান্না দেখে আমিও কেঁদেছিলাম। আব্বা আমাদের রেখে পরের দিন প্লেনে ঢাকায় চলে আসেন। কারণ তখন তার একটা মাডার কেসের হিয়ারিং চলছিল। সহিদের কুলখানি হয়ে যাওয়ার পর যে দিন আমরা ঢাকায় চলে আসব, সেদিন আম্মাকে দাদির সঙ্গে কথা বলছে। দেখে আমি দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম আম্মা দাদিকে বলছে, আমি সহিদের ভাই জহিরের সঙ্গে আবার খুকীর বিয়ে দেব। দাদি বললেন, সে দেখা যাবে। এব্যাপারে কোনো কথা এখন উচ্চারণ কর না। ঢাকায় আসার সময় আম্মা দাদিকে বলল, জহিরকে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে পাঠাবেন। দাদি কোনো কথা বলেন নি। এরপর আমি আর দেশের বাড়িতে যাইনি,। আব্বা বোধ হয় কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আম্মা যখন দাদির কাছে দেশের বাড়ি যেত তখন আমাকে যেতে দিতেন না। আব্বা আমাকে বেশি ভাল বাসতেন। চিঠি খুব বড় হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সব কথা না জানিয়েও শান্তি পাচ্ছি না। সে জন্য মাফ চাইছি।
অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা যেদিন শেষ হল, সেদিন আমরা ভাড়া বাসা ছেড়ে আমাদের এই নতুন বাড়িতে আসি। কয়েকদিন পর জহির ভাই আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ঘুমাতে গেল। আমি প্রতি দিনের মতো আব্বার চেম্বারে তার পাশের চেয়ারে বসলাম। একটা কেসের ব্যাপারে উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন, তাই আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। আমি চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ি। আব্বার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যেতে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাই। তখন গ্রীষ্মকাল। অনেক রাত্রে কার গরম নিশ্বাস মুখের উপর পড়তে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম, কে যেন আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। প্রথমে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। মাথার কাছে বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালতে দেখি, জহির ভাই। ততক্ষণে সে খাটের উপর আমার পাশে বসেছে। আমিও উঠে বসে বললাম, জহির ভাই, তুমি এত রাতে এখানে কেন?
সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আলো নিভিয়ে দাও।
আমি বললাম না, তুমি আগে চলে যাও।
জহির ভাই বলল, আমি কেন এসেছি, তুমি কি বোঝনি?
আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, তুমি কি বলতে চাইছ? (কারণ সেক্স সমন্ধে আমার তখনও কোনো জ্ঞান হয়নি।)
সে তখন নিজে আলো নিভিয়ে দিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে তো কিছু দিন পরে আমার বিয়ে হবে। তাই একটু আনন্দ করতে এসেছি। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরতে এল। আমি তখন খাট থেকে নেমে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে আম্মার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। প্রথমে আব্বা দরজা খুলে আমাকে দেখে বললেন, কি হয়েছে মা? তুই অমন করসি কেন? ততক্ষণে আম্মাও বেরিয়ে এসেছে। আমি বললাম, আপনার কাছ থেকে এসে ঘুমের ঘোরে দরজা না লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর যা ঘটেছিল সব কথা বললাম।
আম্মা আমার ঘর থেকে জহির ভাইকে ডেকে এনে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসে আমাকে বলল, তুমি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
পরের দিন ভোরে এক টুকরো কাগজে, আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি এই কথা লিখে রেখে জহির ভাই চলে যায়। এরপর প্রায় দু বছর পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আব্বা মারা যাওয়ার পর তার কুলখানির সময় আমরা সকলে দেশের বাড়িতে যাই। সেই সময় দাদি জহির ভাই এর সঙ্গে বিয়ের কথা বলে আমার মতামত জানতে চান। বিয়ের কথা শুনে ধক করে মনের পর্দায় আপনার ছবি ভেসে উঠে। বললাম, আমি কলেজে পড়ব, এখন বিয়ে করব না। তার সঙ্গে বিয়ে দিলে বিষ খেয়ে মরব। সেই বছর আমি ম্যাট্রিক পাশ করি।
ওখানে গিয়ে জুহির ভাইয়ের নারী ঘটিত কুকীর্তির কথা অনেক শুনলাম। বড় মামার শুধু দুই ছেলে। সহিদ মারা যাওয়ার পর জহির ভাই আদর পেয়ে চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। সেইজন্য বড় মামা তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য আম্মাকে বলেন। দাদির কাছ থেকে আমার অমতের কথা শুনে আম্মা রেগে গিয়ে আমাকে প্রথমে খুব বকাবকি করে। পরে বুঝিয়ে বলে, জহির বাপ-মার এক ছেলে। ওদের অনেক সম্পত্তি, সবই তোর হবে। তাছাড়া অন্য ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হলে সে কি আর আমাদেরকে জহিরের মত দেখাশুনা করবে? আমি বললাম, এখন আমি বিয়ে করব না। দরকার হলে চিরকুমারী থেকে চাকরি করে তোমাদের দেখাশুনা করব। তখন পর্যন্ত ব্যাংকের টাকা ও উইলের কথা জানতাম না। মাত্র মাস খানেক আগে মেজ মামার কাছ থেকে জেনেছি। আর যদি তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দাও তবে তার পরিণতির জন্য তোমরাই দায়ী হবে। দাদি আম্মাকে বললেন, ওকে এখন বিয়ে করার জন্য বেশি চাপ দিও না। তদিরে থাকলে একাজ হবে। তারপর আমরা ঢাকার বাড়িতে চলে আসি। সেই থেকে আম্মা জহির ভাইকে বিয়ে করার জন্য মাঝে মাঝে আমাকে বোঝাত। কিন্ত ইদানিং আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে দেখে তাকে বিয়ে করার জন্য খুব বেশি চাপ দিচ্ছে। আমিও স্পষ্ট বলে দিয়েছি, বেশি চাপা চাপি করলে আত্মহত্যা করব।
আমাদের চারতলা বাড়ির উপরের তলা ছাড়া সব ভাড়া দেওয়া আছে। আব্বা নিজে গাড়ি চালাতেন। তিনিই আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বড় মামা তার এক গরিব আত্মীয়কে অর্থাৎ এই দাদুকে ঠিক করে দেন। উনি খুব ভালো লোক। আমাদের সংসারের যাবতীয় কাজ দেখাশোনা করেন। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করি বলে আপনার উপর খুব রাগ। তবে তা কোনোদিন প্রকাশ করেন না। শুধু একদিন বলেছিলেন, খুকি ভাই, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এত রাজপুত্র থাকতে তুমি একজন দোকানের কর্মচারীর পিছনে ছুটছ কেন?
আমি বলেছিলাম, আপনি যাদের রাজপুত্র বলে জানেন, তাদের চেয়ে দোকানের ঐ সামান্য কর্মচারী চরিত্রের দিক দিয়ে অসামান্য। রাজপুত্ররা প্রায় সবাই চরিত্রহীন। তারা নারীকে প্রেম দিতে জানে না। জানে শুধু অত্যাচার করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। নারীকে তারা ভোগের সামগ্রী মনে করে।
তারপর থেকে আপনার বিষয়ে আর কোনো দিন কোনো কথা বলেন নি। লেখায় অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। আল্লাহপাকের দরবারে আপনাদের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে শেষ করছি।
ইতি
হতভাগী সেলিনা

৩. চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম

চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম। চিন্তা করলাম, তাকে যদি বিয়ে না করি, তাহলে যে রকম জেদী মেয়ে, হয়তো সত্যি সতিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। আর সে জন্য আমিই দায়ী হব। তাই ঠিক করলাম তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো কঠিন শর্ত আরোপ করে আর একটা পত্র দিয়ে শেষ পরীক্ষা করব। যদি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তবে তাকে বিয়ে করতে রাজি হব। তাতে আমার তকদিরে যা হয় তোক। যদিও মনে হয়েছিল, যত কঠিন পরীক্ষা করি না কেন, পাশ সে করবেই; তবু খেয়ালের বশবর্তী হয়ে লিখলাম

সেলিনা,
দোয়া নিও। আশা করি ভালো আছ। এই পত্রে আমি তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো শর্ত আরোপ করছি। আমার এই শর্তগুলো ভালভাবে পড়ে স্থির মস্তিস্কে চিন্তা করে আমাকে জানাবে। তোমার উত্তর পাওয়ার পর মতামত জানাব।
১. সারাজীবন তোমাকে খোর-পোশ দিতে পারব না।
২. তোমাকে চিরকাল ঐ বাড়িতে থাকতে হবে। যদিও তোমার গার্জেনরা অত্যাচার করে তোমাকে তাড়িয়ে দেয়, তবুও বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ করবে না।
৩. কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্য যে কোনো কারণে আমাকে যখন তখন ডাকা চলবে না। ৪. বিয়ের ব্যাপারটা চিরকাল গোপন রাখতে হবে। আমার বা তোমার কোনো আত্মীয়ের কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করবে না।
৫. গার্জেনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যদি কোনো রকম খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হও, তবে আমাকে না জানিয়ে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
৬, বাইরে যাওার সময় বোরখা ব্যবহার করতে হবে।
৭. আমার দ্বারা তোমার যৌন ক্ষুধা নাও মিটতে পারে।
৮, বিয়ের পর ব্যাংকের যে টাকার তুমি স্বত্ত্বাধিকারী হবে, সে টাকা নেওয়ার জন্য আমাকে পিড়াপিড়ী করবে না।
৯, আমার সঙ্গে সব সময় মেজাজ বুঝে চলবে। আমাকে কাছে পেয়ে নিজের ইচ্ছামত কিছু বলতে বা করতে পারবে না।
১০. আমি খুব বদমেজাজী, যদি আমার মতের বিরুদ্ধে চল, তাহলে চাবুক মেরে আমার মতে চালাব।
১১. জীবন যাত্রা যতই দুর্বিসহ হয়ে উঠুক না কেন, কোনো দিন তালাকের কথা উচ্চারণ করবে না।
১২. উপরের, এগারটি শর্তের সবগুলো অথবা যে কোনো একটা শর্ত আরোপ করে কখনও কোর্টে নালিশ করতে পারবে না।
সেলিনা তুমি যদি এই চিঠি পড়ে আমাকে কাপুরুষ ও স্বার্থপর ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে এর চেয়ে জীবনে পরম পাওয়া আমার কাছে আর কিছু নেই। উপরের মালিকই জানেন, আমি তোমার ভালো চাই, না মন্দ চাই। আমি তোমাকে এখনও বলছি উপরের শর্তগুলো পড়ে তোমার মত বদলান উচিত। কারণ এর ফলে তোমার ও আমার দুজনেরই ভালো হবে। তোমার জহির ভাইয়ের সঙ্গে যাতে বিয়ে না হয় তার ব্যবস্থা করে অন্য কোনো সুন্দর স্বাস্থবান ও চরিত্রবান ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে ইনশাআল্লাহ পারব। এই পত্র পড়ে তোমার শুভবুদ্ধির উদয় হোক আল্লাহপাকের দরবারে সেই দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফিজ।
ইতি—-

কিছুদিন আগে সেলিনা আমাকে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিল, এটা আমাদের তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়াদের। উনি একজন দারোগা। আব্বার এক মক্কেলের কেসের ব্যাপারে ইনকোয়ারী করেছিলেন বলে রাজ সাক্ষী হয়েছিলেন। সেই থেকে আব্বার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। আমাকে উনি ও ওঁর স্ত্রী খুব ভালোবাসেন। ওঁদের একমাত্র মেয়ে জোবেদা আমার সহপাঠী ও প্রিয় বান্ধবী। এটা তাদেরই নাম্বার। যদি কোনো কারণে আমাকে দরকার হয়, তবে এই নাম্বারে ডায়েল করে বলবেন, জোবেদার বান্ধবীকে চাই। তাহলে যেই ফোন ধরুক না কেন, আমাকে ডেকে দেবেন। কারণ আপনার ও আমার ব্যাপারটা ওঁরা জানেন। আমি ওঁদেরকে এ রকম ভাবে ফোন আসার কথা বলে রেখেছি। দারোগার ফোন নাম্বার বলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। সেলিনা নিজেদের ফোন নাম্বার না দিয়ে অন্যের নাম্বার কেন দিল তা বুঝতে পেরেও কি উত্তর দেয় শোনার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের নাম্বার দিলে না কেন?

সেলিনা মাথা নিচু করে উত্তর দিল, আমার প্রেমিক তা জানেন।

এই পত্র লেখার পর প্রায় দশ বার দিন তার সঙ্গে যোগযোগ না হওয়ায় একদিন ঐ নাম্বারে ফোন করলাম। দুবার রিং হওয়ার পর একজন বয়স্ক মহিলা বলে মনে হল রিসিভার তুলে বললেন, হ্যাল্লো, এটা দারোগা সাহেবের বাসা, কাকে চান?

প্রথমে ওঁর গলার ভারী আওয়াজ শুনে ভড়কে যাই। পরে আমতা আমতা করে বললাম, দয়া করে জোবেদার বান্ধবীকে একটু ডেকে দিতে পারেন?

আচ্ছা ধরুন বলে উনি রিসিভারটা পাশে রেখে হেঁকে বললেন, জোবেদা, তোর বান্ধবীকে কে যেন ফোনে ডাকছে।

আমি সব কথা শুনতে পেলাম।

প্রায় দুতিন মিনিট পর একটা মেয়ে রিসিভার তুলে হ্যালো, আমি সেলিনা বলছি বলে একটু হেসে উঠল।

আমি বললাম, আপিন সেলিনা নন, জোবেদা।

আমার কথা শুনে যে ফোন ধরেছিল সে আরও একটু জোরে হেসে উঠে বলল, নে ধর, তোর হবু বর নকল ধরে ফেলেছে।

সেলিনা বলল, কি যা তা বকছিস? উনি শুনতে পেলে খুব রেগে যাবেন।

আমি যে তাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি সেদিকে কারুরই খেয়াল নেই। সেলিনা ফোন ধরে আস সালামু আলায়কুম বলে বলল, আজ আমার কি সৌভাগ্য হতভাগীকে এতদিন পর ফোন করেছেন।

আমি ওয়া আলায়কুম আস সালাম বলে বললাম, কাল সকাল ৯টায় দোকানে আসবে। তারপর ফোন ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম, ফোন নাম্বার জানা থাকলে লাইন কেটে গেছে মনে করে ফোন করত।

পরের দিন সকালে সাহেবের গাড়ি আমাকে নিউমার্কেটের গেটে পৌঁছে দিয়ে গেল। আমি গেটের বাইরের দোকান থেকে সিগারেট কিনছি, এমন সময় সেলিনা আমাকে সালাম দিল। আমি সালামের জওয়াব দিয়ে তাকে দোকানে আসতে বলে চলে আসি। আকবর নামে একটা ছেলে দোকানের ফাইফরমাস খাটে। সে দোকান ঝাঁট দিয়ে কলসি নিয়ে খাবার পানি আনতে গেল। আমি আগরবাতি জ্বেলে চেয়ারে বসলাম। তখন পর্যন্ত আমার সহকর্মীরা কেউ আসেনি।

সেলিনা একটা মোটা ফর্সা মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তাকে দেখিয়ে বলল, আমার প্রিয় বান্ধবী জোবেদা।

জোবেদা হেসে আমাকে সালাম দিল।

আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, কেমন আছেন? আপনার কথা ওর কাছে। অনেক শুনেছি।

ভালো আছি বলে জোবেদা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

তারা দুজনেই সেদিন হলুদ রং এর সাটিন কাপড়ের সালওয়ার কামিজ পরেছিল। আজ সেলিনাকে এই পোশাকে অপূর্ব সুন্দরী বলে আমার মনে হল। চোখে চোখ পড়তে সেলিনা দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, কাল অত তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিলেন কেন?

বললাম, এর উত্তর তো তোমার জানা থাকা উচিত।

জোবেদা বলে উঠল, জানেন, আপনি ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর ওতো লাইন কেটে গেছে মনে করে আবার আপনার ফোনের আশায় আধ ঘন্টা বসেছিল।

কথাটা শুনে সেলিনার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে উঠল। বললাম, সে জন্য দুঃখিত। তারপর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য জোবেদাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, ইতিহাসে জোবেদা নামে একজন নারীর কথা বর্ণনা আছে, বলুন তো সেই নারী কে ছিলেন?

জোবেদা বলল, জানি না, আপনি বলে দিন।

বাগদাদের খলিফা হারুন আর রশিদের প্রাধান ও প্রিয় বেগম ছিলেন। তিনি নিজের খরচে প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য একটি খাল খনন করে দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তারপর বললাম, আপনারা বসুন, আমার সহকর্মীরা আসা পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে।

তারা না বসে ঘুরে ঘুরে দোকানের বই দেখতে লাগল। একটু পরে জোবেদা জিজ্ঞেস করল, এত বই এর নাম আপনার মুখস্থ আছে?

মৃদু হেসে বললাম, না!

তাহলে কাষ্টোমার চাইলেই ঝটপট বের করে দেন কী করে?

আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজের ছবি ভেসে উঠে, কাস্টোমার যখন কোনো বই চায় তখন ঠিক তেমনি মনের আয়নায় বইটির সবকিছু মনে পড়ে যায়। তাই তাড়াতাড়ি বের করতে পারি। মুখস্থ ধরলে হয়তো দুতিনশ নাম বলতে পারব। আর লিখতে বললে আরও দুএকশ বেশি লিখতে পারব। বাকি সব মনের আয়নায় পর্দার আড়ালে ষ্টক আছে। কেউ কোনো বই চাইলেই পর্দা সরে গিয়ে ঐ বইটির কথা ভেসে উঠে।

সেলিনা একটা বই এনে আমাকে মেমো করে দিতে বলল। বইটির মেমো করছি এমন সময় আমার দুজন সহকর্মীকে আসতে দেখে বললাম, আপনারা নভেলে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।

বই এর দাম দিয়ে তারা চলে গেল।

মিনিট পাঁচেক পর আমি নভেল ড্রিংকে গিয়ে দেখি, দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করছে। আমি তাদের পাশে একটা চেয়ারে বসে বেয়ারাকে প্রথমে দুটো করে বড় মিষ্টি ও পরে চানাচুর ও চা দিতে বললাম।

জোবেদা বলল, আপনি বুঝি মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসেন?

খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো বাদ বিচার নেই। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু হালাল করেছেন, সবই আমি খেতে ভালবাসি। তার মধ্যে মিষ্টি ও ফলের উপর লোভ একটু বেশি। খাওয়া শেষ হতে বললাম, আরও তে বলি?

তারা দুজনেই বলে উঠল, আর খেতে পরব না।

তারপর চা খেতে খেতে চিঠিটা বের করে সেলিনার হাতে দিলাম। চিঠি নেওয়ার সময় তার হাত কাপছিল। কম্পিত হস্তে চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল।

জোবেদাকে বললাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

নিশ্চিন্তে করুণ।

আচ্ছা, আপনি তো ওর প্রিয় বান্ধবী? আপনার কি উচিত না ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা? ও তো গুহার মধ্যে বাঘ আছে জেনেও তাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

জোবেদা বলল, সেলিনা যখন আমাকে প্রথম আপনার পরিচয় জানিয়ে সব কথা বলে তখন আমি ওকে অনেক বারণ করেছি। এমন কি ঝগড়া করে কয়েকদিন মেলামেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি। শেষে আবার অনেক অনুনয় বিনয় করে বন্ধুত্ব ফিরে পেয়েছি। ভাবলাম, ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বন্ধুত্ব নষ্ট করব কেন? অনেক দিন থেকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা ছিল, সেলিনাই করায় নি। গতকাল যখন ফোন ধরলাম তখন ওকে চাপ দিতে রাজি হয়ে আজ নিয়ে এসেছে। সত্যি কথা বললে আপনার সামনে আপনার প্রশংসা হয়ে যাবে, তবু বলছি, সেলিনা অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেনি।

আপনি ওকে খুব ভালবাসেন, তাই এ কথা বলছেন। কারণ আমার মধ্যে এমন কোনো গুণ নেই, যা দেখে আমাকে সুপাত্র বলা যেতে পারে।

গুণীরা কোনো দিন নিজের গুণ নিজেরা জাহির করে না, বরং তা আপনা থেকে সুগন্ধি ফুলের খুশবুর মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

কথা বেশি বেড়ে যাচ্ছে দেখে বললাম, দেরি হয়ে গেল, আর সময় দিতে পারছি না। তারপর বিল পেমেন্ট করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোকানে ফিরে আসার সময় ভাবলাম, সেলিনা চিঠিটা পড়ে কি করবে কি জানি?

এরপর প্রায় বিশ পঁচিশ দিন সেলিনার কোনো খবর পেলাম না। প্রতিদিন দোকানে এলে মনে হত, আজ নিশ্চয় কোনো খবর পাব। চিঠিটা দিয়ে আমিও খুব অশান্তিতে ছিলাম। একদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আর্জেন্ট বই সাপ্লাই দেওয়ার জন্য সকাল আটটায় দোকান খুলে কাউন্টারের উপর টাইপ মেশিন রেখে বিল তৈরি করছিলাম। ঠিক সাড়ে আটটার সময় সেলিনাদের ড্রাইভার এসে আমাকে ছোট্ট একটা ভাজকরা কাগজ দিয়ে বলল, খুকী ভাই দিয়েছে। দাদু চলে যাওয়ার পর কাগজটা খুলে পড়লাম

ওগো আমার হৃদয়ের স্পন্দন,
প্রথমে দুখিনীর সালাম নেবেন। পরে আপনার কদম মোবারকে আজি জানাচ্ছি, আগামীকাল বেলা এগারটায় আপনাকে পার্কের সেই জায়গায় পেতে চাই। এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ অনুরোধ। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি–
আপনার পথের কাঁটা
অভাগিণী সেলিনা।

চিঠি পড়ে বুঝতে পারলাম কাঁদতে কাঁদতে লিখেছে। কারণ চিঠিতে কাঁদার চিহ্ন ছিল। সেদিন ছিল মঙ্গবার, বুধবার বই নিয়ে রাজশাহী যাওয়ার কথা। সাহেবকে বলে সেখানে বৃহস্পতিবার যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। চিন্তা করে দেখলাম, যদি তার কথামত না যাই, তাহলে হয়তো কিছু করে ফেলতে পারে।

পরের দিন ঠিক এগারটার সময় পার্কের নিদিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি সেলিনা চুপচাপ লেকের পানির দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। তার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম একটু আগেও কেঁদেছে। আমি ধীর পদক্ষেপে কোনো সাড়া শব্দ না করে অল্প একটু দূরে বসলাম।

প্রায় পাঁচ মিনিট সেলিনা একই ভাবে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতের ঘড়ি দেখল। তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে এক রকম ছুটে এসে পাশে বসে আমার দুটো হাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফাইন্যাল পরীক্ষা চলছিল বলে তোমার দেওয়া সেই চিঠি এতদিন পড়িনি। গত পরশু পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রাত্রে চিঠিটা পড়ে আজ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুমি আমাকে এভাবে চিঠি লিখতে পারলে? তোমার ঐ চিঠির শর্ত ছাড়া যদি আরও হাজার শর্ত থাকে, সেগুলোও সব আমি মেনে নেব। তবু তোমাকে হারাতে পারব না। আর এতেও যদি তুমি রাজি না হও, তবে আমার গলাটিপে এখানে মেরে রেখে যাও। এইকথা বলে সে হাত দিয়ে আমার হাত দুটো নিজের গলায় বেশ জোরে চেপে ধরল। তার কথায় ও কাজে আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি এখন অপ্রকৃতস্থ। আমার কোনো কথা তোমাকে ভালো লাগবে না। তুমি বাসায় চলে যাও। আর কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। তোমার সঙ্গে যদি আরও কিছুদিন আমার যোগাযোগ থাকে, তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। এইকথা বলে তার গলা থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত চলে আসতে লাগলাম।

সেলিনা ছুটে আমার সামনে এসে পথরোধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি এভাবে আমাকে অন্ধকারে ফেলে রেখে যেও না। তোমার কাছ থেকে আজ আমি স্পষ্ট কিছু শুনতে চাই।

তার কাঁন্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে ফেললাম। তারপর সামলে নিয়ে বললাম, তোমাকে বলার মতো আমার আর কিছু নেই। যা বলার আগেই চিঠিতে সব বলেছি। এখন তুমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালে হয়তো আমি বাঁচতে পারি। নচেৎ আমার যে কি পরিণতি হবে, তা উপরের মালিকই জানেন। শেষের দিকের কথাগুলো আমার নিজের কাছে ভেজাভেজা লাগল। শেষে কি তার কাছে কেঁদে ফেলব মনে হতে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।

গেটের বাইরে ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করল, খুকী ভাইকে কোথায় রেখে এলেন? পরশু রাত থেকে কিছু খায়নি, কারও সঙ্গে কথাও বলেনি? কি হয়েছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।

কথাগুলো শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বললাম, আপনার খুকী ভাই লেকের ধারে আছে, আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।

বাসায় এসে স্ত্রীকে খেতে দিতে বললাম।

আমার স্ত্রী বলল, তরকারী হতে একটু বাকি আছে। তুমি জোহরের নামায পড়ে নাও, ততক্ষণে সবকিছু হয়ে যাবে।

অযু করে মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসে খেতে বসে মোটেই খেতে পারলাম না।

আমার স্ত্রী বলল, তুমি যে কিছুই খেলে না!

বললাম, কি জানি খিদে রয়েছে অথচ রুচী নেই।

তোমাকে বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, মাঝে মাঝে তুমি খুব চিন্তিত থাক, অথচ আগে এরকম ছিলে না।

মানুষের মন কি আর সব সময় এক রকম থাকে? কিছুদিন যাবৎ শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।

তাহলে ডাক্তারের কাছে একবার চেকআপ করাও না কেন?

তুমি অত ভেব না, একদিন না হয় ডাক্তারের কাছে যাব। মন থেকে চিন্তা দূর করার জন্য এবং ওকে খুশি করার জন্য বললাম, চল। আজ চিড়িয়াখানা দেখতে যাব। তারপর হোটেলে বিরানী খেয়ে বাসায় ফিরবো।

কথাটা শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশী হল। সেদিন সারা বিকেল চিড়িয়াখানা দেখে হাতীর পিঠে চড়ে কাটালাম। ফেরার পথে ওর জন্য গ্যানিস থেকে একসেট সালওয়ার কামিজ কিনে হোটেলে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।

.

সেলিনাকে সেদিন পার্কে ঐ অবস্থায় ফেলে এসে দিন দিন আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। শত চেষ্টা করেও তা দূর করতে পারলাম না। যখন একমাস পার হয়ে গেল অথচ কোনো খবর পেলাম না তখন মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করলাম। দোকানে এলে এই ভাবটা বেশি হত। একদিন নভেল ড্রিংকের মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যারিষ্টার মঈনুল ইসলামের মেয়ে কি কয়েকদিনের মধ্যে এসেছিল?

উনি বললেন, আপনি জানেন না বুঝি? ব্যারিষ্টার সাহেবের মেয়ে তো আজ এক মাসের মত শয্যাশায়ী। ডাক্তাররা কোনো রোগ ধরতে পারছে না।

খবরটা শুনে খুব মুষড়ে পড়লাম। কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে পারলাম। শুধু মনে হতে লাগল, তার এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। প্রত্যেক নামাযের পর তার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করতে লাগলাম। এই অস্থিরতার মধ্যে আরও চার পাঁচ দিন গত হয়ে গেল।

আমাকে বেশি চিন্তিত দেখে আমার স্ত্রী ভয় পেয়ে একদিন বলল, আজ দোকানে গিয়ে কাজ নেই। চল, আমিও তোমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাব। তার ধারণা হয়েছিল আমার কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে।

বললাম, তোমাকে যেতে হবে না, আজ মার্কেটে একজন ডাক্তারকে দেখাব। আমার মন এত খারাপ হয়েছিল যে, সেটা সহকর্মীদের চোখ এড়ায়নি।

ঐদিন দোকানে আসার পর এক সময় তারা জিজ্ঞেস করল, আপনার কী কোনো অসুখ করেছে? কিছুদিন থেকে আপনাকে খুব মন মরা দেখাচ্ছে।

বললাম, তেমন কিছু হয়নি, তবে শরীরটা কিছুদিন যাবৎ খুব খারাপ যাচ্ছে। বিকেল চারটের সময় ড্রাইভারকে আসতে দেখে দোকান থেকে বের হয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।

আমাকে দেখে ড্রাইভার বলল, আপনাকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে বাসায় যেতে হবে।

বললাম, বাসায় গেলে আবার গোলমাল হবে না তো?

যাকে নিয়ে গোলমাল হবে, সে বোধ হয় আর বাঁচবে না বলে ড্রাইভার রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তারপর আবার বলল, খুকী ভাইয়ের মেজ মামা আর দুজন ডাক্তার বসে আছেন। তারাই আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।

ড্রাইভারকে গাড়িতে যেতে বলে দোকানে ফিরে এসে সাহেবকে ফোন করে বললাম, আমার এক আত্মীয়া মৃত্যুশয্যায়। আমাকে নিয়ে যেতে লোক এসেছে। আমি সেখানে যাচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই। তারপর সহকর্মীদের বললাম, আমি যাচ্ছি। কারণটাতে তোমরা শুনলে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কি হয়েছে?

কি যে হয়েছে ডাক্তাররই রোগ ধরতে পারেনি। পার্কের সেই ঘটনার আগের দিনের রাত থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কিছু খায়নি। কারও সঙ্গে কথা ও বলেনি। এমন কি ডাক্তাররা প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। শুধু প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে। যেন একদম বোবা হয়ে গেছে। আজ মেজ মামা ডাক্তারদের কাছে আপনার ও খুকী ভাইয়ের সম্পর্কের কথা বলায় ওঁরা বললেন, এতদিন কথাটা গোপন রেখে খুব ভুল করেছেন। ছেলেটিকে না হলে চিকিৎসা করে কোনো লাভ হবে না। তাই মেজ মামা আম্মার সঙ্গে রাগারাগী করে আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।

গাড়ি পৌঁছাতে ড্রাইভার আমার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, সোজা উপরে খুকী ভাইয়ের কামরায় চলে যান।

উপরে গিয়ে দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম, দুজন ডাক্তার চেয়ারে আর একজন ভদ্রলোক খাটে বসে আছেন। আমি সালাম দিলাম।

খাটে বসা ভদ্রলোক সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, তুমি এখানে এসে বস বলে খাটে নিজের পাশে ইঙ্গিত করলেন। তারপর ডাক্তারদের বললেন, চলুন আমরা ড্রইং রুমে বসি।

ওঁরা চলে যাওয়ার পর আমি সেলিনার দিকে লক্ষ্য করলাম, একটা পরিস্কার চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা রয়েছে। শুধু মুখাটা খোলা। মাথাটা একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা। চোখ দুটো বন্ধ। শরীর শুবিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। মুখে একবিন্দু রক্ত থাকায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আমি তার কাছে সরে বসে কপালে হাত রাখলাম।

সেলিনা ধীরে ধীরে চোখ খুলে অশ্রুভরা নয়নে আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

তার অবস্থা দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেল। আমার চোখের পানি তার গালে পড়তে সেলিনা কপালে রাখা আমার হাতটা নিয়ে প্রথমে চুমো খেল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, এবার আমার মৃত্যু হলেও কোনো দুঃখ নেই। আমার জীবন সার্থক। আমার প্রেম হেরে যায়নি। একদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রেম দিয়ে তোমাকে জয় করবই। সে প্রতিজ্ঞা আজ আমার পূর্ণ হল। সেইজন্য আল্লাহপাকের কাছে জানাই হাজারো শুকরীয়া।

তার হাতের মধ্যে আমার হাত ছিল। বললাম, তোমার হাতে হাত রেখে বলছি, তোমার প্রেমের কাছে আমি সত্যিই হেরে গেছি। তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব। তুমি শুধু কথা দাও, নিজেকে আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে না। আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছিলাম বলে কি এভাবে মৃত্যুর দিকে এগোতে হয়? আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করছি; তিনি যেন শিঘ্রী তোমাকে সুস্থ করে তোলেন।

তুমি যদি সব সময় আমার কাছে থাক, তাহলে ডাক্তারের চিকিৎসা ছাড়াই আমি ভালো হয়ে যাব।

বললাম, তোমাকে এই রকম অবস্থায় রেখে চলে যেতে আমারও খুব কষ্ট হবে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। তবে কথা দিচ্ছি, আল্লাহ চাহে তো প্রতিদিন এসে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যাব।

বেশ, তোমার ইচ্ছাই আমার কামনা। তবে প্রত্যেক দিন অন্ততঃ একবার আসা চাই

তার কথায় রাজি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, যিনি তোমার কাছে বসেছিলেন ওঁকে যেন চেনা চেনা লাগল।

উনি আমার মেজ মামা। তোমাকে ভালভাবে চেনেন। জর্জকোর্টের উকিল। তোমার কাছ থেকে অনেক আইনের বই কিনেছেন। আমাদের সব ব্যাপার উনি জানেন। আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে একমাত্র উনি এখনও আমাকে ভালবাসেন। ওঁর সাহায্য না পেলে আম্মা অনেক আগেই জহির ভাইয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিত। এতকথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।

আমি তাকে কথা বলতে নিষেধ করলাম। এমন সময় জরিনা এসে বলল, মামা আপনাকে ড্রইংরুমে ডাকছেন। উঠে দাঁড়াতে সেলিনা বলল, আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে যেওনা যেন। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, মাসাধিক কাল আগে রমনা পার্কের সেই ঘটনার দিন সেলিনা আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছিল, আর আজও সেইভাবে কথা বলছে। আচ্ছা বলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম।

মামা নিজে এককাপ চা বানিয়ে বিস্কুটের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, চা খাও।

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে ডাক্তারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কি অসুখ হয়েছে?

ডাক্তারদের একজন বললেন, তার আগে বলুন, সেলিনা কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?

বললাম, হ্যাঁ, তবে খুব ক্ষীন স্বরে।

অন্য ডাক্তার বললেন, তবে আর ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা তো মনে করেছিলাম, সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এতদিন আমরা কোনো রোগ ধরতে পারিনি। তারপর সেলিনার মামাকে দেখিয়ে বললেন, ওঁর কাছে আজ আপনাদের দুজনের সম্পর্কের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, কোনো রোগ তার শরীরে নেই। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। অবস্থা যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছিল, আর এক সপ্তাহ এই ভাবে থাকলে মারা যেত। এখন আপনি যদি কথায় ও ব্যাবহারের দ্বারা তার মানসিক যন্ত্রণা দূর কতে পারেন, তাহলে শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে। সব থেকে মুস্কিল হচ্ছিল, কোনো খাবার বা ওষুধ তাকে খাওয়ান যাচ্ছিল না। যদি জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করা হয়, তবে তা মুখে নিয়ে ফেলে দেয়। ওঁকে সুস্থ করার সবকিছু নির্ভর করছে আপনার উপর। ডাক্তাররা বিদায় নেওয়ার সময় আবার বললেন, ভালো করে খাওয়াবার চেস্টা করুন, আর যে ভিটামীনগুলো আছে সেগুলো ঠিকমত খাওয়ান। আশা করি অল্পদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ডাক্তাররা চলে যাওয়ার পর মেজ মামা আমাকে বললেন, শুধু একটা কথা বলব, তোমার উপরেই সেলিনার ভালো মন্দ নির্ভর করছে। এখন আমি আসি। পরে এক সময় তোমার সঙ্গে কথা বলব।

সকলে চলে যাওয়ার পর সেলিনার ঘরে এসে খাটের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে জরিনাকে হরলিক্স তৈরি করতে বললাম।

সেলিনা বলল, ডাক্তাররা বুঝি আমাকে শুধু খাওয়াতে বলেছেন?

ডাক্তাররা যাই বলুক না কেন? আমি তোমাকে যেভাবে যখন পথ্য ও ওষুধ খেতে বলে যাব, ঠিকমত সেগুলো খাবে। জরিনার কাছ থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে কখন কি খাবে তার একটা চার্ট তৈরি করে জরিনাকে বললাম, তুমি তোমার আপাকে চার্টমত খাওয়াবে। যদি কোনো রকম ওজর আপত্তি করে, তাহলে আমি আগামীকাল এলে জানাবে।

জরিনা হরলিক্স তৈরি করে ওকে চামচে করে খাওয়াল। তারপর বলল, জানেন, আজ একমাস আট দিন পর আপা এই প্রথম কিছু খেল ও কথা বলল। এতদিন শুধু পানি খেয়ে ছিল।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আপাকে দেখাশুনা করে কে?

জরিনা বলল, আমি ও মা। একজন নার্সও রাখা হয়েছে। নিজের প্রয়োজনে। কিছুক্ষণ আগে সে বাইরে গেছে।

আমি আসরের নামায পড়ে সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নামায পড়বে না?

কি করে পড়ব? আমি যে খুব দুর্বল। উঠতে পারি না। যতদিন সামর্থ ছিল পড়েছি।

তোমার তো উঠার দরকার নেই। জেনে রেখ, মেয়েদের প্রাকৃতিক অসুবিধে ও পাগল ব্যক্তি ছাড়া কারুর জন্য নামায মাফ নেই। যে কোনো অবস্থা হোক না কেন নামায পড়তেই হবে। তারপর জরিনাকে প্লেটে করে কিছু শুকনো ভালো মাটি আনিয়ে দিতে বললাম।

জরিনা তাদের কাজের মেয়েকে মাটি আনতে বলল। কাজের মেয়েটি যখন মাটি নিয়ে ফিরল তখন নার্সও এল।

আমি জরিনা ও নার্সকে বললাম, প্রত্যেক নামাযের সময় সেলিনাকে এইভাবে তাইমুম (অযু) করিয়ে দেবেন বলে মাটিতে দুহাত ঘসে প্রথমে আমি আমার সমস্ত মুখমন্ডল এবং পরে আবার মাটিতে হাত ঘসে দুহাতের কনুই পর্যন্ত মুছলাম। নার্স তাকে সেইভাবে তাইমুম করিয়ে দিল। তারপর আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা দুজনে ওকে ধরে পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে পা করে শুইয়ে দিন।

আমার কথামত তারা সেলিনাকে শুইয়ে দিল।

আমি তাকে বললাম, তুমি এবার চিৎ হয়ে শুয়ে চোখের ঈশারায় নামায পড়।

আমি যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ কেউ আমার অনুমতি ছাড়া ঘরে আসেনি। এক সময় আমি সেলিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে বললাম, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে সেদিন পার্কে ঐ অবস্থায় ফেলে এসে এতদিন যে কি যন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা একমাত্র উপরের মালিকই জানেন। সত্যি ত্যি তোমাকে যে আমি এত, গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছি, তা এই ঘটনার আগে বুঝতে পারিনি। তার সুন্দর সুডৌল আপেলের মত গাল দুটো হাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে তা লক্ষ্য করে আমার গলা ধরে এল।

সেলিনা তা বুঝতে পেরে আমার হাতটা দুহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কাদ কাদ স্বরে বলল, আমার জন্য তুমি যে কত কষ্ট এতদিন পেয়েছ এবং এখনও পাচ্ছ, তা সবকিছু আমি অনুভব করতে পারছি। আমার এখন মনে হচ্ছে, আমার মত সৌভাগ্যবতী মেয়ে সারা দুনিয়ায় নেই।

রাত দশটায় এশার নামায পড়ে সেলিনাকে বললাম, এবার আমাকে আজকের মত বিদায় দাও।

আমার কথা শুনে তার পাড়ুর মুখটা আরও মলিন হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে ছলছল নয়নে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

বললাম, প্রতিদিন তো আসব, মন খারাপ করছ কেন? তারপর একবার তার মাথায় ও মুখে হাত বুলিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে আসি।

এরপর কোনো দিন সকালে অথবা রাত্রে যখনই সময় পেতাম তখনই গিয়ে ওর কাছে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতাম। যাওয়ার সময় নানারকম ফল ও মিষ্টি নিয়ে যেতাম। দশবার দিনের মধ্যে সেলিনা বেশ সুস্থ হয়ে উঠল।

আরো দুতিন দিন পর সেলিনা আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, এতে কিছু টাকা আছে। যদি তুমি মনে কিছু না করে এটা নাও, তাহলে খুব খুশী হব।

তাকে খুশী করার জন্য খামটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? হঠাৎ আমাকে টাকা দিলে কেন?

তুমি আমার জন্য এত খরচ করছ, ভাবলাম, তোমার যদি টাকার টান পড়ে।

আল্লাহপাকের রহমতে আমার টাকার টান পড়বে না। চাকরি ছাড়াও আমার একটা সাইড বিজনেস আছে। তা থেকে যা পাই, তার অল্পকিছু ছাড়া প্রায় সবটাই ব্যাংকে জমা হচ্ছে। তোমার দেওয়া টাকা আমি নিলাম, কিন্তু ভবিষ্যতে এ রকম আব্দার আর করবে না। এখন এই টাকাগুলো আমি আমার প্রেমিকার কাছে গচ্ছিত রাখছি, সময় মত চেয়ে নেব। এই বলে টাকার খামটা তার হাতে ফেরৎ দিলাম।

সেলিনা নির্বাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চোখের পানি গোপন করার জন্য মাথা নিচু করে নিল।

আমি তার চিবুক ধরে তুলে বললাম, আমাকে তুমি ভুল বুঝ না। আমার এই ব্যবহারে যদি তুমি মনে কষ্ট পেয়ে থাক, তবে মাফ চাইছি।

টপ টপ করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেলিনা বলল, তোমার কোনো অন্যায় হয়নি, বরং আমি ভুল করে দয়া দেখাতে গিয়ে চরম অন্যায় করে তোমার মনে ব্যাথা দিয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

বললাম, ভুল মানুষ মাত্রেই করে। আর সেই জন্য আল্লাহপাকের রাসুল(দঃ) বলেছেন, মানুষ ভুল করবে বলেই আল্লাহপাক ক্ষমা রেখেছেন। যদি তারা তা স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চায়। তাহলে আল্লাহপাক তাদের ক্ষমা করে দেন। এর কয়েদিন পর তাকে বললাম, প্রতিদিন আসতে আমার অসুবিধে হয়। তুমি তো এখন ভালো হয়ে গেছ। তুমি বরং মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করো। তাকে আমার দোকানের ও পাশের দুতিনটে দোকানের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, যে কোনো একটাতে ডায়েল করে আমাকে চাইলেই পাবে।

তারপর থেকে আমি আর তাদের বাসায় যাইনি। মাঝে মাঝে সেলিনা ফোন করে নভেল ড্রিংকে আসতো, আমি সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতাম। আবার কোনো ছুটির দিনে পার্কে যেতাম।

এদিকে আমার স্ত্রী আমাকে যাতে কোনো রকম সন্দেহ না করে সেজন্য স্বাভাবিক জীবন শুরু করলাম। মন থেকে সমস্ত চিন্তা দুর করে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, সেলিনাকে বিয়ে করলেও স্ত্রীর সঙ্গে কোনো দিন কোনো কারণে খারাপ ব্যবহার করব না।

কিছুদিন পর সেলিনা ফোন করে বলল, তুমি আগামী কাল ছুটি নিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় জি, পি, ওর গেটে থাকবে, আমি আসব, বিশেষ দরকার আছে।

দরকারটা এখন বললে হত না?

এখন বলব না, কাল বলব। তোমার কিন্তু আসা চাই। তারপর অনুমতি নিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।

সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিলাম, কিন্তু স্ত্রীকে বললাম না। পরের দিন ঠিক সময় মত জি, পি, ওর গেটে দাঁড়ালাম। দুমিনিট পর সেলিনাদের গাড়ি এসে আমার সামনে ব্রেক করল।

সেলিনা সালাম দিয়ে দরজা খুলে বলল, এস!

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে গাড়িতে বসতে তার গায়ে গা ঠেকে গেল।

মৃদু হেসে বলল, ব্যবধান রেখে বসব? না যেভাবে আছি সেভাবে থাকব?

তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখ।

সেলিনা অল্প একটু সরে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাব বলোত?

কি করে বলব? ধনীর দুলালীদের মতলব বোঝা মুশকিল।

তুমি এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমার প্রেমের পর্দায় আঘাত লাগে বলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছল।

এত সামান্য কথায় আঘাত পাবে ধারণা করিনি। বললাম, কথাটা আমি এমনি বলেছি। সিরিয়াসলি বা তোমার মনে আঘাত দেওয়ার জন্য বলিনি। কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললাম, মনে হচ্ছে কোনো অভিসন্ধি এঁটেছ।

সেলিনা বলল, একদিন তো আমাকে সাইকোলজী ও এ্যাসট্রোলজীর ছাত্রী বানিয়েছিলে, আজ যদি আমি তোমাকে সেই কথা বলি?

বল, আমিও বলব, ঐ সব বই পড়িনি। আমার প্রেম আমাকে বলে দিয়েছে। এই কথায় দুজনেই হেসে উঠলাম।

ড্রাইভার দাদু আমাদের কথার মধ্যে এই প্রথম কথা বললেন, প্রেমিক প্রেমিকারা মনের কথা আপনা থেকে জানতে পারে, যদি তাদের প্রেম খাটি হয়। সে জন্য কোনো বই পড়ার দরকার হয় না।

আমি বললাম, দাদু, আপনার কথা হাণ্ডেড পারসেন্ট কারেক্ট।

কোর্ট হাউস স্ট্রীটের একটি দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। সেলিনা আগে নেমে আমাকে নামতে বলল। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে বলল, আপনি এখন চলে যান। দরকার মত ফোন করে ডেকে নেব।

আমাকে যে বাড়িতে নিয়ে গেল, সেটা নিচে চার কামরা ও উপরে চার কামরা। উপরে নিয়ে গিয়ে যে কামরায় বসাল, সেটা উকিলের চেম্বার। ঘরের চারিদিকের আলমারীতে সব আইনের বই। তার মধ্যে অনেক বই আমার চেনা। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার চারপাশে অনেকগুলো চেয়ার। দরজার সোজা একটা মুভিং চেয়ার রয়েছে। আমাকে বসিয়ে এক্ষুনি আসছি বলে সেলিনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মেজ মামার সঙ্গে ফিরে এল।

আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম।

মেজ মামা সালামের জওয়াব দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাকে অনেকদিন থেকে চিনি। তুমিও নিশ্চয় আমাকে চিনতে পেরেছে?

জ্বি হ্যাঁ, সেদিন সেলিনাদের বাসায় চেনা চেনা মনে হতে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

উনি আবার বললেন, তুমি আমার ছেলের মত, তাই তোমাকে প্রথম থেকে তুমি বলে সম্বোধন করেছি, কিছু মনে করোনিতো বাবা?

আপনি আমাকে এত আপন করে নিয়েছেন জেনে আমি কৃতজ্ঞ।

উনি ড্রয়ার খুলে দুটো স্ট্যাম্প বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, সবগুলো স্টার চিহ্নের পাশে সিগনেচার করে দাও।

আমি একটা স্ট্যাম্প নিয়ে পড়ে দেখি সেটা কোর্ট ম্যারেজের এ্যাপ্লিকেশন। সেলিনা আগেই সই করেছে।

মামীর সঙ্গে দেখা করে আসি বলে সেলিনা চলে গেল।

আমি সিগনেচার না করে বললাম, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

মামা বললেন, তুমি যা বলবে খুকী সেসব বলেছে। আরও যদি কিছু বলতে চাও শুনব, কিন্তু কোনো কাজ হবে না। কারণ এতকিছুর পর ওকে আর ফেরান যাবে না। ও খুব একরোখা। যা করবে বলবে, তা করেই ছাড়বে। নিজের মতের বাইরে কখনো কিছু করে না। আমার কাছে প্রথম যখন সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে নিজের মতামত জানায় তখন আমি খুব রাগারাগী করেছি। সংসারের জটিল সমস্যার কথা বলে অনেক ভয় দেখিয়েছি এবং বুঝিয়েছিও। ওর মামীমাও অনেক করে ঐসব খেয়াল ছাড়তে বলেছে। কিন্তু ওর ঐ এক কথা, হয় তোমাকে বিয়ে করবে নচেৎ আত্মহত্যা করবে। এই একরোখা স্বভাবের জন্য আমার বোন ওকে একদম দেখতে পারে না। ওকে ওর ছেলেবেলা থেকে জানি বলে নিজের মত বিসর্জন দিয়ে বাঁচাবার জন্য সাহায্য করছি।

সবকথা শোনার পর সিগনেচার করলাম। তারপর অন্য ষ্ট্যাম্পটা পড়লাম। একই জিনিসের দুই কপি অঙ্গিকার পত্র। তাতে আমার দেওয়া বিয়ের শর্তগুলো টাইপ করা। সেগুলোতেও সেলিনার সিগনেচার রয়েছে।

বললাম, ওর মতিগতি বদলাবার জন্য এই শর্তগুলো লিখে চিঠি দিয়েছিলাম। বিয়েই যখন করতে যাচ্ছি, তখন এটার আর কী দরকার?

মামা বললেন, তোমার সেই চিঠি পড়ে আমিও তা বুছেঝি; কিন্তু ওর হুকুম এটাও রেজেষ্ট্রী করতে হবে। তুমি দুটোতেই সিগনেচার করে দাও। নচেৎ ও আমাকে আস্ত রাখবে না।

আমি সিগনেচার করছি এমন সময় পনের ষোল বছরের একটি মেয়ে এসে বলল, আব্বা, আপনাদের নাস্তা খাওয়ার জন্য আম্মা ডাকছেন।

মেয়েটিকে দেখিয়ে মামা বললেন, আমার বড় মেয়ে জোহরা, এবারে ম্যট্রিক দেবে।

জোহরা আমাকে হাত তুলে তাসলিম বলল।

আমি তার প্রতিউত্তর দিলাম।

আমরা ডাইনিং রুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে সেলিনা এসে মামার পাশে বসল। একজন মহিলা আমাদের খাওয়াবার জন্য এলে সেলিনা বলল, মামীমা।

আমি সালাম দিয়ে বললাম, নাস্তা খেয়ে এসেছি, আমাকে সামান্য কিছু দিন।

মামীমা সালামের জওয়াব দিয়ে দুটো মিষ্টির সঙ্গে কলা ও আপেলের কয়েকটা ফালি দিলেন।

নাস্তার পর সেলিনা মামাকে জিজ্ঞেস করল, আমাদেরকে আর দরকার হবে?

মামা বললেন, এত তাড়া কিসের? তোমরা এখন গল্প কর। বেলা বারটার দিকে একজন পিয়ন এসে তোমাদের ডেকে নিয়ে যাবে। এগুলো এফিডেভিট করার সময় তোমাদেরকে দরকার হবে। আর দুপুরে তোমরা এখানে খাবে।

আমরা ড্রইং রুমে এসে বসলাম। জোহরাও সঙ্গে এসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কয় ভাই বোন?

দুই বোন এক ভাই। আমিই বড়। ওরা স্কুলে গেছে। আপনারা আসবেন, তাই আম্মা আমাকে আজ স্কুলে যেতে দেননি।

হঠাৎ সেলিনা বলল, তুমি সিগারেট খাচ্ছ না কেন?

আসবার সময় কিনতে ভুলে গেছি।একটা দশ টাকার নোট বের করে জোহরার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, কাউকে দিয়ে এক প্যাকেট সিজার্স সিগারেট ও একটা ম্যাচ আনিয়ে দিতে পার?

অফ কোর্স বলে জোহরা যেই টাকাটা আমার হাত থেকে নিতে গেল, সেলিনা তখন তার হাতটা টেনে নিয়ে আট আনা পয়সা দিয়ে বলল, শুধু একটা ম্যাচ, সিগারেট লাগবে না। তারপর টাকাটা আমাকে ফেরৎ দিল।

জোহরা বেরিয়ে যেতে বললাম, সিগারেট লাগবে না এ কথার অর্থ?

সেলিনা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট মূর সিগারেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, আসার সময় মৌচাক মার্কেট থেকে তোমার জন্যে কিনেছি।

মূর সিগারেট বেশ দামী। খাওয়ার সময় একটা সুগন্ধ ছড়ায়। আমি খেতে খুব ভালবাসি। অতদামী সিগারেট খেয়ে টাকা অপচয় করা পছন্দ করি না। তাই সব সময় না খেয়ে মাঝে মধ্যে খাই। জোহরা ম্যাচ দিয়ে চলে গেল।

সেলিনা একটা চেয়ার টেনে এনে আমার সামনে বসল।

সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যে এই সিগারেট খেতে ভালবাসি, তা জানলে কেমন করে? এই সিগারেট তো তোমার সামনে কোনো দিন খাইনি।

একদিন নিউমার্কেটে তোমাকে এই সিগারেট খেতে দেখেছিলাম। সে সময় এর গন্ধটা আমার খুব ভালো গেলেছিল। তাতেই বুঝেছি তুমি এই সিগারেট ভালবাস।

আজকের দিনে তুমি যদি অনেক দামী কোনো জিনিস প্রেজেন্ট করতে, তা হলেও বোধ হয় এতটা আনন্দিত হতাম না। সিগারেট ধরিয়ে জোরে টান দিয়ে সমস্ত ধোঁয়া ওর মুখের উপর ছাড়লাম বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু ওর মুখে বিরক্তের কোনো চিহ্ন দেখলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, সিগারেটের ধোঁয়াতে তোমার অসুবিধে হয় না?

হাসিমুখে সেলিনা জবাব দিল, সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধটা আমাকে মোহিত করে দেয়।

তাহলে একটা টেষ্ট করে দেখবে কি?

বাবা না, আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়।

একটা কথা বলি শোন, তোমাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য বিয়ের ব্যাপারে যেসব শর্ত লিখে চিঠি দিয়েছিলাম, তাতে যখন কোন কাজ হল না তখন সেটা রেজেষ্ট্রি করার আর দরকার নেই। যতক্ষণ ওটা থাকবে ততক্ষণ আমি আমার  বিবেকের কাছে অপমান বোধ করব। মামার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নষ্ট করে ফেল।

চিরকাল ওটা আমি সঙ্গে রাখব। আমার জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর আমার কোনো আত্মীয় যেন তোমার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় নিয়ে কোর্টে নালিশ করতে না পারে।

তার যুক্তি শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। বললাম, ঐ দলিলটা থাকলে তোমার ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমি যদি কোনো দিন তোমাকে বিট্রে করি, তাহলে তুমি কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারবে না।

আমি নিশ্চিত, যতদিন আমরা বেঁচে থাকবো, ততদিন কেউ কাউকে বিটে করতে পারব না।

এত নিশ্চয়তা পেলে কোথা থেকে?

আমার প্রেমের কাছ থেকে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি যা চিন্তা করেছি তা মিথ্যা হয়নি।

ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহপাক ওয়াকেফহাল। মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়তে যেয়ে অনেক সময় বিফল হয়।

আমি তকদির বিশ্বাস করি। সাধ্যমত তদবীর করে যাব। ফলাফল উপর ওয়ালার হাতে।

এবার জিজ্ঞেস করলাম, ডিগ্রীতে এ্যাডমিশন নেবে নাকি?

তুমি যা বলবে তাই করব।

যা বলব তা যদি তোমার মতের বিপরীত হয়, তাহলে তো এখন থেকে মনোমালিন্য শুরু হবে।

কখনও না। যেদিন থেকে তোমাকে ভালবেসেছি, সেদিন থেকে নিজের কামনা বাসনা নিজের কাছে খারাপ লেগেছে। নিজস্ব সবকিছু ত্যাগ করে তোমার মতে চললে ইহকাল ও পরকালে যে সুখ শান্তি পাব, সে কথা আমার প্রেম অনেক আগেই আমাকে শিক্ষা দিয়েছে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার এখন কি করতে বা কি খেতে ইচ্ছা করছে? তার উত্তরে বলব, আমার প্রেমিকের যা যা ইচ্ছা করবে আমারও তাই।

না, তার কথা শুনে চিন্তা করলাম, এত গভীর প্রেম ও কেমন করে পেল? কে তাকে এত শিক্ষা দিল? মনে করলাম জিজ্ঞেস করব নাকি, বিকেলে কোনো প্রোগ্রাম। আছে কিনা?

ঠিক এমন সময় সেলিনা বলে উঠল, বিকেলেও তোমাকে ছাড়ছি না। প্রথমে পার্কে যাব, তারপর কিছু কেনাকাটা করব।

কি করে যে ও আমার মনের খবর জানতে পারে, তা ভেবে খুব আশ্চর্য হলাম।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিনা আবার বলল, তোমাকে একটা অনুরোধ করছি, আজ থেকে কোনোদিন যে কোনো বিষয়ে অর্থাৎ-খাওয়া, পরা ও কোনো কাজের ব্যাপারে আমার কি পছন্দ হয়, কি ভালো লাগে বা কি ইচ্ছা জাগে, কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। কারণ তোমার সবকিছু আমার নিজের চেয়ে অধিক পছন্দ।

বেলা বারটার কিছু আগে একজন পিয়ন এসে আমাদেরকে কোর্টে নিয়ে গেল। কোর্টের কাজ সারতে দেড়টা বেজে গেল।

মামা বললেন, তোমরা বাসায় গিয়ে খেয়ে নাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর সেলিনা বলল, চল, এবার রওনা হওয়া যাক।

দাদুকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলবে না?

খেয়ে উঠেই ফোন করেছিলাম। উনি দশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছেন।

মামা মামীর সঙ্গে দেখা না করে কি যাওয়া ঠিক হবে?

তোমরা দুজনে আবার আসবে কিন্তু বলে মামীমা ঘরে ঢুকলেন।

আমরা দুজনে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।

তিনি দোয়া করলেন, আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুন। তারপর বললেন, তোমার মামার খাবার একজন এসে নিয়ে গেছে। উনি কখন ফিরবেন তার কোনো ঠিক নেই

মামীমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রমনা পার্কের লেকের ধারে সেই জায়গায় গেলাম। সেখানে পৌঁছে সেলিনা আমাকে কদমবুসি করল।

আমি তাকে দুহাত দিয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে মাথায় ও কপালে চুমো খেয়ে দোয়া করলাম, হে পরওয়ারদিগারে আলম, তুমি আমার প্রেমিকার সমস্ত নেক মকসুদ পুরণ কর। আমি যেন তাকে সুখ শান্তি দিতে পারি সে তওফিক তুমি আমাকে এনায়েৎ কর। তারপর তার ডান হাতটা নিয়ে চুমো খাওয়ার সময় শাহাদাৎ আঙ্গুলে আস্তে করে কামড়ে দিলাম।

সেলিনা একবার কেঁপে উঠে কামড়ে দেওয়া আঙ্গুলটা নিয়ে চুষতে লাগল।

বললাম, এত জায়গা থাকতে এখানে এলে কেন?

এই জায়গাটাকে চিরকালের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম। কিছু মার্কেটিং করব, কোথায় যাবে? নিউ মার্কেট, না বায়তুল মোকাররমে?

গ্যানিসে, তার আগে বায়তুল মোকাররমে একবার যাব।

দাদুকে সেই মতো বলে গাড়িতে উঠলাম। বায়তুল মোকাররমে পৌঁছে দোতলার একটি জুয়েলারী-দোকানে ঢুকলাম।

দোকানের ম্যানেজার আমার খুব বন্ধু লোক। কয়েকদিন আগে তাকে দুটো আংটি তৈরি করার অর্ডার দিতে এসে সেলিনার ব্যাপারটা বলেছিলাম।

আমাদেরকে দোকানে ঢুকতে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, কি খবর খান সাহেব? সাথে নিশ্চয় নতুন ভাবি?

সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ঠিক ধরেছেন।

তাহলে তো মিষ্টি খাওয়ান উচিত।

সে সব আর একদিন হবে। আজ সময় কম, আপনি আংটি দুটো তাড়াতাড়ি দিন।

ম্যানেজার দুটো ছোট বাক্স এনে কাউন্টারের উপর রাখলেন।

আমি সেলিনাকে বললাম, দুটি বাক্সে দুজনের নাম লেখা দুটি আংটি আছে, বাক্স না খুলে তোমারটা তোমাকে বেছে নিতে হবে। কি, পারবে না?

সেলিনা কয়েক মুহুর্ত আমার মুখের দিকে চেয়ে কি যেন চিন্তা করল। তারপর একটা বাক্স খুলে ফেলল।

আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যে বাক্সটা খুলল, তাতে তারই নাম লেখা আংটিটা রয়েছে।

আমি আংটিটা নিয়ে তার ডান হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিলাম।

সেলিনা অন্য বাক্সটা খুলে নূরজাহান নাম লেখা দেখে বলল, এটা নিশ্চয় আপামণির নাম?

হ্যাঁ বলে ম্যানেজারকে দাম মিটিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করে জানলে কোনটাতে তোমার নাম লেখা আছে?

তা বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, আল্লাহপাকের মেহেরবাণীতে আমার প্রেম জয়ী হয়েছে।

তোমার প্রেমের দাম আমি দিতে পারব কিনা জানি না। আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করছি, তিনি যেন তোমাকে সুখি করেন।

গ্যানিসে গিয়ে সেলিনা বলল, তোমার পছন্দমতো আমার জন্য কাপড় চয়েস করে দাও।

আমি দোকানের একজন কর্মচারীকে ওর মাপের সালওয়ার কামিজ দেখাতে বললাম, অনেকগুলোর মধ্যে সবুজ ও হলুদ রং এর দুসেট পছন্দ করে বললাম, এই গুলোর মেমো দিন, ছোট বড় হলে চেঞ্জ করে নেব। তারপর সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, জরিনার জন্য কিছু কিনবে না?

জরিনা গতকাল আম্মার সঙ্গে নিউমার্কেটে গিয়ে কিনেছে।

ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে মেমো নিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য যেই মানিব্যাগ বের করেছি, অমনি সেলিনা ঝটকরে আমার হাত থেকে মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে কর্মচারিটিকে ঐ কালারের আরও দু সেট দিতে বলল।

আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দোকানের কর্মচারীকে শুধু হলুদ সেটটা দিতে বলে সেলিনাকে বললাম, মানিব্যাগটা দাও।

দেব, তবে এখন নয়। তোমার জন্যেও কাপড় চয়েস কর।

বললাম, আজ নয়, অন্যদিন।

আমি যে একটু রেগে গেছি, তা বুঝতে পেরে সেলিনা তিন সেট কাপড়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে বলল, চল, আজ আর কিছু কিনব না। গাড়ির কাছে এসে আমাকে মানিব্যাগটা ফেরৎ দিয়ে বলল, তুমি রাগ করো না। আজ তোমাকে আমি শুধু কাপড় চয়েস করে দিতে এনেছি। অন্য দিন তুমি যা খুশী কিনে দিও, আপত্তি করব না। আর এই সেটটা আজকের আনন্দের দিনে আপামনিকে উপহার স্বরূপ দিলাম বলে একটা কাপড়ের বাক্স আমার হাতে দিল।

তোমার কথা কিন্তু বলতে পারব না।

তোমার যা ইচ্ছা তাই বলো।

সেলিনাকে বিদায় দিয়ে আমি আবার গ্যানিসে গিয়ে দুটো বাচ্চার দুসেট কাপড় কিনলাম। তারপর মসজিদে আসরের নামায পড়ে ঠাঠারী বাজারে এক বন্ধুর দোকানে গেলাম। সেখানকার কাজ সেরে মাগরিবের নামায পড়ে বাসায় ফিরলাম।

আমার স্ত্রী হাত থেকে কাপড়ের প্যাকেটটা নিয়ে খুলে খুব খুশি হল।

বাথরুমে হাতমুখ ধুতে যাওয়ার সময় নতুন সেটটা পরতে বললাম। ফিরে এসে দেখি, নতুন কাপড় পরে নিজেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখছে।

আমি আংটিটা পকেট থেকে বের করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ তোমাকে খুব সুন্দরী দেখাচ্ছে।

আমাকে কদমবুসি করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি ব্যাপার, আজ এতগুলো টাকা খরচ করলে যে?

আমি তার মাথায় চুমো খেয়ে বললাম, আমার মন চাইল, তাই করলাম। কেন? কোনো অন্যায় করেছি নাকি? তুমি কৈফিয়ৎ চাইছ যে?

আমি কি তাই বললাম, বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।

আমিও তার প্রতিদান দিলাম।

৪. ড্রাইভিং লাইসেন্স অনেক আগের

আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স অনেক আগের থেকে ছিল। সাহেবদের গাড়িতেই ড্রাইভিং শিখি। সে খবর সাহেব জানতেন। মাঝে মাঝে ড্রাইভার যখন অনুপস্থিত থাকত তখন প্রয়োজন মতো আমি গাড়ি চালাতাম। একদিন ড্রাইভার অসুস্থ থাকায় টেণ্ডারের ব্যাপারে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে আমি একা গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে এসে নিউমার্কেটের এক নাম্বার গেটে গাড়ি পাক করার সময় সেলিনা, জরিনা, জোবেদা ও আরো দুজন মেয়েকে তাদের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম। পাশে জায়গা খালি দেখে সেখানে পার্ক করার সময় ইচ্ছে করে তাদের গাড়ির সঙ্গে আস্তে করে ঠেকিয়ে দিলাম। ফলে একটু শব্দ হল এবং তাদের গাড়িটা একটু নড়ে উঠল।

জরিনা ও জোবেদা একসঙ্গে গর্জন করে উঠল, ননসেন্স, গাড়ি পার্ক করতে পারেন না তো ড্রাইভিং করেন কেন? তারপর ড্রাইভিং সিটে আমাকে দেখতে পেয়ে দুজনেই জিব কেটে বলল, মাফ করবেন, আমরা আপনাকে দেখে বলিনি।

বললাম, আমি লাটসাহেব নাকি যে, আপনারা অন্যায়কারীর কাছে মাফ চাচ্ছেন। তাছাড়া লাটসাহেব হোক আর জজসাহেবই হোক, অন্যায় করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। মুখে আরও কিছু বর্ষণ করে যত খুশি শাস্তি দিন, সহ্য করব; কিন্তু আপনারা সকলে মিলে যদি হাত দিয়ে দেন, ত লে বাঁচব কিনা সন্দেহ।

জরিনা ও জোবেদা হাসতে হাসতে দুজনে গাড়ির ভিতর হাত বাড়িয়েছে আমাকে ধরে নামাবার জন্য।

আমি বললাম, রাস্তার লোকজন কিছু হয়েছে মনে করে ছুটে আসবে। তখন আবার কেলেংকারী হয়ে যাবে। তারচেয়ে আপনারা সরুন, আমি নামছি।

তারা সরে যেতে গাড়ি থেকে নেমে দুহাত জোড় করে বললাম, আমার কৃত অন্যায়ের জন্য সকলের কাছে মাফ চাইছি। আশা করি, আপনারা নিজগুণে এই অধমকে মাফ করে দেবেন।

আমার কাণ্ড দেখে তারা সবাই হাসতে লাগল।

হঠাৎ জোবেদা বলল, আপনি অধম হলে উত্তম কে?

আমি সেলিনার দিকে চেয়ে বললাম, যিনি ভালভাবে গাড়ি পার্ক করতে পারেন। তারপর বললাম, কাদেরকে ঘায়েল করার জন্য শিকারীদের আগমন?

অন্য একটা মেয়ে বলল, আজকাল মনের মত শিকার পাওয়া যায় না।

বললাম, সে জন্য শিকারীকে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। শিকার ঠিকই আছে, নেই শুধু দক্ষ শিকারী। যারা অল্প দক্ষতা নিয়ে শিকার করে, পরবর্তী জীবনে তারা অশেষ দুঃখ ভোগ করে।

ঐ মেয়েটি আবার বলল, সেলিনা কিন্তু দক্ষ শিকারী।

সেটার প্রমাণ আপনারা এখনও পাননি। তাছাড়া কোনো কোনো সময় দক্ষ শিকারীর টীপও ফসকে যায়। যেমন রবীনহুড। তিনি সে যুগে অদ্বিতীয় তীরন্দাজ ছিলেন; কিন্তু কোনো এক প্রতিযোগিতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। তারপর বললাম, চলুন কিছু জলযোগ করা যাক।

সেলিনা এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু লক্ষ্য করছিল। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলে?

জাহাঙ্গীরনগর ইউনির্ভাসিটিতে।

হাঁটতে হাঁটতে সেলিনা বলল, তুমি ড্রাইভিং জান, আমাকে বলনি কেন?

দরকার হয়নি। হলে নিশ্চয় জানাতাম।

আমরা সকলে নভেল ড্রিংকে গিয়ে বসলাম। সেলিনা আমার সামনের চেয়ারে বসল। আমি সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম, যে যার পছন্দমত অর্ডার দিন।

প্রথমে সেলিনা দুটো ফান্টার অর্ডার দিল। ওরাও সবাই তা দিতে বলল।

আমি সেলিনাকে বললাম, ওরা হয়তো অন্য কিছু খেত, তুমি ফান্টার অর্ডার দিতে অন্য কিছু খেতে লজ্জা বোধ করছে।

আমার কথা জরিনা শুনতে পেয়ে বলল, আমরা এখান থেকে খেয়ে বেরুবার পর আপনার সঙ্গে দেখা।

জোবেদা জিজ্ঞেস করল, আপনি গাড়ি ধীরে না জোরে চালাতে ভালবাসেন?

সব সময় আমি স্মার্টনেস পছন্দ করি। স্লোর মধ্যে যেন জীবন খুঁজে পাই না।

জলযোগ শেষ করে বিল মিটিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোকানে গেলাম।

.

কোর্ট ম্যারেজ এপ্লিকেশনের তিনমাস পর একদিন বেলা দশটার সময় সেলিনা ফোন করে বলল, আগামীকাল আমাদের কোর্ট ম্যারেজ ডেট। সকাল আটটায় মেজ মামা বাসায় যেতে বলেছেন।

কথাটা শুনে মনের মধ্যে ভয়মিশ্রিত আনন্দ অনুভব করলাম। কোনো কথা না। বলে চুপ করে রইলাম।

কি হল? চুপ করে আছ কেন?

সামলে নিয়ে বললাম, তুমি বলছ, আমি শুনছি। মহারাণীর আদেশ শিরোধার্য্য।

সেলিনা বলল, সাহেবের ও আপামনির কাছ থেকে কয়েকদিনের ছুটি নেবে।

ভাবলাম, আমাকে একান্ত করে পাওয়ার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, মহারাণীর আর কোনো আদেশ আছে?

মহারাণীর আদেশ নয়, দাসীর আর একটা অনুরোধ, আজ বেলা দুটোর সময় ফেব্রিক্স হাউসের সামনে একটু আসবে। আমি দুএকটা জিনিস কিনব।

বললাম, তথাস্তু।

সেলিনা সালাম দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।

নিউমার্কেটের রূপালী ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তুললাম। দুপুরে সাহেবকে ফোন করে একসপ্তাহের ছুটি চাইতে তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন।

বেলা দুটোর সময় ফেব্রিক্স হাউসের সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় সেলিনাকে আসতে দেখলাম। সাদা ধবধবে সালওয়ার কামিজ পরেছে। আর ঐ একই কাপড়ের রুমাল ও ওড়না দিয়ে মাথা, বুক ও পিঠ ঢেকে দিয়েছে। মনে হল গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে মার্কেটের আঙ্গিনা দিয়ে একটা বেহেস্তের হুর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি সবকিছু ভুলে তন্ময় চিত্তে তার দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, এই নিস্পাপ হুরের মত, মেয়েটার তুমি কি উপযুক্ত? কথাটা চিন্তা করে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

আমার কাছে এসে সেলিনা সালাম দিয়ে বলল, চল, বোরখা কিনব।

আমি চিন্তার মধ্যে এমনিই ডুবে ছিলাম যে, তার কোনো কথা আমার কানে গেল না। অপলক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকলাম।

আমাকে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেলিনা আমার একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি এত চিন্তা করছ?

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, কি যেন বলছিলে?

আগে বল, তুমি এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছিলে?

আমার প্রিয়তমার কথা।

কিন্তু আমার মন বলছে, তার সঙ্গে আরো কিছু যেন ভাবছিলে।

সবটা শুনলে তুমি যদি আবার কিছু মনে কর।

আমি কিছু মনে করব না, প্লীজ বল।

চল যেতে যেতে বলছি। তারপর যেতে যেতে বললাম, তোমাকে আসতে দেখে বেহেস্তের হুর বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তুমি কি এই হুরের উপযুক্ত? কথাটার সত্যতা চিন্তা করে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

সেলিনা দ্রুত আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে বলল, কথা দাও, আর কখনও এ রকম কথা ভাববে না।

হেসে ফেলে বললাম, মন কি কারো কেনা গোলাম যে, হুকুম করলেই মেনে চলবে? তবে তোমার কথাটা রাখার জন্য মনকে কড়া শাসন করে দেব, যাতে করে ভবিষ্যতে আর এ রকম চিন্তা যেন না করে।

তারপর আমরা একটা দোকানে গিয়ে বোরখা কিনলাম। সেলিনা দোকানের একজন কর্মচারীকে আমার জন্য পাজামা পাঞ্জাবী দেখাতে বলে আমাকে কালারটা বলতে বলল।

আমি বললাম, আমার এখন কোনো কিছু কেনার দরকার নেই।

তোমার দরকার না থাকলেও আমার আছে। এই বলে তাকে ট্যাট্রনের সাঁদা পাজামা এবং ঘীয়ে রং এর নক্সা করা সূতীর পাঞ্জাবী দিতে বলল। কেনাকাটা শেষ করে সেলিনা বলল, অনেক কাজ বাকি আছে, এখন আমাকে যাওয়ার অনুমতি দাও। ইনশা আল্লাহ আগামীকাল দেখা হবে।

বললাম, চল না একটু নভেলে রেষ্ট নেবে। তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

সেলিনা বলল, ঠিক বলেছ, চল একটু গলা ভিজিয়ে নিই।

আমরা নভেলে গিয়ে বসলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, কি দিতে বলব?

সেলিনা বলল, তোমার যা মন চায়

আমি বেয়ারাকে ডেকে দুই পীস ফ্রুটকেক ও দুটো ফান্টা দিতে বললাম।

তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে সেলিনাকে গাড়িতে তুলে দিলাম।

সেলিনা বোরখার সঙ্গে আমার জন্য কেনা পাজামা পাঞ্জাবীর প্যাকেটটাও নিয়ে চলে গেল।

রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বললাম, কোম্পানীর কাজে আগামীকাল ঢাকার বাইরে যাব, ফিরতে তিন দিন দেরি হবে।

এই পর্যন্ত বলে জামান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই হয়তো ভাবছিস, আমি একজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। এটাই ভাবা স্বাভাবিক। এই কথা চিন্তা করে আমিও তখন আমার বিবেকের কাছে খুব ছোট হয়ে গেছি। কিন্তু স্ত্রীকে সত্য ঘটনা বলে তাকে অশান্তির আগুনে জ্বালাতে চাইনি। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সারাজীবন তার মনে অশান্তির আগুন লাগতে দেব না। সে জন্য যত স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় করবো। যত তিতিক্ষা সহ্য করতে হয় করব। তাই পরবর্তী। জীবনে সেলিনাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেও আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কোনো দিন এতটুকু খারাপ ব্যবহার করিনি।

ঐ দিনটির কথা আমার চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সেই দিন আমার স্ত্রী নাস্তা খাইয়ে কাপড়-চোপড় ব্রীফকেসে গুছিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে কদমবুসি করল। আমার মনটা তখন ব্যাথায় টনটন করে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক রেখে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

ঠিক আটটার সময় কোর্ট হাউস স্ট্রীটে সেলিনার মেজ মামার বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম।

ওর মামাতো বোন জোহরা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। আমাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ভালো আছি।

জোহরা আমার হাত থেকে ব্রীফকেস ও মিষ্টির বাক্স নিয়ে বলল, আসুন। আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে জোহরা চলে গেল। সেখানে তার ছোট দুই ভাইবোন। খেলা করছিল। আমি টফির বাসটা একজনের হাতে দিয়ে বললাম, তোমরা দুজনে ভাগ করে নেবে। টফির বাসটা আর খেলনাগুলো নিয়ে তারা চলে গেল। একটু পরে সেলিনার মেজ মামা এলে আমি সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলাম।

সালামের উত্তর দিয়ে মামা বললেন, ভালো আছি। তারপর বললেন, তোমাকে খুকী বোধ হয় সবকিছু বলেনি। ঠিক সাড়ে এগারটার সময় তোমরা ঐ জজের ঘরে যাবে, যেখানে তোমাদের এ্যাপ্লিকেশন এফিডেভিট হয়েছিল। কোর্টের কাজ শেষ হওয়ার পর কোথাও যাবে না। রাত্রে এখানে সামাজিক প্রথায় তোমাদের বিয়ে হবে।

নাস্তা খেয়ে মামা কোর্টে চলে গেলেন।

ড্রইংরুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি সিগারেট খাচ্ছি। মনের মধ্যে তখন নানা রকম চিন্তা এসে ভীড় করছে। সমস্ত চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাববার চেষ্টা করছি। পিঠে কারুর নরম হাতের মৃদু স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দেখি, সেলিনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় তার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে গেছে। আমি তার লজ্জা কাটাবার জন্য সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?

সেলিনা সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, ভালো আছি। লজ্জা করছিল বলে এতক্ষণ আসতে পারিনি, কিছু মনে করনি তো?

লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা নেই তার ঈমানও নেই। তারপর বললাম, বায়তুল-মোকাররম যাব, যাবে নাকি?

যাব, একটু অপেক্ষা কর, এক্ষনি আসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাপড় পাল্টে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমার জন্য কিছু কিনবে?

বললাম, তুমি তো আমার মনের সব কথা জান।

সেলিনা আমার দুটো হাত ধরে বলল, কিন্তু পেমেন্ট আমি করব। আজকের এই অনুরোধটা তোমাকে রাখতেই হবে।

আজ তোমাকে কিছু দিতে মন চাইছে। পেমেন্ট তুমি করলে আমার তো আর তোমাকে কিছু দেওয়া হল না।

তাহলে সামান্য কিছু দিও।

সে দেখা যাবে বলে আমরা বায়তুল মোকাররমে ঐ বন্ধুর দোকানে গিয়ে অর্ডার দেওয়া গহনা দিতে বললাম।

উনি তিনটে বাক্স এনে খুলে দিয়ে সামনে রাখলেন। একজোড়া কংকন, একজোড়া কানের দুল ও একটা টায়রা।

চেকে পেমেন্ট দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পছন্দ হয়েছে?

সেলিনা আমার হাত থেকে বা তিনটে নিয়ে বলল, আমার মনের মত হয়েছে। আমি নিজেও বোধ হয় এত ভালো ডিজাইন চয়েস করতে পারতাম না। গাড়িতে উঠে সব পরে ফেলল।

বললাম, বিয়ের সময় ওগুলো পরতে হয়।

সেলিনা বলল, এখনই তো আমাদের বিয়ে হবে।

ড্রাইভার দাদুকে বললাম, গ্যানিসে চলুন। গাড়ি ততক্ষণে গুলিস্তানে চলে এসেছিল। দাদু গাড়ি ঘুরিয়ে গ্যানিসের সামনে পার্ক করল।

সেলিনার জন্য গাঢ় লাল রং এর জাপানি সিফনের একটা শাড়ী, ওড়না, গোলাপি রং এর সার্টিন কাপড়ের একসেট সালওয়ার কামিজ, দুটো রুমাল ও একজোড়া ব্রা কিনলাম। তারপর বাটায় গিয়ে তার জন্য জুতো কিনে ফেরার পথে বললাম, এগুলোর মধ্যে তোমার ইচ্ছামতো বিয়ের সময় পরবে।

যথা সময়ে ঠিকমত সব কাজ মিটে গেল। সন্ধ্যার পর সেলিনাদের ভাড়াটিয়া দারোগা সাহেব স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। বিয়ের পর খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলেন। জরিনা তাদের সঙ্গে এসেছিল, সে থেকে গেল। বিয়েতে কোনো আত্মীয়-স্বজন আসেনি। সবশেষে জোহরা ও জরিনা যখন আমাকে বাসর ঘরে দিয়ে গেল তখন রাত্রি এগারটা।

দেখলাম, সেলিনা খাটের উপর বসে আছে। মাথার ওড়নাটা মুখের উপর একটু নামান। আমি ঘরের দরজা জানালা আটকে দিয়ে পর্দাগুলো টেনে ঠিক করে চেয়ারে এসে বসলাম।

সেলিনা ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।

আমি দাঁড়িয়ে তাকে দুহাত দিয়ে তুলে বুকে জড়িয়ে প্রথমে মাথায় তারপর দুগালে শেষে অধরে অধর ঠেকিয়ে চুমো খেয়ে দোয়া করলাম-হে রাব্দুল আলামিন, তুমি আমাদের দাম্পত্য জীবনে শান্তির ধারা বর্ষণ কর। আমাদের ঈমানকে তোমার পথে দৃঢ় রেখ। আমাদের প্রেমকে কোনো দিন লাঞ্ছিত করো না।

সেলিনার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছিল। বললাম, তোমার অযু আছে?

সেলিনা মাথা নেড়ে জানাল আছে।

তাহলে এস আল্লাহপাকের দরবারে দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ি।

সেলিনা খুব আস্তে আস্তে বলল, আমাকে এই নামাযের নিয়েত ও নিয়ম শিখিয়ে দাও।

তাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে দুজনে শোকরানার নামায পড়লাম। তারপর তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে আদর করে খাটে শুইয়ে দিয়ে বললাম, তুমি ঘুমাও, আমি একটু পরে ঘুমাব।

আমি চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে সিগারেট ধরালাম। মনের মধ্যে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। কিছুতেই নিজেকে সম্বরণ করতে পারছিলাম না। কেবলই মনে হতে লাগল, আমি আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম।

সেলিনা যখন আমার পায়ে হাত দিল তখন সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখলাম, আমার দুপা জড়িয়ে কাঁদছে। আমি সব চিন্তা দূর করে দিয়ে তাকে তুলে কোলে বসিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ব্যবহারে কী তুমি ব্যাথা পেয়েছ?

সেলিনা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, অমন কথা বল না। বরং আমিই চিন্তা করছি, আমার সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে অশান্তির মধ্যে ফেলে দিলাম না তো? আমার জন্য তুমি অশান্তি ভোগ করবে, সেটা যে আমি সহ্য করতে পারছি না।

দেখ, আমরা পুরুষ, আমাদেরকে অনেক কিছু বিপদ-আপদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতে হয়। আজ ঐসব কথা বলে আনন্দের রাত্রিকে নিরানন্দ করে লাভ নাই। চল ঘুমাবে চল।

তুমি একটু বস বলে সেলিনা নিজের সুটকেস খুলে একটা অটোমেটিক ওমেন্স ঘড়ি বের করে এনে আমার হাতের ঘড়িটা খুলে নিয়ে পরিয়ে দিল। আর আমার ঘড়িটা নিজের হাতে পরে নিল। তারপর বলল, তুমি আমাকে তোমার মনের মত করে গড়ে নিও। হয়তো অনেক সময় অন্যায় করে ফেরব, সেজন্য যা মনে চায় শাস্তি দিও, কিন্তু রাগ বা অভিমান করে কখনও আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে না বল?

সেলিনার প্রেমের গভীরতা অনুভব করে বললাম, যারা প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকা তারা একে অন্যের অন্যায়কে প্রেমের এমতেহান মনে করে থাকে। আর প্রত্যেক নারীর উচিৎ পানির ধর্ম অনুসরণ করা। তাহলে স্বামী-স্ত্রীর মধে কোনোদিন মনোমালিন্য হবে না।

পানির ধর্ম কি বুঝিয়ে দাও।

পানির ধর্ম তিনটি। (১) পানি সব সময় নিচের দিকে প্রবাহিত হয়।

(২) পানির নিজস্ব কোনো আকার নেই। তাকে যে পাত্রেই রাখা হোক না কেন, সেই পাত্রের আকার ধারণ করে।

(৩) পানির কোনো রং নেই। সে যে কোন রঙের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই রঙে রঙ্গিন হয়ে যায়।

এখন বুঝতে পারছ কেন আমি নারীকে পানির ধর্ম অনুসরণ করার কথা বললাম।

তুমি দোয়া কর, আমি যেন আমার জীবনকে তোমার জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তোমার রঙে রঙ্গিন হয়ে যেতে পারি।

তোমাকে আল্লাহপাক আমার মনের মত করে গড়েছেন। নচেৎ আমার সবকিছু তোমার পছন্দ হবে কেন? আর আমার মনের খবরই বা জানতে পার কি করে?

যে কাপড়গুলো আমি কিনে দিয়েছিলাম সে তার থেকে সালওয়ার কামিজ পরেছিল। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি যখন তাকে কোলে তুলে নিই তখন ওড়নাটা মেঝেতে পড়ে যায়। পলকহীনভাবে আমি তার সৌন্দৰ্য্য সুধা পান করছিলাম।

আমাকে একদৃষ্টে তারদিকে চেয়ে থাকতে দেখে এতক্ষণে খেয়াল হল যে, গায়ে ওড়না নেই। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি করে যেই ওড়নাটা তুলতে গেল আমি তখন তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলাম।

সেলিনা উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঘুমাবে না?

নিশ্চয়, তবে তুমি আগে ঘুমিয়ে পড়, তারপর।

তা কখন হয় নাকি? তুমি জেগে থাকবে আর আমি ঘুমাব?

তাহলে তুমিও আমার সঙ্গে জেগে থাক, পারবে তো জেগে থাকতে?

কেন পারব না? তুমি পারলে, আমিও পারব।

তুমি তাহলে এখানে বস, আমি ঐ চেয়ারটায় বসব। দেখি কে কতক্ষণ জেগে থাকতে পারি? এই কথা বলে খাট থেকে নেমে গিয়ে চেয়ারে বসে পরপর দুটো সিগারেট খেলাম। সেলিনা সারাক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার প্রতি খুব মায়া হল। উঠে গিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়ে আমিও পাশে শুয়ে বললাম, আজকের আমার এই ব্যবহারের জন্য আমি খুব দুঃখিত। তবু বলছি তোমাকে ঘুমাতে দেখলৈই আমি ঘুমাব।

সেলিনা ছল ছল নয়নে বলল, তারচেয়ে আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই তুমি ঘুমাও।

আমি আর কিছু না বলে তার দিকে মুখ করে শুলাম। সেলিনা আমার চুলে বিলি কাটতে লাগল। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ভোরে মোয়াজ্জিনের আযান শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম, সেলিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। আমি খুব ধীরে ধীরে তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে উঠে তার ঠোঁটে আলতো করে চুমো খেলাম। এতেই সে জেগে গেল। ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকাল।

বললাম, উঠে পড়, ফজরের আযান হয়ে গেছে। দুজনে একসঙ্গে নামায পড়ব। আমি বাথরুম থেকে আসার পর সেলিনা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বাথরুমে গেল, ফিরে এসে আমার সঙ্গে নামায পড়ল।

নামাযের পর জিজ্ঞেস করলাম, কুরআন শরীফ পড়তে জান?

না, তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে।

তোমাদের বাসার কাছের মসজিদের ঈমাম সাহেবকে ঠিক করে দেব। তিনি তার সময় মতো প্রতিদিন এসে তোমাকে পড়িয়ে যাবেন। এখন আমাকে কিছু খাওয়াতে পার?

সেলিনা ফ্রিজ থেকে চার পাঁচটা বড় মিষ্টি ও কয়েক পিস স্লাইস রুটি বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, তোমার জন্য আনিয়ে রেখেছি।

তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। একটু মিষ্টি তার মুখে দিয়ে আমার সঙ্গে খেতে বললাম।

সামান্য খেয়ে বলল, আমাকে হাত ধোয়ার অনুমতি দাও। আমি ভোরে মোটেই কিছু খেতে পারি না।

বললাম, খেতে যখন পারবে না তখন পারমিশান দিলাম।

নাস্তার পাঠ শেষ করে বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরিয়ে বললাম, আমি এখন ঘুমাব, তুমিও ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে ঘুমাতে পার।

মামীমা উঠে পড়েছে, এখন ঘুমাতে লজ্জা করছে। তুমি ঘুমাও, আমি বরং হেঁসেলে মামীমাকে সাহায্য করি গিয়ে। আচ্ছা, শুয়ে চোখ বন্ধ করেই তুমি কী করে ঘুমিয়ে পড়?

ওটা আমার ছেলেবেলা থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। রাত্রে হোক আর দিনে হোক, যে কোনো সময়ে যদি ঘুমাবার ইচ্ছা করি তখনই ঘুমাতে পারি। ঘুমাবার সময় সব চিন্তা দূর করে দিয়ে আল্লাহপাকের জিকির করি, আর তখনই ঘুম ধরে যায়। তবে ইচ্ছা করলে আবার সমস্ত রাত্রি জেগেও থাকতে পারি, তাতে আমার কোনো অসুবিধে হয় না। তুমিও একটু চেষ্টা করলে এইভাবে ঘুমাতে পারবে। এখন আমার সঙ্গে একটু চেষ্টা করে দেখবে নাকি?

সেলিনা হেসে উঠে বলল, এখন নয়, অন্য এক সময় দেখা যাবে।

সিগারেট এ্যাসট্রেতে গুজে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললাম, ঠিক নটার সময় জাগাবে।

সেলিনা আমার পাশে বসে বন্ধ দুচোখে চুমো খেয়ে দ্রুত খাট থেকে নেমে চলে গেল।

আমি কিছু না বলে শুধু একটু হেসে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

৫. আমার যখন ঘুম ভাঙল

আমার যখন ঘুম ভাঙল তখন পৌঁনে নটা। বাথরুমে সাওয়ারের পানি পড়ার শব্দ পেলাম। আলনায় সেলিনার বিয়ের আগে কিনে দেওয়া লাল শাড়ী, ব্লাউজ ও ব্রা দেখে মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি জাগল। বাথরুমের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুয়ে রইলাম।

অল্পক্ষণ পরে সেলিনা দরজা একটু ফাঁক করে আমার দিকে তাকাল। আমাকে ঘুমন্ত মনে করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আনার কাছে গেল। তার গায়ে শুধু একটা বড় তোয়ালে জড়ান ছিল। ঐ অবস্থায় তাকে দারুন লাগছিল। কাপড় পরার সময় তার শরীরের অনেক গোপন অংশ দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কিন্তু সে ভাবটা খুব কঠোর ভাবে দমন করে তার সৌন্দয্য সুধা পান করতে থাকি। তারপর সেলিনা ড্রেসিং টেবিলের কাছে বসে নিজেকে পরিপাটি করে সাজাল। পাশে ড্রইংরুমের ঘড়িতে নটা বাজতে সেলিনা খাটের কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে আমার ঠোঁটে চুমো খেয়ে যেই সোজা হতে গেল, ঠিক তখনই আমি তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললাম

বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,
ফাঁদে পড়ে এবার তার দিয়ে যাও দাম।

এ-মা তাহলে তুমি জেগে ছিলে?

শুধু জেগেই নয়, মহারাণীর সব কার্যকলাপ অবলোকনও করেছি।

সেলিনার মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, বিবসনা নারীকে দেখা ইসলামে কঠোর ভাবে নিষেধ।

বললাম, হাদিসটা সত্য, কিন্তু নিজের স্ত্রীর বেলায় প্রযোজ্য নয়। এটাও হাদিসের কথা।

যাও, দুষ্টু কোথাকার। ছি, ছি, আমার বুঝি লজ্জা করে না? ছেড়ে দাও কেউ এসে পড়তে পারে।

আসুক গে, আমি তো আর কোনো অন্যায় করছি না। বিনা অনুমতিতে যে আসবে, সেই, বরং অন্যায় করবে।

তোমার দুটি পায়ে পড়ি ছেড়ে দাও লক্ষীটি।

তার আগে মুক্তিপণ চাই।

সেলিনা আমার ঠোঁটে চুমো খেলে আমি আস্তে করে তার ঠোঁটে কামড়ে দিলাম। তারপর ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলাম।

নটি বয় বলে সেলিনা কাপড় ঠিক করতে করতে বলল, বাথরুমে সবকিছু আছে, তুমি গোসল করে নাও, আমি নাস্তা নিয়ে আসি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি গোসল করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, নাস্তা টেবিলের উপর রেখে সেদিনকার কেনা পাজামা পাঞ্জাবী হাতে করে সেলিনা দাঁড়িয়ে আছে।

তার হাত থেকে সেগুলো নিয়ে পরতে পরতে বললাম, প্রথমে নিউমার্কেটে তারপর আম্মাকে সালাম করতে যাব।

সেলিনা বলল, আম্মা বিয়েতে মত দেয়নি। সেইজন্য এখানে আসেও নি। সেখানে গেলে আবার যদি তোমাকে অপমান করে?

উনি মা, আমাকে যত বড় অপমান করুন না কেন, আমার কর্তব্য আমি করব। ওঁর কোনো দুর্ব্যবহারই আমাকে কর্তব্য থেকে বিরত করতে পারবে না।

নাস্তা খাওয়ার পর জরিনাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা নিচে এলাম।

ড্রাইভার দাদু আমাকে সালাম দিয়ে বলল, দুলাভাই কেমন আছেন?

আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ভালো আছি। আপনি কাল এলেন না কেন?

আম্মাকে নিয়ে কাল গুলশানে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম, ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, তাই আসতে পারি নি।

দাদুকে নিউমার্কেটে যেতে বলে গাড়িতে উঠলাম। মার্কেটে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার সময় সেলিনাকে বললাম, তুমি আসবে না কি?

আমাকে আস্তে করে খামচি কেটে বলল, আমার মতামত জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছি না।

বললাম, ভুল হয়ে গেছে। তারপর জরিনার দিকে তাকাতে ও বলল, আপনারা যান, আমি যাব না।

সেলিনাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্যাংকে গেলাম। একটা চেক কেটে একাউন্টটেন্ট সাহেবকে বললাম, দেখুন তো এই চেকের পরিমাণ টাকা আমার একাউন্টে আছে কি না?

উনি চেকটা নিয়ে এসে বললেন, আছে।

আমি ক্যাশ করে দিতে বললাম।

কিছুক্ষণ পর একজন এসে টাকাগুলো আমার সামনে রাখল।

আমি টাকাগুলো গুণে নিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে অলিম্পিয়ায় গিয়ে ফুটস কেক ও মিষ্টি কিনে গাড়িতে উঠে ড্রাইভার দাদুকে বললাম, আপনাদের বাসায় চলুন।

সেলিনা এতক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে কি যেন ভাবছিল।

বললাম, তোমাদের বাসায় যাচ্ছি বলে কি তোমার ভয় হচ্ছে? আমার কিন্তু ভয় ডর বলতে কিছু নেই। তবু যখন কিছু বলল না, তখন ভাবলাম, ব্যাংক থেকে এত টাকা তুলেছি বলে হয়তো চিন্তা করছে।

গাড়ি ওদের বাসায় পৌঁছাবার পর ড্রাইভার দাদু নেমে প্রথমে সেলিনার দিকের এবং পরে আমার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, নেমে আসুন।

জরিনা সামনে বসেছিল, সে আগেই নেমেছে। আমাদের দেখে জোবেদা ও আরও দুতিন জন মেয়ে এসে দাঁড়াল।

আমি গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলাম।

জোবেদা সালামের উত্তর দিল।

সেলিনা জরিনাকে সঙ্গে নিয়ে উপরে যাওয়ার সময় জোবেদাকে বলল, তোমরা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এস।

জোবেদা বলল, চলুন দুলা ভাই।

উপরের বারান্দায় গিয়ে সেলিনাকে ডাকতে বললাম। এমন সময় তাকে আসতে দেখে জোবেদাকে বললাম, তোমরা একটু অপেক্ষা কর তারপর সেলিনাকে বললাম, আম্মার কাছে চল।

সেলিনা আমাকে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে একটা দরজার কাছে গিয়ে পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আম্মা বলে ডাকল।

দেখলাম, উনি জানালার রড ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সেলিনার একটা হাত ধরে কাছে গিয়ে দুজনে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।

উনি কোনো কথা না বলে ষ্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন।

সেলিনা আমার হাত ধরে বেরিয়ে আসার সময় বলল, আম্মা খুব রেগে আছে। আমার সঙ্গেও কথা বলেনি।

সেলিনার ঘরে এসে দেখলাম, জরিনা ও জোবেদা ছাড়া সবাই চলে গেছে।

সেলিনা তাদের দুজনকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে পরে একা ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, এখানে থাকবে, না অন্য কোথাও যাবে?

আজ এখানে থাকব। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। তুমি দাদুকে দিয়ে হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে রাখ। আমি জুম্মার নামায পড়তে যাচ্ছি, ফিরে এসে একসঙ্গে খাব।

মসজিদে নামাযের পর ইমাম সাহেবকে ব্যারিষ্টার সাহেবের কথা বলে নিজের পরিচয় দিলাম। তারপর সেলিনাকে কুরআন শরীফ পড়াবার ব্যবস্থা করে ফিরে এসে দেখি টেবিলের উপর খাবার সাজিয়ে সেলিনা বসে কাঁদছে।

বললাম, তুমি কাঁদছ কেন? আম্মা কি কিছু বলেছেন? জানতো, তোমার চোখের পানি আমাকে কত বিচলিত করে? তোমার চোখের অশ্রুবিন্দু আমার হৃদয়ে সূঁচের মতো বিধে।

সেলিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আজকের দিনে তোমাকে হোটেলের খাবার খাওয়াতে আমার কলজে ফেটে যাচ্ছে।

আমি, তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, হোটেলের খাবার খেতে আমার কোনো দুঃখ নেই। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। সেলিনাকে চুপ করে থাকতে দেখে চেয়ারে বসিয়ে আবার বললাম, ডেল কার্নেগী তার দুশ্চিন্তাহীন নূতন জীবন বই এর মধ্যে এক জায়গায় বলেছেন, যে কোনো বিপদের সময় মানুষ যদি বিচলিত না হয়ে অতীত ও ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে বর্তমানকে মেনে নিয়ে কর্তব্য ঠিক করে, তাহলে সে একদিন না একদিন বিপদ থেকে মুক্তি পাবেই। তোমাকে আমি সেই কথা বলছি, কি ছিলে? কি হল? কি হবে? এই সব চিন্তা করলে খুব, মুষড়ে পড়বে। তারচেয়ে সব রকম চিন্তা বাদ দিয়ে এখন স্বামীর সঙ্গে মজা করে পেট পুরে খাও, দেখবে অল ক্লিয়ার। আমার কথায় কাজ হল।

সেলিনা বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আমার পাতেই খেতে বসল। আমি কিছু বললাম না, বরং খুশী হলাম। খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করলাম, এ বেলা কোথাও যেতে হবে নাকি?

সেলিনাকে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, ভুলে গেছি। জান, আমি খুব ভুলা। অনেক সময় অনেক দরকারি জিনিসও ভুলে যাই। তারপর তাকে হাসাবার জন্য বললাম, আজ রাত জাগতে হবে এখন ঘুমিয়ে নাও। আমিও তোমার সঙ্গে একটু কমপিটিশন দেওয়ার চেষ্টা করব। তবুও যখন হাসল তখন দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ওকে দুহাতে তুলে খাটে এনে শুইয়ে খুব আদর করলাম। সেলিনা হাঁপাতে লাগল। বললাম, কি, মন থেকে চিন্তা দূর হয়েছে? সে আমার বুকে মুখ লুকাল। তারপর আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

দরজায় আওয়াজ হতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সেলিনাকে জাগিয়ে বললাম, দেখ, কে যেন দরজায় নক করছে।

সেলিনা গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলে দিল।

জরিনা ট্রেটেবিলে নানা রকম ফুল ও মিষ্টিসহ চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, আম্মা এগুলো পাঠিয়েছে। আর হোটেলের খাবার খেতে নিষেধ করেছে।

সেলিনা ছলছল নয়নে বলল, না, তুই এগুলো নিয়ে যা। আর আমরা হোটেলের খাবারই খাব।

জরিনাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি বললাম, তুমি কার কথা শুনবে? তোমার আপার, না আমার? জরিনা কিছু বলার আগে আমি আবার বললাম, তুমি নাস্তা রেডী কর, আমি তোমার আপাকে ম্যানেজ করছি। সেলিনাকে ডেকে কাছে বসিয়ে বললাম, মুরুব্বিদের, বিশেষ করে পিতা-মাতার দোষ। কোনোদিন ধরতে নেই। ওঁদের পায়ের তলায় সন্তানদের বেহেস্ত। কুরআন পাকের মধ্যে আল্লাহ এরশাদ করেছেন। আর তোমার পরওয়ার দিগার আদেশ করিয়াছেন। যে, তোমরা তাহাকে ব্যতীত অন্য কাহারো ইবাদত করিও না, এবং তুমি মা বাপের সহিত সদ্বব্যহার করিও, যদি তোমার সম্মুখে তাহাদের একজন কিংবা উভয়। বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাহদিগকে উহ পর্যন্ত বলিও না (১)। প্রত্যেক পিতা মাতা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তবে অনেক সময় পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের মনের মিল হয় না। সেজন্য পিতা-মাতার উপর রাগ করে থাকা সন্তানদের মোটেই উচিত নয়। এরপর শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলাম। বললাম, আমি যখন রাগ না করে খেতে চাচ্ছি, তখন তোমার আর অমত করা উচিত নয়। কথাটা মন্ত্রের মত কাজ করল।

সেলিনা বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।

জরিনার দিকে চেয়ে বললাম, কি ছোট গিন্নী, নাস্তা খাওয়াবে? না আপার কথায় ফিরে যাবে? বলে জীব কেটে ফেললাম।

ওরা দুজনেই তখন হাসতে আরম্ভ করেছে।

বললাম, আমারও ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। তুমি যেন আবার কিছু মাইণ্ড করে বস না। আসল কথা কি জান? তোমাকে যে কি বলে ডাকব সেটা ভেবে ঠিক করতে না পেরে হঠাৎ করে ঐ সম্বোধনটা বেরিয়ে গেছে। নাম ধরে ডাকলে যদি আবার কিছু মনে কর। তার চেয়ে কি বলে ডাকলে তুমি খুশী হবে বলে দাও। তোমাদের এ্যারিস্ট্রোকেটি সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ।

জরিনা হাসতে হাসতে বলল, আপনার যা খুশী তাই বলে ডাকবেন, কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই।

সেই থেকে তাকে কখনো নাম ধরে, কখনো মিস আধুনিকা, আবার কখনো ছোট গিন্নী বলে ডাকতাম।

এমন সময় দরজার বাইরে থেকে জোবেদা বলল, আসতে পারি?

আমি বললাম, নিশ্চয় আসবেন।

জোবেদা দুজন মেয়েকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, আমাদের আত্মীয়া আসমা ও রাবেয়া, দেশ থেকে বেড়াতে এসেছে।

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে সবাইকে বসতে বললাম।

জরিনা সকলকে নাস্তা পরিবেশন করল।

হঠাৎ জরিনা বলে উঠল, দুলাভাই, আপনি সিনেমা দেখেন?

আমি সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাদের কি মনে হয়?

সেলিনা বলল, আমাকে আবার জড়াচ্ছ কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছি না কি?

বললাম, জরিনা না পারলে তুমিই বলে দাও।

জরিনা বলল, অত কথার দরকার নেই, দেখেন কি না বলুন।

দেখিনি বললে মিথ্যা বলা হবে! আজ পর্যন্ত যে কটা ছবি দেখেছি, তা আঙ্গুলে গোনা যাবে। সিনেমা বলতে কি বোঝায় তা জানার জন্য দেখেছি।

জরিনা আবার জিজ্ঞেস করল, কি জানলেন?

সিনেমা দেখে কিছু জ্ঞান লাভ করা যায় সত্য। কিন্তু সে রকম দর্শকের সংখ্যা কম। আর বর্তমানে যে সমস্ত ছবি দেখান হয়, তাতে করে সিনেমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জনের জন্য পর্দায় বহু ন্যাকেট ও অশ্লীল দৃশ্য দেখান হয়। এগুলো উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। এতে করে সমাজের নৈতিক চরিত্রের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এই কারণে ইসলামের দৃষ্টিতে সিনেমা দেখা কঠোরভাবে নিষেধ। খাওয়া পরা, কাজ-কর্ম, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি যে কোনো ব্যাপারে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ যেখানে বেশি, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্য সেই সমস্ত জিনিস হারাম করেছেন। যেমন মদ। মদ মানুষের অল্প কিছু উপকার করে, কিন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে মদ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তাই আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন।

আসমা নামে নূতন আগত মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে আপনার কি মত?

বললাম, আমার মতামতের এক পয়সাও দাম নেই। আমি সব সময় সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর রাসূল (দঃ)-এর পথে নিজেকে এবং অপরকে চালিত করার চেষ্টা করি। আর যা কিছু বলি কুরআন হাদিস মোতাবেক। নারী স্বাধীনতার কথা আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তবু অল্প কথায় বলার চেষ্টা করছি। আমরা জানি প্রত্যেক জিনিসের একটা সীমা আছে। আর যে কেউ সেই সীমার বাইরে যাবে নিশ্চয় তার বিপদ হবে। যেমন কেউ তার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করলে সে যে ক্রমশঃ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে একথা সকলেই স্বীকার করবে। কেউ পাহাড়ে উঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যদি সে পাহাড়ের বাইরে পা বাড়ায়, তাহলে কি হবে সে কথাও আমরা জানি। তাই মুসলিম নারী হিসাবে তাদের জানা উচিত, আল্লাহ নারীদের কতটা স্বাধীনতা দিয়েছেন। বর্তমান যুগে আমাদের দেশের নারীরা সেই সব না জেনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে স্বাধীনতার যে সমস্ত বুলি আওড়িয়ে নারী স্বাধীনতার প্রয়াস চালাচ্ছে, ইসলামে তা নিষিদ্ধ। নারী স্বাধীনতার ফলে হয়তো। কিছু সংখ্যকের উপকার হয়েছে। সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিছু সংখ্যকের ব্যক্তিগত সুবিধা সারা বিশ্বের সমস্ত নারীদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। যেমন ধরুন একজন অথবা কয়েকজন ব্যক্তি খাদ্যাভাবে মারা যেতে বসেছে, সে বা তারা তখন হারাম জিনিস খেয়ে জান বাঁচাতে পারে। তার বা তাদের জন্য ইসলামে এটা জায়েজ। তাই বলে সুস্থ, সবল ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য তা হারাম।

রাবেয়া নামে অন্য মেয়েটি বলল, আর একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন।

একজন খুব গরিব লোক, তার পরনে কোনো কাপড় নেই। তার উপর ইসলামের হুকুম সে যেন উলংগ অবস্থায় বসে নামায পড়ে। তবু নামাযের মাফ নেই। এখন তাকে দেখে যদি সকলে ঐভাবে নামায পড়ে, তাহলে কি দৃশ্যের সৃষ্টি হবে তা চিন্তা করে দেখুন। সারা দুনিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, নারী স্বাধীনতার ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে যে সমস্ত দেশ এই বিষয়ে বেশি অগ্রগামী তারা অর্থনৈতিক দিকে উন্নতি করলেও দাম্পত্য জীবনের সুখ শান্তি থেকে বঞ্চিত। ইসলাম নারীকে দুনিয়ার বুকে সর্ব প্রথম সম্মান দিয়েছে। তার আগে পুরুষেরা নারীকে শুধু ভোগের সামগ্রী মনে করত, তারা উৎপিড়ীতা ও লাঞ্ছিত হত। প্রতিকারের কোনো হাতিয়ার তাদের হাতে ছিল না। কুরআন মজিদের মধ্যে আল্লাহপাক বজ্রনিনাদে ঘোষণা করিয়াছেন, তোমরা নারীকে যতেচ্ছভাবে ভোগ কর না, ইচ্ছামত উৎপীড়ন ও অত্যাচার করো না।

আল্লাহপাকের হাবিব, হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন-তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে ভালবাস, তাদের সহিত নম্র ব্যবহার কর, তাদের ছোট ছোট দোষগুলো ক্ষমার চোখে দেখ। তাদের প্রতি তোমাদের যেমন হক আছে, তোমাদের প্রতি তাদেরও হক আছে।

তিনি আরও বলিয়াছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে তাহার স্ত্রীর। সহিত উত্তম ব্যবহার করে।

তিনি আরো বলিয়াছেন, যখন কোনো মুসলমান পূণ্য লাভের আশায় তাহার স্ত্রীর জন্য কিছু ব্যয় করে, ইহা তাহার পক্ষে একটি দানের তুল্য হয়।

আর নারীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন

তোমরা ইচ্ছামত যত্রতত্র চলাফেরা কর না। যদি কোন কারণ বশতঃ বাইরে যেতে হয়, তবে অন্ধ যুগের নারীদের মত বে আবরু হয়ে না যেয়ে নিজেকে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে নিও।

এসব কথা আলোচনা করলে অনেক কথা বলতে হয়। আজকাল অনেক ধর্মীয় কিতাব বাংলায় অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। আপনারা ঐ সমস্ত বই পড়বেন। তাহলে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আইন সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এখন আমরা একটু বাইরে যাব, আপনারাও গেলে খুশী হব।

জোবেদা বলল, আমরা এখন যেতে পারব না, অন্য এক সময় যাব। তারা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর জরিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমারও কি একই মত?

না, এক্ষুনি আসছি বলে জরিনা ট্রেটেবিল নিয়ে চলে গেল।

সেলিনাকে তৈরি হতে বলে বললাম, অনেকক্ষণ লেকচার দিলাম, কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক পেলাম না।

সেলিনা উঠে এসে একটা চুমো খেয়ে বলল, এটা এ্যাডভান্স, ফুল পেমেন্ট রাত্রে।

আসরের নামায পড়ে জরিনাকে নিয়ে আমরা বায়তুল মোকাররমে গেলাম। একটা সেফার্স পেন কিনে তাতে প্রেজেন্টেড বাই দুলাভাই লিখিয়ে জরিনাকে দিয়ে বললাম, আমাদের দেশে বিয়ের মজলিসে খাওয়ার আগে দুলাভাইয়ের হাত তার শালা ধুইয়ে দিয়ে মোটা বখশীস পায়। তুমি আমার হাত না ধোয়ালেও প্রথম খাইয়েছ, তাই খুশি হয়ে দিলাম। তারপর কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলাম।

রাত্রে খাওয়ার পর্ব শেষ করে শুয়ে শুয়ে একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। সেলিনার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম, স্লিপিং গাউন পরে পাশে শুয়ে আমার গালে হাত বুলাচ্ছে।

আমি উঠে খাট থেকে নেমে চেয়ারে বসে পানি খেতে চাইলাম। সেলিনা খাট থেকে নেমে পানি দিল। পানি খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে ব্রীফকেস থেকে টাকাগুলো। বের করে টেবিলের উপর রেখে বললাম, তোমার দেনমোহর বাবদ টাকা। এগুলো নিয়ে তুমি আমাকে দেনমোহরের দাবি থেকে মুক্তি দাও। এই দাবি পরিশোধ না করে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ভোগ করা ইসলামের দৃষ্টিতে উচিত নয়। এগুলো নিয়ে তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকারের পথ করে দাও।

সেলিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, মরে গেলেও আমি এ টাকা নিতে পারব না। তুমি আমাকে মাফ কর। আমার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে; আগেই ভেবে রেখেছিলাম, বিয়ের রাত্রেই তোমাকে দেনমোহরের দাবি থেকে মুক্তি দিয়ে দেব। কিন্তু তোমাকে পেয়ে আনন্দের অতিশৰ্য্যে তা ভুলে গেছি। এই টাকা না নিয়েই আমি তোমাকে ঐ দাবি থেকে মুক্তি দিলাম।

বললাম, দেনমোহর আদায় করার জন্য আল্লাহপাক পুরুষকে হুকুম করেছেন। আমি তার হুকুম পালন করেছি মাত্র। এতে তোমার কাঁদবার বা টাকা না নেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এটা তোমার ন্যায্য পাওনা।

সেলিনা বলল, আল্লাহপাক তো আরও বলেছেন, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় খুশীর সঙ্গে স্বামীকে এই দাবি থেকে মুক্তি দেয়, তবে সেটা উত্তম ফায়সালা! আমি প্রথম হুকুমের চেয়ে দ্বিতীয়টাকে অধিক পছন্দ করি।

আমি বললাম, তোমার কথা ঠিক, তবে আমি কথাটা প্রথম উত্থাপন করেছি। দ্বিতীয়তঃ তোমার কাছে আল্লাহপাকের ও স্বামীর হুকুম। আর তুমি পরে বলেছ। আমার কাছে আল্লাহপাকের হুকুম ও স্ত্রীর অনুরোধ। এখন তুমিই বিচার কর কে কার কথা শুনবে?

সেলিনা কয়েক সেকেণ্ড কি যেন চিন্তা করল, তারপর টাকাগুলো আমার ব্রীফকেসে তুলে রেখে বলল, আপাততঃ এগুলো এখানে থাক, আমার টাকা আমি কি করব সে কথা আগামীতে ভাবব। তারপর নিজের চামড়ার সুটকেস খুলে কিছু কাগজ পত্র এনে আমাকে দুতিন জায়গায় সিগনেচার করতে বলল।

আমি না পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের কাগজ?

সেলিনা বলল, উইল মোতাবেক গতকাল থেকে আমি ব্যাংকের টাকার স্বত্বাধিকারী হয়েছি। আমি যখন তোমার, তখন আমার সবকিছুও তোমার। এই সিগনেচার ব্যাংকে যাবে। দরকার মতো তুমিও টাকা তুলতে পারবে। আর যদি দয়া করে অনুমতি দাও, তাহলে সমস্ত টাকা তোমার একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেব, তুমি যা বলবে তাই হবে।

তার কথাগুলো শুনে মনে হল, কেউ যেন সীসা গরম করে আমার কানে ঢেলে দিল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বালা করে উঠল। আমি ভীষণ রেগে গেলাম। রেগে গেলে সাধারণতঃ আমার কোনো হুঁশ থাকে না। কিন্তু কেন কি জানি, ঐদিন আমি হুঁশ হারাইনি। শুধু সেলিনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।

আমার অবস্থা দেখে সেলিনা খুব ভয় পেয়ে ছল ছল নয়নে আমার পায়ের কাছে বসে পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। আমার কথা শুনে তুমি এত বিচলিত হয়ে পড়বে জানলে কখনও বলতাম না। উম্মুল মোমেনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) বাসর রাত্রে তাঁর বিপুল ধনরাশী স্বামী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই কথা ভেবে আমি বলেছি।

সেলিনার প্রেমের ও জ্ঞানের গভীরতা বুঝতে পেরে কে যেন আমার রাগের আগুনে পানি ঢেলে দিল। আমি তাকে তুলে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমার প্রেম সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিল। আমি আমার এই দুর্ব্যবহারের জন্য মাফ চাইছি।

সেলিনা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, এভাবে বল না, আমি যে গোনাহগার হব।

না, এতে মোতার গোনাহ হবে না, আমারই ভুল হয়েছে। যাক, তুমি কিন্তু জীবনে আর কখনো এই টাকা নেওয়ার জন্য বলবে না। এটা ছাড়া তুমি যা বলবে, প্রাণ দিয়ে হলেও তা রক্ষা করব। তুমি প্রেমের জোরে আমাকে বিয়ে করেছ। আমিও তোমাকে প্রেমিকার আসনে বসিয়ে বিয়ে করেছি। টাকার কথা তুলে আমাদের পবিত্র প্রেমকে কলঙ্কিত করো না। যদি আর কখনো তোল, তাহলে খুব মর্মাহত হব। মা খাদিজার (রাঃ) কথা যে বললে, তিনি সব কিছু বিলিয়ে দেওয়ার মতো উপযুক্ত স্বামী পেয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো মানুষের তুলনা করা উচিত নয়। তোমার সবকিছু গ্রহণ করার যোগ্যতা আমার নেই। মাঝে মাঝে মনে বড় ভয় হয়, তোমার এত গভীর প্রেমের ভার কতদিন আমি সহ্য করতে পারব? তার উপর যদি তোমার সবকিছু আমাকে দিয়ে দাও, তাহলে হয়তো আমি পাগল হয়ে যাব।

কান্নাভেজা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আর কখনও এই কথা বলব না। তবে স্বাধীনভাবে এই টাকা খরচ করার অনুমতি তুমি আমাকে দাও।

বললাম, তোমার টাকা তুমি খরচ করবে, তাতে আমি কোনো দিন বাধা দেব না। কথাটা চিন্তা না করে বলেছিলাম। তাই পরবর্তী কালে যখন ও আমার পিছনে টাকাগুলো পানির মত খরচ করত তখন যদি বলতাম, শুধু শুধু আমার পিছনে এতটাকা খরচ করছ কেন? আমাকেও তোমার পিছনে কিছু খরচ করতে দাও তখন সেলিনা কুপিতভাবে লত, তুমিই তো আমাকে খরচ করার অনুমতি দিয়েছ। আর তোমার টাকা আপামনি ও ছেলেমেয়েদের জন্য খরচ করলে আমি বেশি খুশী হব। এমন সময় ড্রইংরুমের ঘড়িতে রাত বারটা ঘোষণা করল।

সেলিনা কাগজপত্রগুলো তুলে রেখে আমার কাছে এসে বলর, ঘুমাবে না?

না, আজ ঘুম নয়, শুধু আনন্দ। কি রাজি তো?

লজ্জায় সেলিনা দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল।

আমি তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বিছানায় গেলাম।

পরের দিন নাস্তার পর বেলা সাড়ে নটার সময় আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে বলল, তুমি আমার বইয়ের কালেকসান দেখে আরও কিছু লিষ্ট তৈরি কর। আমি ততক্ষণে ফিরে আসব।

সেলিনা চলে যাওয়ার পর তাকে একটা চিঠি লিখলাম। তারপর বই এর লিষ্ট করে সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করলাম, সেলিনা কোথায় গেল? কেমন যেন সন্দেহ হতে আমার ব্রীফকেসটা খুলে দেখি, টাকাগুলো নেই। আমি চেয়ারে বসে মুজতবা আলির শবনম বইটি পড়তে লাগলাম।

সেলিনা ফিরে এসে চুপি চুপি আমাকে চেয়ারের পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি আমার দেনমোহরের টাকাগুলো আমার প্রেমিকের একাউন্টে জমা দিয়ে এলাম। আশা করি, উনি তার প্রেমিকার এই ধৃষ্টত্তা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।

মনে ব্যাথা পাবে ভেবে কিছু না বলে শুধু একটু হাসলাম। এরকম যে কিছু একটা করবে, তা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাকে সামনে এনে বললাম, কাউকে কিছু দান। করলে দক্ষিণাও দিতে হয়। আমি দানের চেয়ে দক্ষিণার প্রত্যাশী বেশি।

সেলিনা আমার কোলে বসে সারামুখ চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, এর বেশি আমি দিতে পারছি না। আরো বেশি কিছু পেতে চাইলে তোমাকে নিজে সেটা নিতে হবে বলে লজ্জায় আমার বুকে মুখ লুকাল।

আমিও কিছু প্রতিদান দিয়ে বললাম, দক্ষিণা অল্প একটু হলেই চলে। তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। আমি অল্পে সন্তুষ্ট থাকি। কারণ হাদিসে আছে, অল্পে সন্তুষ্ট ব্যক্তি বিরাট সম্পত্তির মারিক।যারা অল্পে সন্তুষ্ট হয় তারা বিপদে বা দুঃখকষ্টে সহজে মুষড়ে পড়ে না।

সেলিনা বলল, আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আল্লাহপাকের রহমতে ও  তোমার দোয়ার বরকতে আমি ফাষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছি। এই দেখ বলে খবরের কাগজটা আমার সামনে ধরে তার রোল নাম্বার দেখাল।

আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে কংগ্রাচুলেশন দিয়ে বললাম, তাহলে তো আমার প্রিয়তমাকে কিছু উপহার দিতে হয়। বল কি পেলে তুমি খুশী হবে? এই বলে তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে সারা মুখ আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে দোয়া করলাম-হে পরওয়ার দেগার রাহমানুর রহিম, তুমি আমার প্রিয়তমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল পরীক্ষায় এই ভাবে সম্মানের সাথে পাশ করিয়ে দিও।

সেলিনা বলল, তুমি যদি এখন আমাকে লক্ষ টাকার জিনিস উপহার দিতে, তাহলেও আমি এত বেশি আন্দিত হতাম না। আমার মন যা পেয়ে খুশী হয়, তা তুমি দিয়েছ! আমি আর কিছুই তোমার কাছে চাই না।

সুযোগ পেয়ে বললাম, একটা কথা বলব; কিন্তু কিছু মনে করতে পারবে না।

সেলিনা হাসি মুখে বলল, কি কথা বল, আমি কিছু মনে করব না।

আমাকে এবার যে ছুটি দিতে হবে? কিন্তু হাসি মুখে। বিদায় বেলায় কান্না আমি পছন্দ করি না।

ছুটির কথা শুনে সেলিনার চোখে পানি এসে গেল। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বলল, আজ নয় পরশু, তবে কয়েকটা সর্ত আছে।

মহারানীর সর্তগুলো শুনতে চাই।

প্রথম- আবার কবে এই দাসি তোমার দেখা পাব?

দ্বিতীয় বলার সাথে সাথে তার হাতে একটা ভঁজকরা কাগজ দিয়ে বললাম, আমি আমার প্রিয়তমার সমস্ত সর্ত জানি। তাই সে যখন বাইরে গিয়েছিল তখন তার সর্তগুলোর উত্তর লিখে রেখেছি। তুমি এই পত্র মোতাবেক কাজ করলে আমরা উভয়েই সুখী হব।

সেলিনা আমার সামনের চেয়ারে বসে কাগজটা খুলে পড়তে লাগল।

প্রিয়তমা, তোমাকে এই চিঠি লিখতে মন চায়নি। তবু কর্তব্যের খাতিরে লিখলাম। কারণ মন এক জিনিস আর কর্তব্য অন্য এক জিনিস। আমার কাছে মনের বাসনার চেয়ে কর্তব্য বড়। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার দিনগত রাত্রে আসব। যদি কোনো কারণবশত আসতে না পরি, তবে পরের দিন সকালে আসব। বোরখা ছাড়া বাইরে কোথাও যাবে না। জীবনে কোনোদিন মিথ্যা বলবে না। শরীয়তের কারণ ছাড়া নামায রোযা ত্যাগ করবে না। ইডেন কলেজেই এ্যাডমিশন নিতে পার। আমি যে সমস্ত বইয়ের লিষ্ট করে দিয়েছি, সেগুলো পড়ে আদর্শ নারী হওয়ার চেষ্টা করবে। সব রকম বই পড়ার অনুমতি দিলাম। তবে ধর্মীয় বই পুস্তক বেশি পড়বে। আমর হুকুম ছাড়া যেখানে খুশি যাওয়া চলবে না।
তুমি যদি আমার প্রাপ্য মর্যাদা আমাকে দাও, তাহলে জীবনে কোনোদিন আমার কাছ থেকে রূঢ় ব্যবহার পাবে না। যদিও আমি জানি আমার প্রেমিকা স্ত্রী কোনোদিন আমার অমর্যদা করবে না, তবু খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে লিখলাম। ছেলেবেলা থেকে আমি বড় খামখেয়ালি। সেই জন্য সঙ্গিরা স্কুল লাইফে আমাকে খামখেয়ালি সম্রাট মহম্মদ বিন তুঘলুক বলে ডাকত। যৌন মিলনে আমার পূণ স্বাধীনতা থাকবে। তোমার প্রেম যখন আমাকে টানবে তখন আমার সময়ের জ্ঞান থাকবে না। গিয়ে যদি তোমাকে না পাই, তাহলে ভীষন রেগে যাব। আর রেগে গেলে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলতে পারি। এমন কি চাবুক মেরে তোমার শরীর থেকে গোস্ত তুলে নিতেও দ্বিধাবোধ করব না।
কী খুব অনুশোচনা হচ্ছে নাকি? নিশ্চয় তোমার মনে হচ্ছে, আচ্ছা পাগল লোকের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছি রে বাবা? বিয়ের পর দুদিন যেতে না যেতে চাবুক মারার ভয় দেখাচ্ছে?
এখন বুঝতে পারছ, আমি কি স্বভাবের লোক। বিয়ের দুদিন পর কোনো স্বামী যে তার স্ত্রীকে এইসব কথা লিখতে পারে না, তা আমি জানি। মন চাইল তাই লিখলাম। এটাকেও তুমি আমার একটা খামখেয়ালী মনে করতে পার।
আশা করি, আমার চরিত্র সম্বন্ধে তোমার মোটামুটি ধারণা হয়েছে। এখন আমি আমার প্রেমিকা সহধর্মিণীর কাছ থেকে জীবন যাত্রার সহযোগীতা কামনা করে শেষ করছি আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার খামখেয়ালী প্রিয়তম স্বামী।

সেলিনা চিঠিটা দুবার পড়ল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার প্রেমকে দুবছর ধরে পরীক্ষা করেও কি, তোমার সন্দেহ মিটেনি? তুমি যে চরিত্রের লোক হওনা কেন, আমার কাছে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) পরে তোমার স্থান। অন্যায় করলে যত কঠিন শাস্তি তুমি দাওনা কেন, আমি তা মাথা পেতে নেব। তোমার কাছে সুখ পেয়ে যেমন শান্তি পাব, দুঃখ পেয়েও তা সইতে পারব। মনে কোনো রকম অনুশোচনা আসবে না। তুমি দুদিন পরে চলে যাবে। এসব কথা বাদ দিয়ে আমাকে তোমার সেবা করতে দাও।

বললাম, আজ পর্যন্ত তোমাকে যত রকমের পরীক্ষা করেছি, সবগুলোতেই ফুলমার্ক পেয়ে পাশ করেছ। পরীক্ষার ফলাফলে খুশি হয়ে আমার মন তোমাকে কিছু দিতে চাইছে। তুমি এখন আমার কাছে কিছু চাও। সাধ্যের মধ্যে হলে এক্ষুনি দেব। আর তার বাইরে হলে সারাজীবন ধরে তা দেওয়ার চেষ্টা করব।

কোনো চিন্তা ভাবনা না করে তৎক্ষণাৎ সেলিনা বলল, আমি শুধু তোমার প্রেম চাই। প্রেম ছাড়া তোমার কাছ থেকে আমি আর কিছুই চাই না।

তাকে খুব আদর করে বললাম, দেব, সমস্ত মন প্রাণ উজাড় করে তোমাকে প্রেম দেব। জান, মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয় তোমার এত গভীর প্রেম আল্লাহপাক আমার ভাগ্যে কতদিন রেখেছেন?

সেলিনা বলল, তুমি বুঝি এই সব চিন্তা কর? আর কখনও ঐ রকম চিন্তা করবে না। বরং আমারই কেবল মনে হয় তোমার প্রেমের তুলনায় আমারটা কত নগণ্য।

৬. বিয়ের প্রায় পাঁচ ছয় মাস পর

 

বিয়ের প্রায় পাঁচ ছয় মাস পর থেকে সেলিনা মাঝে মাঝে শহরের বড় বড় হোটেলে রুম ভাড়া করে ফোনে আমাকে হোটেলের নাম ও রুম নাম্বার দিয়ে যেতে বলত। আমি যদি বলতাম, কি দরকার ছিল এত টাকা খরচ করার, বাসায় তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। সেলিনা উত্তর দিত আমার প্রিয়তম খামখেয়ালি, তাই আমিও খামখেয়ালিনি হয়েছি। প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর এমন দিত যে, আমাকে হার মানতে হত। কিন্তু হেরে গিয়েও খুব আনন্দ পেতাম।

হঠাৎ একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপামনি কি আমাদের ব্যাপারটা কিছুই জানেন না?

আমি বললাম, না, তবে বিয়ের আগে তাকে একটা গল্প বলে তার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। গল্পটা বলিছি শোন।

একটা পত্রিকায় একজন লেখক একটা গল্প লিখেছিলেন। গল্পের শেষ না করে পাঠকদের মাঝে প্রশ্ন করে বলেছিলেন, যে কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারলে তাকে লেখক পাঁচশত টাকা পুরস্কার দেবেন। তোমার আপামনি বলল, আগে গল্পটা শোনা যাক, তারপর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে। আমি বলতে শুরু করলাম

এক ধনীর দুলালী দোকানের একজন গরীব কর্মাচারীর প্রেমে পড়ে যায়। একথা যখন মেয়েটা ছেলেটাকে জানায়, তখন ছেলেটা তাকে কোনো পাত্তাই দিল না। মেয়েটা কিন্তু নাছোড় বান্দা। পরে ছেলেটাও মেয়েটার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে তার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু ছেলেটার দিক থেকে দুটো বড় বাধা ছিল! প্রথমতঃ সে বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। সে গরিব না হলেও বড়লোক নয় এবং সে তার স্ত্রীকে খুব ভালবাসে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একদিন ছেলেটা মেয়েটাকে নিজের পরিচয় দিয়ে তার প্রেমের পরীক্ষা নিল। আর মনে করল, মেয়েটা নিশ্চয় তার সত্য পরিচয় পেয়ে আপনা থেকে দূরে সরে যাবে। কিন্ত মেয়েটা তার পরিচয় শুনে বলল, তুমি যেই হও না কেন, আমি তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না কর, তবে আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব।

লেখক এবার গল্প শেষ করে প্রশ্ন করেছেন, আপনারই বলুন, ছেলেটার কি করা উচিত?

গল্পটা শুনে তোমার আপামনি বলল, দূর, ঐ সব আবার সত্য হয়। লেখকরা সব মাতাল। মদ খেয়ে মাতলামি করেছে।

আমি বললাম, তা না হয় লেখক মাতলামি করেছে, কিন্তু সত্যি সত্যিই কেউ যদি এই রকম পজিশনে পড়ে? তাহলে তার কি করা উচিত তুমি বল।

তোমার আপামনি বলল, ঐ ধরণের মেয়েরা কোনোদিন ভালো হয় না। তাছাড়া কোথাকার কে মেয়ে, সে আত্মহত্যা করুক বা আর যাই করুক, ছেলেটার তাকে বিয়ে করা উচিত নয়।

আমি বললাম, তোমার উত্তরটা আমি পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেব। এখন বুঝতে পারছ, একজন মেয়ে হয়েও স্বামীর ভাগ দিতে হবে বলে তোমার আপামনি ঐ মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে মেরে ফেলতে চাইল। তারপর সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আপামনি তো যাহোক একটা উত্তর দিল, এখন তুমি বলতো, এটার সঠিক উত্তর কি হবে?

সেলিনা কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আমার ঘটনাটাই এর সঠিক উত্তর। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না। আমাকে কোনোদিন আর এধরনের প্রশ্ন কর না? তুমি আমাকে এত বেশি প্রশ্ন কর কেন? ভয় হয় যদি প্রশ্নের উত্তর তোমার মনের মত না হয়, তাহলে হয়তো তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হবে।

ঠিক আছে সখি ঠিক আছে, তোমাকে আর কোনোদিন প্রশ্ন করব না। কিন্তু বলতে পার এত পানি তোমার চোখে……. বলে চুপ করে গেলাম।

থামলে কেন? বল না।

বাক্যটা পুরো বললে তোমাকে প্রশ্ন করা হয়ে যাবে যে?

সেলিনা হেসে ফেলে বলল, সত্যি, আমি ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই, এত প্রশ্ন তোমার মনে আসে কোথা থেকে?

আমাকে প্রশ্ন করতে নিষেধ করে এখন থেকে তাহলে তুমি প্রশ্ন করতে শুরু করলে?

এই কথায় দুজনেই হেসে উঠলাম।

.

বিয়ের তিন বছর পর একদিন সেলিনা বলল, আমাকে কোনো লেডিজ গাইনীর কাছে চেকআপ করাবে?

রসিকতা করে ইংরেজীতে বললাম, বাট হোয়াই? এনিথিং রং?

বলতে যে লজ্জা করছে।

স্বামীর কাছে স্ত্রীর লজ্জা করতে নেই। তাছাড়া তোমার সব লজ্জাস্থানগুলো যখন আমার দখলে তখন লজ্জার কোনো কারণ নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল।

তুমি দিন দিন ভীষণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছ।

সে জন্য তুমিই দায়ী। তোমার লজ্জাস্থানগুলো দিন দিন আমাকে অসভ্য করে তুলছে।

এ রকম অসভ্যতা করলে আমি বলব না, যাও দুষ্ট কোথাকার?

ঠিক আছে, আর অসভ্যতা করব না। এবার আসল কথাটা বল, নচেৎ শান্তি পাচ্ছি না।

এতদিন হয়ে গেল মা হচ্ছি না কেন?

ও তাই বল, তোমার কথা শুনে তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সন্তানের জন্য এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? মা হতে খুব সখ হচ্ছে বুঝি?

সন্তানের মা ডাক না শুনলে নারী জনম সার্থক হয় না।

মহারানীর আদেশ শীরধাৰ্য্য।

কয়েকদিন পর সেলিনাকে একজন লেডীজ গাইনী স্পেশালিষ্টের কাছে নিয়ে গেলাম।

উনি পরীক্ষা করে বললেন, আপনার স্ত্রী কোনোদিন সন্তানের মা হতে পারবেন। কারণ ওঁর সন্তান জন্মাবার ঘর নেই।

কথাটা শুনে সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর তার মুখটা সাদা হয়ে গেছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডাক্তার বললেন, মিসেস খান, আপনি এত নার্ভাস ফিল করছেন কেন? আল্লাহ আপনাকে সন্তান ধারণে অক্ষম করে পয়দা করেছেন। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই।

ডাক্তারের কথায় সেলিনা সম্বিত ফিরে পেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চল বাসায় চল।

বাসায় এসে তাকে বললাম, ডাক্তার খুব দামী কথা বলেছেন। আল্লাহপাক যা কিছু করেন বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। যদিও সেগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে খারাপ বলে মনে হয়। তার ইচ্ছার উপর বেজার হতে নেই। সব কিছুর উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমি যখন এইসব বলছিলাম সেলিনা তখন আমার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি তার কান্না থামাবার জন্য মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, কেঁদো না, আল্লাহপাক নারাজ হবেন। আর একদিন না হয় মেডিকেলে এক্স-রে করে দেখব।

কান্না থামিয়ে সেলিনা বলল, বেশ তাই হবে।

মেডিকেলে এক্স-রে রিপোর্টেও তাই পাওয়া গেল। এবার সেলিনা কাঁদল না। কিন্তু এরপর থেকে খুব ধীর ও গম্ভীর হয়ে গেল। আগের মত চাঞ্চল্যভাব আর দেখা যেত না। তার পরিবর্তন দেখে আমি বেশ চিন্তিত হলাম। কেন কি জানি কেবলই মনে হত, সে কোনো কঠিন অসূখে পড়বে। তার চিন্তা দূর করার জন্য একদিন আদর করতে করতে বললাম, তোমার প্রেমিক তোমার কাছ থেকে আগের মত আর প্রেম পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে।

কক্ষন তা হতে পারে না। এ তার ছলনাময় অভিযোগ! মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি তাকে প্রেম দিয়ে যাব।তবে মাঝে মাঝে আমি খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

আছে, তুমি মা হবার চিন্তা দূর করে দিয়ে সব সময় আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) কথা চিন্তা করবে। যখন তা ভালো লাগবে না তখন ধর্মীয় বই পড়বে। তাও যখন ভালো লাগবে না তখন আমার কথা ভাববে।

তোমার কথা ভাবলে যে সব সময় তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছা করে। সেই জন্য তো আল্লাহপাকের কাছে অন্ততঃ একটা সন্তান চেয়েছিলাম কিন্তু আমি এমনই হতভাগী যে, তাও আমার ভাগ্যে নেই।

বললাম, তোমার ধারণা ভুল। দুনিয়ার দিকে ভালো করে তাকালে দেখতে পাবে, তোমার চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যহীনা রয়েছে। তাকে চিন্তার থেকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে চরম অস্ত্র ব্যবহার করলাম। যদিও মনে হয়েছিল এর ফলে তার মনে প্রচন্ড আঘাত লাগবে। বললাম, তুমি যে সন্তান সন্তান করে এত মূষড়ে পড়ছ, আমি কিন্তু তোমার গর্ভে সন্তান আসুক এটা চাইনি। সেই জন্য বোধ হয় আল্লাহ তোমাকে বন্ধ্যা করে সৃষ্টি করেছেন। কথাগুলো বলে ফলাফলের জন্য তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। মনে হল এক্ষুনি ভীষণ ঝড় উঠবে।

সেলিনা কয়েক সেকেণ্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে কয়েক ঘা কিল দিয়ে বলল, এই কথা এতদিন বলনি কেন? আগে বললে আমার আজ এই অবস্থা হত না। না জেনে তোমার মনে কত ব্যাথা দিয়েছি। মাফ করে দাও বলে বসে পড়ে আমার পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।

প্রথমে আমি মনে করেছিলাম, যা বলে কাঁদছে সেটা ঠিক। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমি তার গর্ভে সন্তান চাই না জেনে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। তাকে তুলে নিয়ে সেদিন এত বেশি আদর করেছিলাম, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

বিয়ের পর যখনই তার কাছে যেতাম তখনই প্রথমে আমার প্রথম স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করত।

একদিন তাকে বললাম, আচ্ছা, আমি তোমার কাছে এলেই ওদের কথা জিজ্ঞেস কর কেন?

বলল, তারা যে তোমারই অংশ, তাইতো তাদের খবর জানতে ইচ্ছে করে।

বিয়ের চার বছর পর একদিন যখন সেলিনা বাসার খবর জানতে চাইল তখন ভুল করে বলে ফেললাম, গত পরশু একটা খোকা হয়েছে। সাতদিনে আকিকা করব।

খবরটা শুনে সেলিনা আমার হাত দুটো ধরে আঁশু ভরা চোখে বলল, আমাকে নিয়ে যাবে? ওদের সাবাইকে দেখার জন্য মন বড় ছটফট করে।

ভুল করে কথাটা বলে আমি যে অন্যায় করেছি, তা টের পেয়ে বললাম, যা পারব না তা জেনেও আমাকে করতে বল কেন? তোমার ইচ্ছা পুরণ করতে না পারলে মনে যে কি হয়, তাতো তোমার অজানা নয়।

আমার কথা শোনার পর সেলিনা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, খোকার কি নাম রাখবে?

মুহাম্মাদ সায়ফুল্লাহ খান।

এই নামের অর্থ কি?

প্রশংসিত আল্লাহর তরবারী।

আমাকে যখন তুমি নিয়ে যেতে পারবে না তখন ঐদিন আমি একটা উপহার দেব নিয়ে যেও।

বেশ তো তাই দিও।

আকিকার আগের দিন সেলিনা নিউ মার্কেটে এসে আমার হাতে একটা বাক্স দিয়ে। বলল, খোকার জন্য। আর এই হতভাগীর দোয়া দিও বলে রুমালে চোখ মুছল।

রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে বাক্সটা দিলাম।

সে বাক্সটা খুলল। দেখলাম, তাতে রয়েছে একজোড়া জামা প্যান্ট, একজোড়া জুতো আর একটা সোনার আংটি। আংটিতে মিনে করা সায়ফুল্লাহ নাম লেখা।

আরও এক বছর পর একদিন সেলিনা বলল, হয় আমাকে তোমার একটা ছেলে এনে দাও, নচেৎ আমাকে আপামণির কাছে এক সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা কর। আমি আর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে পারছি না।

এরকম কথা যে সে একদিন বলবে, সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরিও ছিলাম। রাগ না করে খুব নরম সুরে বললাম, মাথায় বুঝি পোকা ঢুকেছে? ঐ সব খেয়াল বাদ দাও। সেখানে গেলে আরও বেশি অশান্তি পাবে।

যতই অশান্তি পাই, আর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হোক, আমি আপামনির পায়ে ধরে কাঁদব। বাদির মত তার ছেলেমেয়েদের সেবা যত্ন করব। প্রথম দিকে তিনি যতই লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিক না কেন, আমার বিশ্বাস, ইনশা আল্লাহ একদিন না একদিন আমি তার মন জয় করতে পারবই।

আমি তার আগের মত একরোখা ভাব উদয় হতে দেখে বেশ চিন্তিত হলাম। সেদিন তাকে একটা সুখবর শোনাব মনে করে গিয়েছিলাম। সেই সুখবরটা এখানে কাজে লাগিয়ে তার মানষিক চিন্তা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আজ তোমাকে একটা সুখবর দেব। খবরটা শুনে আমাকে কি দেবে আগে বল।

তুমি যা পেলে সব থেকে বেশি খুশি হও তাই দেব।

আমি একটা ব্যাবসা করব। চাকরি গতকাল ছেড়ে দিয়েছি। বাসাও তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করব। ব্যাবসা উপলক্ষে সারা বাংলাদেশ ঘুরতে হবে। আমার ইচ্ছা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সব জায়গায় যাব। ব্যাবসাও হবে আর তোমাকে নিয়ে বেড়ানও হবে। কি, খবরটা শুনে তুমি খুশী হওনি?

নিশ্চয় বলে সেলিনা প্রথমে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইল। তারপর দুহাতে আমার মুখ ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

.

১৯৭৬ সালে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসা আরম্ভ করি। ব্যাবসার কাজে বাংলাদেশের সব জেলাতে আমাকে ঘুরতে হয়েছে। ঢাকাতে মাসের মধ্যে বড় জোর আট দশ দিন থাকতাম। সেলিনাও প্রায় সব সময় আমার সঙ্গে ট্রেনে, বাসে অথবা, প্লেনে করে গিয়েছে। যাবতীয় খরচ সেলিনাই বহন করত। আমার টাকা মোটেই খরচ করতে দিত না। যেখানে যা পছন্দ হয়েছে নিজের জন্য, আমার জন্য, তার আপামনি ও ছেলেমেয়েদের জন্য কিনেছে। আমি অনেকবার এতবেশি খরচ করতে নিষেধ করেছি। কিন্তু সে কোনো কথা শুনত না। বলত,খরচ করে একটু আনন্দ পাই, তাতে তুমি বাধা দিও না। তার মনে ব্যথা লাগবে ভেবে পরে আমি আর কিছু বলতাম না। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি যে আমার সঙ্গে ঢাকার বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আম্মা কিছু বলেন না?

সেলিনা বলল, আসবার সময় শুধু আম্মাকে বলে আসি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। বিয়ের পর থেকে আম্মা আমার কোনো খবর বড় একটা রাখে না। জরিনাকেও আমার সঙ্গে কোথাও যেতে দেয় না।

সে জন্য তুমি মন খারাপ কর না। তোমার তো খোঁজ খবর নেওয়ার একজন লোক হয়েছে, তাই প্রয়োজন বোধ করেন না।

ব্যাবসা আরম্ভ করার পর, বছর খানেক বেশ কাটল। একদিন চট্টগ্রামে সফিনা হোটেলে তাকে রেখে ব্যাবসার কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দরজায় নক করতে খুলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেলিনা ফুঁপিয়ে উঠল।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?

সেলিনা বলল, পাশের রুমে স্বস্ত্রীক একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তাদের সঙ্গে কি সুন্দর একটা তিনচার বছরের ছেলে রয়েছে। ছেলেটা যখন তার মাকে আম্মা বলে ডাকছিল তখন থেকে ঐ ডাক শোনার জন্য আমার মন ভীষণ উতলা হয়েছে। কিছু ভালো লাগছে না। চল অন্য কোনো হোটেলে যাই।

বললাম, বেশ তো এক্ষুনি সে ব্যবস্থা করছি। তারপর আমরা অন্য হোটেলে গিয়ে উঠলাম।

চট্টগ্রাম থেকে ফেরার কয়েকদিন পর সেলিনা বলল, তুমি বুদ্ধি করে কিছু একটা উপায় বের কর। যেভাবে হোক আমি আপামনি ও ছেলেমেয়েদের একবার দেখব।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, তাদের সবাইকে নিয়ে এক দিন আমি পার্কে বেড়াতে যাব। তুমি লেকের ধারে সেই জায়গায় থাকবে। কিন্তু একটা কথা খুব খেয়াল রাখবে, এমন কথা বা এমন ব্যবহার আমার সঙ্গে করবে না, যাতে করে তোমার আপামনি বুঝতে পারে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কারণ তোমার আপামনি ভীষণ চালাক।

সেলিনা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা কিস দিয়ে বলল, তোমার বুদ্ধির তারিফ করার ভাষা আমার নেই। তোমাকে আর বেশি কিছু বলতে হবে না। তুমি তোমার কর্তব্য ঠিক করবে আর আমার দিকটা আমি দেখব। তবে তুমি যদি তাদেরকে পৌঁছে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সেখান থেকে চলে যাও, তাহলে খুব ভালো হয়।

আমিও তাকে আদর করে বললাম, সে দেখা যাবে।

সপ্তাহ খানেক পরে সেলিনার সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করে আমি স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে রমনা পার্কে একদিন বেড়াতে গেলাম। আমার বড় ছেলের বয়স তখন আট, মেয়ের পাঁচ, আর ছোট ছেলের দেড় বছর। বেড়াতে বেড়াতে নির্দিষ্ট জায়গার কাছাকাছি একটা ঢালাই করা বেঞ্চে সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। তারপর বাদাম ভাজা কিনে এনে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললাম, তুমি ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাদাম খাও, আমি গেট থেকে একটু আসছি। এক বন্ধু ঠিক এই সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটে আসবে বলে কথা দিয়েছে। বেশি দেরি করব না।

আমার স্ত্রী বলল, শিঘ্রী ফিরো কিন্তু। তুমি তো আবার বন্ধু পেলে দুনিয়ার সব কিছু ভুলে যাও।

ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখতে বলে আমি গেটের দিকে গিয়ে ঘুরে এসে কিছুটা দূরে আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য রাখলাম।

সেলিনা লেকের ধারে নির্দিষ্ট জায়গায় আগের থেকে ড্রাইভার দাদুর সঙ্গে বসে গল্প করছিল। আমি চলে আসার দুতিন মিনিট পর উঠে গিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছেলেমেয়েদের হাতে কি যেন দিল, আর ওদের খুব আদর করল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর ড্রাইভার দাদুকে ডেকে বেঞ্চে বসিয়ে তাকে কিছু বলে সবাইকে নিয়ে গেটের দিকে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি দাদুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? সব গেল কোথায়?

দাদু বললেন, দুজনে বোন সম্পর্ক পাতিয়েছে। সম্পর্কটা পাকা করার জন্য কোথায় যেন গেল। আপনাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছে। আচ্ছা দুলাভাই, ইনিই বুঝি বড় আপা?

বললাম, ঠিক বলেছেন।

দাদু আবার বলেন, প্রথম দিকে আপনার উপর আমার খুব রাগ ছিল। কিন্তু যতই আপনাকে দেখছি ততই আমিও ভালবেসে ফেলছি। বড় আপা কি এ সব বিষয় কিছুই জানেন না?

না দাদু, জানলে আমরা তিনজনে অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাব। তাই প্রতিজ্ঞা করেছি, সারা জীবন তার কাছে গোপন রাখব। শুধু আপনার খুকি ভাইকে বড় ভয় হয়। কি জানি আনন্দের মধ্যে যদি কিছু বলে বা করে বসে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রায় একঘন্টা পর তারা ফিরে এল। দেখলাম, সেলিনার হাতে কাপড়ের ও মিষ্টির বাক্স। এসেই সেলিনা আমাকে আস-সালামু আলায়কুম দিয়ে বলল, কি দুলা ভাই, কেমন আছেন?

আমি কোনো রকমে ওয়া আলায়কুম আসসালাম বলে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম।

আমার অবস্থা দেখে সেলিনা ড্রাইভার দাদুকে বলল, আপনি ওঁকে সব কিছু খুলে বলেন নি?

হাসি চেপে রেখে দাদু গাম্ভির্যের সঙ্গে বললেন, বলেছি তো?

প্রথমটা আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও দাদুর উত্তর শুনে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি আপনাদের সম্পর্কের কথা বলেছেন। এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আজ তা হলে আসি?

সেলিনা বলল, দাদু, চলুন আপামনিদের বাসায় গিয়ে মেহমানি করে আসি।

তার কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, ওদেরকে পেয়ে একট বাড়াবাড়ি করবে। কিন্তু বাসায় যেতে চাইবে এতটা ধারণা করিনি। খুব ভয় হতে লাগল। যদি বেতালে কিছু করে বসে, তাহলে সামাল দেওয়া মুস্কিল হয়ে পড়বে।

আমাকে চিন্তিত দেখে সেলিনা বলে উঠল, কি দুলাভাই, আমি আপনাদের বাসায় যেতে চাইলাম, আর আপনি চুপ করে আছেন। ভয় পেলেন নাকি?

আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, এটা তো খুব আনন্দের কথা। ছোট বোন বড় বোনের বাসায় যাবে তাতে দুলাভাই ভয় পাবে কেন? বরং খুশীই হবে! তারপর সবাই গাড়িতে করে বাসায় ফিরলাম।

বাসায় এসে মাগরিবের নামায পড়ে আমাদের পোষা মোরগটা জবাই করে স্ত্রীকে বললাম, বিরানী রান্না কর।

সেলিনা কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, না আপা, বিরানী খেতে ভালো লাগে না। তুমি বরং জর্দা পোলাও আর গোস্ত আলাদা রান্না কর। এখন থেকে বলে রাখছি, এবার থেকে মাঝে মাঝে আমি আসব। কিন্তু আমার জন্য আলাদা কিছু রান্না। করতে পারবে না, যা হবে তাই খাব। যদি কিছু কর, তবে না খেয়েই চলে যাব।

আমার স্ত্রী বলল, ঠিক আছে ভাই, তাই হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত দশটায় বিদায় নেওয়ার সময় সেলিনা বলল, আজ আমি আমার ঠিকানা দিয়ে গেলাম না। একদিন এসে সবাইকে নিয়ে যাব।

আমার স্ত্রী বলল, এবার আসার সময় দুলামিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।

আচ্ছা বলে সালাম দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে সেলিনা গাড়িতে উঠল।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার বলত? অমন বড়লোক বোন জোগাড় করলে কি করে?

সে এক আশ্চর্য ঘটনা।

কি আশ্চর্য ঘটনা খুলেই বল না; মেয়েটার ব্যবহার দেখে মনে হল সত্যিই তোমরা যেন মায়ের পেটের বোন।

ঘটনাটা পুরো বলছি শোন

আমাদেরকে পার্কে রেখে তুমি চলে যাওয়ার পর আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাদাম খাচ্ছিলাম। এই মেয়েটাকে ঐ ড্রাইভারের সঙ্গে কিছু দূরে লেকের ধারে বসে গল্প করতে দেখলাম। একটু পরে মেয়েটা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এসে আমাকে সালাম দিয়ে আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল?

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে বললাম, আপনাকে তো চিনতে পারছি না বোন?

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সায়ফুল্লাকে কোলে নিয়ে খুব আদর করল। তারপর সব ছেলেমেয়েদের হাতে টফি দিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, এই হতভাগীকে চিনে আর কি করবেন? তবে আপনি যখন আমাকে বোন বলে ডেকেছেন, যদি বিরক্ত না হন তাহলে পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।

ওকে দেখে খুব বড় লোকের বৌ বলে মনে হয়েছিল। বললাম বিরক্ত হব কেন? বসুন।

মেয়েটা আমার পাশে বসে বলল, আমার নাম সেলিনা খানম। ঠিক আপনার মতো আমারও একটা আপা আছে। কিন্তু আমার এমনই দুর্ভাগ্য যে, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। কারণ আমি ভালবাসা করে বিয়ে করেছি বলে আমার সব আত্মীয় স্বজন আমাকে দেখতে পারে না। এমন কি আম্মা পর্যন্ত কোনো খোঁজ খবর নেয় না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার আব্বাও কি কোনো খবর নেন না?

উনি আমার বিয়ের আগে মারা গেছেন।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্বামী কি করেন? কোথায় থাকেন? আর ঐ বুড়ো লোকটাই বা কে?

আমার স্বামী ব্যবসা করেন। উনি ঢাকাতেই থাকেন! বুড়ো লোকটা আব্বার দূর সম্পর্কের চাচা হন। আমরা দাদু বলে ডাকি। উনি আমাদের গাড়ি চালান আর গার্জেনের মতো দেখাশোনা করেন।

আপনি স্বামীর বাড়িতে থাকেন না?

আমার স্বামী দ্বিতীয়বার আমাকে বিয়ে করছেন। উনি প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন। তার মনে কষ্ট হবে বলে আমাকে নিয়ে যান না। আমি আমার মায়ের। কাছেই থাকি।

সেলিনাকে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ছেলেমেয়েদেরকে খুব আদর করতে দেখে বললাম, কতদিন আপনাদের বিয়ে হয়েছে? ছেলে মেয়ে হয় নি?

সেলিনা কিছুক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে চোখের পানি মুছে বলল, আমি সে ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি আপা। আজ প্রায় পাঁচ বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। এতদিনে যখন আমার ছেলেমেয়ে হল না। তখন আমার স্বামী মেডিকেলে চেক-আপ করিয়েছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, আমার সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই। তারপর সায়ফুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহপাক যদি শুধু এই রকম একটা ছেলে আমাকে দিত, তাহলে মেয়ে জনম সার্থক হত। আমি জীবনে কোনোদিন মা ডাক শুনতে পাব না মনে হলে বুক ফেটে যায় বলে ঝর ঝুর করে কেঁদে ফেলল।

তার কথা শুনে আমার খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, ওরা কত বড় লোক, আর মেয়েটা দেখতেও সুন্দরী। কিন্তু সন্তান না হওয়ায় কত অশান্তিতে আছে। তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম, কি করবেন বোন? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তাঁর মর্জি ছাড়া কোনো কিছু হয় না।

সেলিনা লেকের পানিতে চোখ মুখ ধুয়ে এসে বলল, আপনি যদি ছোট বোন বলে স্বীকৃতি দেন, তাহলে আমি আপনাকে এখন থেকে আপামণি বলে ডাকব। আর আপনার সঙ্গে নিজের বড় বোনের মত কুটুম্বীত করব।

ওর সব কিছু শুনে আমার খুব মায়া হল। বললাম, আমারও কোনো বোন নেই। আপনি আমার ছোট বোন হলে আমিও খুব খুশী হব।

সেলিনা আমার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে বলল, সত্যি বলছেন?

আমি বললাম সত্যি বলছি।

তখন সেলিনা আবার বলল, তাহলে আমরা আর আপনি করে সম্বোধন করব। ওটাতে দূরের সম্পর্ক বোঝায়। এখন থেকে তুমি আমার নাম ধরে ডাকাবে। আর আমি তোমাকে আপামনি বলে ডাকব।

সেলিনার কথায় যেন যাদু আছে। তার সরল ব্যবহারে আমি খুশী হয়ে বললাম, তাই হবে।

তাহলে চল সম্পর্কটা পাকা করে ফেলি।

কোথায় আবার যাব? আমার স্বামী এক্ষুনি এসে আমাদের খোঁজ করবেন।

সে ব্যবস্থা আমি করছি বলে ড্রাইভারকে ডেকে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, আজ থেকে আপনার আর একটা বোন বাড়ল। সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করার জন্য আমি সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি এখানে বসুন। লক্ষ্য রাখবেন, একজন ভদ্রলোক এসে এদের খোঁজ করলে সব কথা বলে এখানে বসিয়ে গল্প করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ফিরে আসব। তারপর সায়ফুল্লাহকে বুকে তুলে আমাদের সবাইকে নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিউমার্কেটে এসে প্রথমে মিষ্টি খাওয়াল। তারপর সকলের জন্য কাপড় ও মিষ্টি কিনে পার্কে নিয়ে এল। তার পরের ঘটনা তুমি তো জান।

আমি বললাম, যাই হোক, কাপড় নেওয়া তোমার উচিত হয় নি।

আমার স্ত্রী বলল, আমি অনেক আপত্তি করেছি। কিন্তু সেলিনা শুনেনি। বলল, আমি তোমর ছোট বোন। আপামণিদের ছোট বোনদের অনেক অন্যায় আবদার সহ্য করতে হয়। এই সব করে যদি আমি একটু শান্তি পাই, তাতে তুমি বাধা দিও না আপা। এই কথা বলে চোখ মুছল। এত সামান্য কথাতে তার চোখে পানি দেখে মেয়েটাকে সত্যিই খুব দুঃখী মনে হওয়ায় আর আপত্তি করতে পরিনি।

.

এই ঘটনার পর সেলিনা প্রায় বলত, আবার কবে তোমার বাসায় যাব অথবা তাদেরকে আমাদের বাসায় করে নিয়ে আসবে? এখন নয় পরে বলে আমি কাটিয়ে দিতাম।

চাকরি ছেড়ে ব্যাবসা আরম্ভ করার পর কমলাপুরে বাসা ভাড়া নিই। সেলিনাকে বাসার কাছে একজন ডাক্তারের ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলাম, দরকার হলে এই নাম্বারে ফোন করবে। ডাক্তার সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন দাদুও সেলিনাকে নিয়ে এসে ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম, কোনো ইমারজেন্সী খবর থাকলে ফোনে অথবা দাদু এসে ডাক্তারকে জানাবেন। ডাক্তার আমারও সেলিনার ব্যাপাটা আগের থেকে জানতেন।

ব্যাবসার কাজে চিঠি পেয়ে হঠাৎ করে আমাকে সিলেট যেতে হয়। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হয়েছিল। সেলিনার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারিনি। তবে ফোনে সে কথা জানিয়ে ছিলাম। যেদিন ফিরে আসি, সেদিন রাত্রি আটটায় ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হতে বললেন, ড্রাইভার গত পরশু এসেছিল। সেলিনা ভাবি এ্যাকসিডেন্ট করে মেডিকেলে আছে। অবস্থা খুব খারাপ। আমি গতকাল গিয়ে দেখে এসেছি। এই নিন ওয়ার্ড ও বেড নাম্বার।

সংবাদটা আমাকে বিদ্যুৎ পৃষ্টের মত সর্ট করল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।

ডাক্তার আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আল্লাহপাকের রহমতে ভাবি ভালো হয়ে যাবেন। নিন ধরুন বলে ঠিকানা লেখা কাগজটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।

আমি কাগজটা নিয়ে লুংগি ও পাঞ্জাবীপরা অবস্থায় একটা রিক্সায় উঠে মেডিকেলে গিয়ে পৌঁলাম। স্পেশাল পাশ বের করে সেলিনার ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম, শুধু নাক, মুখ ও হাত ছাড়া তার সমস্ত শরীর ও মাথা প্লাষ্টার করা। তখনও জ্ঞান ফিরেনি। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল।

বেডের পাশে জরিনা ও আম্মা ছিল। জরিনা আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলে বলল, আপা গত পরশু এ্যাকসিডেন্ট করেছে। আজ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরেনি। প্রচুর রক্ত গেছে। আপাকে বাচাতে হলে আরো অনেক রক্তের দরকার। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। মাত্র দুবোতল পাওয়া গেছে। ডাক্তার বলেছে কালকের মধ্যে রক্ত জোগাড় না হলে আপাকে বাঁচান যাবে না।

আমি রুমালে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, এ্যাকসিডেন্ট হল কি করে?

জরিনা বলল, আমি ও আম্মা গাড়ি নিয়ে গুলশান গিয়েছিলাম। আপা বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ ফোন পেলাম আমাদের আয়া বলছে, মেডিকেল থেকে ফোন এসেছে আপা এ্যাকসিডেন্ড করে সেখানে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে ইমারজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে আপার কাছে আসি? ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম, মালিবাগের মোড়ে একটা ট্রাক, আপা যে রিক্সায় ছিল সেটাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। আপা রিক্সা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর একটা প্রাইভেট কার আপার উপর দিয়ে চলে যায়। এইসব কথা ডাক্তার রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে শুনেছেন। তাকেও মেডিকেলে আনা হয়েছিল। সে অল্প আঘাত পাওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আজ কেবিনের ব্যবস্থা করা গেছে। আপাকে এক্ষুনি কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার সেই ব্যবস্থা করতে গেছেন।

এমন সময় একজন ডাক্তার দুজন নার্সসহ এসে ট্রলিতে করে সেলিনাকে কেবিনে নিয়ে গেল।

আমি ডাক্তারকে পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা রক্ত পাব কোথায়? তার চেয়ে আমার রক্ত টেষ্ট করে দেখুন, চলবে কি না?

ডাক্তার যখন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখন জরিনা ও আম্মা আমাদের সাথে এল। যেতে যেতে আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম সেলিনা বাচবে তো?

ডাক্তার বললেন, কিছুই বলা যাচ্ছে না। মাথায় ও পেটে ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। আমাদের কর্তব্য আমরা করছি। এরপর উপরের মালিকের উপর নির্ভর করুণ। সি ইজ সিরিয়াসলি উনডেড।

আমার দেখাদেখি জরিনা ও আম্মা টেষ্ট করার রক্ত দিল। ঘন্টা খানেক পরে রিপোর্ট এল আমাদের কারুর রক্ত সেলিনার রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলছে না। রাত্রি বারটা পর্যন্ত থেকে বাসায় ফিরে সেলিনার এ্যাকসিডেন্টের ও রক্তের কথা আমার স্ত্রীকে বললাম।

সব শুনে আমার স্ত্রী বলল, মেয়েটি খুব ভালো। একদিনের পরিচয়ে আমাকে ঠিক আপন বোনের মত করে নিয়েছে। তুমি আমাকে কাল সকালে নিয়ে যাবে। আমার রক্ত যদি তার গ্রুপের সঙ্গে মিলে যায়, তবে তাকে আমি রক্ত দিয়ে বাঁচাব।

বললাম, বড় বোনের মত কথা বলেছ!

পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে মেডিকেলে গেলাম। কেবিনে ঢুকে দেখলাম, আমার শাশুড়ী রয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, সেলিনার আম্মা। আমার স্ত্রী সালাম দিয়ে বেডের কাছে এগিয়ে গেল। সেলিনাকে দেখে কেঁদে ফেলল। জিজ্ঞেস করল বাঁচবে তো?

আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। সামলে নিয় বললাম, আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া কর। তিনি যেন ওকে সুস্থ করে দেন। আল্লাহ তায়ালার কি শান। আমার স্ত্রীর রক্ত টেষ্ট করে ডাক্তার বললেন, সেম গ্রুপ, চলবে। রক্ত দেওয়ার পর তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম।

আমার প্রথম স্ত্রীকে দেখে আমার শাশুড়ীর চেহারায় বিরক্ত ও রাগের চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখলাম। তার পরের ঘটনা দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হয়ে ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, সেলিনা বাচবে তো বাবা?

এই পাঁচ বছরের মধ্যে আজ প্রথম উনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। বললাম, আপনি দোয়া করুন, আল্লাহপাক সন্তানদের প্রতি মায়ের দোয়া কবুল করে থাকেন।

সারাদিন সেলিনার কাছে থাকতাম। রাত্রি বারটার দিকে বাসায় ফিরতাম। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত থাকি, আসবার সময় সেলিনাকে দেখে এলাম আজও জ্ঞান ফিরেনি।

সাতদিন পর সেলিনার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু ভালো করে কথা বলতে পারল না। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার দুদিন পর আমাকে কাছ বসতে বলল। আমি তার কাছে বসে মাথায় হাত রাখলাম।

কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, জান, আমার প্রেম আমাকে বলছে, আমি আর বাঁচব না, যা কিছু বলার তোমার প্রেমিককে শিঘ্রী বলে ফেল। কথা বলার সময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল।

আমিও কান্না রোধ করতে পারলাম না। প্রথমে নিজের তারপর তার চোখ মুছে দিয়ে তার ঠোঁটে একটা আংগুল রেখে বললাম, তুমি এ রকম কথা বলো না, আমি সহ্য করতে পারছি না। প্রেমিকাকে হারিয়ে প্রেমিক কি করে বাঁচবে?

সেলিনা আমার আংগুল সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোমার কাছে যা কিছু অন্যায় করেছি মাফ করে দাও। আমি মরে গেলে আমার জন্য দোয়া করো। আর যত শীঘ্র পার আপামনি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে এস, শেষ দেখা একবার দেখব।

আমার চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছিল। বললাম, তোমার আপামণি তোমাকে দু-তিন দিন এসে দেখে গেছে। রক্ত পাওয়া যায়নি বলে সে তোমাকে নিজের রক্ত দিয়েছে। অবশ্য তখন তোমার জ্ঞান ছিল না। আমি কালকেই তাদেরকে নিয়ে আসব।

এমন সময় নার্স এসে আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ওঁকে বেশি কথা বলাবেন না। ওঁর শরীর খুব দুর্বল, কোনো কারণে উত্তেজিত হলে হার্টফেল করবেন। সেজন্য ডাক্তার মাঝে মাঝে ইনজেকসান দিয়ে অজ্ঞান করে রাখতে বলছেন।

আমি সেলিনার কাছে ফিরে এসে কথা বলতে নিষেধ করলাম। আর উত্তেজিত না হওয়ার জন্য অনেক বোঝালাম।

আমার কথা শুনল না। বলল, আমাকে কিছু কথা বলতেই হবে, পরে আর সময় পাব না। তুমি মেজ মামাকে দিয়ে কালকের মধ্যে একটা উইল করে নিয়ে আসবে, আমি সিগনেচার করে দেব। উল্লেখ থাকবে আমার ব্যাংকের সমস্ত টাকা আমি স্বেচ্ছায় আমার স্বামীকে সত্ত্বাধিকারী করলাম।

বললাম, তুমি থাকবে না আর আমি তোমার টাকা ভোগ করব, তা কখনও আমার দ্বারা হবে না। তার চেয়ে তোমার পরকালের ভালোর জন্য আমি ঐ টাকা খরচ করতে চাই।

না, তোমাকে আমার সবকিছু নিতে হবে। নচেৎ আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব না। তুমি নিজে টাকাটা ভোগ করলে আমি বেশি শান্তি পাব।

তাকে শান্ত করার জন্য বললাম, প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য যদি ঐ টাকা দিয়ে কিছু করে, তাহলে তো আর তোমার তাতে কোনো আপত্তি নেই?

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সেলিনা বলল, প্রেমিক যা ভাল বুঝবে করবে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

নার্সের গলার শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি জরিনা ও আম্মা আমার পিছনে দাঁড়য়ে আছে। মনে হল, আমাদের সব কথা ওঁরা শুনেছেন।

নার্স সেলিনাকে ইনজেকসান দিয়ে চলে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ও ঘুমিয়ে পড়ল। জরিনাকে ওর কাছে থাকতে বলে আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোর্টে মেজ মামার কাছে গিয়ে আমারও সেলিনার মতামত বললাম।

মামা বললেন, এত তাড়াহুড়ো কিসের? সেলিনা তো বেঁচে যেতেও পারে?

আমি বললাম, আল্লাহপাক যেন তাই করেন। কিন্তু সেলিনা এটা আগামী কাল করে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব পিড়াপিড়ী করেছে। প্রথম উইলটা সেলিনার মতে করবেন। দ্বিতীয়টা যে করবেন তাতে উল্লেখ থাকবে, আমি আমার স্ত্রীর সবকিছুর সত্ত্বাধিকারী হওয়ার পর তারই সম্মুখে তার পরকালের মুক্তির জন্য মেডিকেলের পুওরফান্ডে সব কিছু দান করে দিলাম।

পরদিন সকাল আটটায় সেলিনার কেবিনে গিয়ে দেখি, মামা এবং আরও দুতিনজন উকিল বসে আছেন। আমি আসবার তিন চার মিনিট পর জরিনা ও আম্মা এলেন। সেলিনা নীরবে সকলকে লক্ষ্য করছিল। আমি সেলিনার কাছে গিয়ে বললাম, মামা তোমার কথামতো উইল করে এনেছেন, তুমি সিগনেচার করার পর ওঁরা সাক্ষী হিসাবে সিগনেচার করবেন।

সেলিনা আমার দিকে তাকিয়ে উইলটা পড়তে বলল। মামা পড়তে লাগলেন

আমি (সেলিনা খানম), পিতা মরহুম মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঠিকানা……….. আমার মৃত্যুর পূর্বে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যাংকের সমস্ত টাকা স্বজ্ঞানে খুশীর সঙ্গে আমার স্বামী (…) কে স্বত্বাধিকারী করে গেলাম। ভবিষ্যতে আমার কোনো অংশীদার ঐসব সম্পত্তিতে কোনো রকম দাবি করলে আইনতঃ তাহা আগ্রাহ্য হবে।

এরপর মামা দ্বিতীয় ইউলটাও পড়লেন।

সব শুনে সেলিনা মৃদু হেসে বলল, পরের উইলটা যে তুমি এভাবে করবে, তা আমি জানতাম। তবে টাকাটা তুমি নিজে ভোগ করলে, আমি বেশি শান্তি পেতাম।

আমি বললাম, তুমি নিজের দিকটা শুধু দেখলে, আমার দিকটা দেখবে না?

কয়েক সেকেণ্ড সেলিনা কি যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, তোমার মতই আমার মত। তারপর মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি সিগনেসার করতে পারব না। আপনি আমার হয়ে করে দিন।

তার সম্মতি পাওয়ার পর আমরা সকলে সিগনেচার করলাম।

কিছুক্ষণ পর সেলিনা মামাদের চলে যেতে বলল। ওরা চলে যাওয়ার পর আম্মাকে ডেকে বলল, আমি তোমার অবাধ্য মেয়ে। তোমার কথা না শুনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। জীবিত কালে মাফ না করলেও আমার মরণের পর তুমি আমাকে মাফ করে দিও। পারলে তোমার জামাইকেও মাফ করে দিও। ওর কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার। তারপর জরিনার দিকে চেয়ে বলল, তুই যেন আমার মতো আম্মার মতের বিরুদ্ধে কিছু করে তার মনে কষ্ট দিসনি।

তখন সকলের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।

আমার শাশুড়ী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। একটু সামলে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি তোদেরকে মাফ করে দিয়েছি মা। তোদের দুজনকে বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি, তোরা আমাকে মাফ করে দে।

সেলিনার মুখে বিজয়িনীর মতো হাসি ফুটে উঠল। আমাকে বলল, তুমি আমার হয়ে মাকে কদমবুসি কর।

আমি ওঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উনি মাথায় ও চিবুকে হাত বুলিয়ে ভিজে গলায় বললেন, থাক বাবা থাক, আমাকে আর বেশি অপরাধী কর না, এমনিতেই এতদিন তোমাদের প্রতি যা অন্যায় করেছি, তা যেন আল্লাহ মাফ করেন।

সেলিনা আমাকে ডেকে বলল, আজ তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। শুধু আপামণি ও ছেলেমেয়েদেরকে এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে এস। শেষ বারের মতো আপামণির সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই।

আমার মনে হল ও বুঝি আর বাচবে না। আম্মা ও জরিনাকে তার কাছে থাকতে বলে বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি করে সবাইকে নিয়ে এসে দেখলাম, আম্মা ও জরিনা তার দুপাশে বসে আছে, সেলিনার চোখ বন্ধ।

আমি বললাম, তোমার আপামণি এসেছে।

জরিনা সরে বসলে আমার স্ত্রী সেলিনার কাছে বসল।

সেলিনা চোখ খুলে প্রথমে সকলকে দেখল, তারপর আমার স্ত্রীর একটা হাত ধরে বলল, আপামণি, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রাখলে। এই ঋণ শোধ করার সুযোগ আমাকে আল্লাহপাক দিলেন না। যদি ইসলামে জায়েজ থাকত, তাহলে মরণের পর আমার গায়ের চামড়া দিয়ে তোমার জুতো তৈরি করে দিতে ওসিয়ত করতাম। আমি তোমার কাছে অনেক বড় অন্যায় করেছি। যা কোনো মেয়ে অন্য মেয়েকে ক্ষমা করতে পারে না। তোমার স্বামীকে এ ব্যাপারে কোনোদিন কোনো কিছু বলো না। উনি মানুষ হয়েও ফেরেস্তার মত চরিত্রবান। আমি ওঁকে প্রেমের যাদু দ্বারা পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছি। অনেকবার বহু অনুনয় বিনয় করেছি তোমার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য। শুধু তোমার মনে কষ্ট হবে বলে উনি রাজি হননি। তুমি ওঁর সমস্ত অন্তর জুড়ে রয়েছে। অনেক কষ্টে দুবছর ধরে চেষ্টা করে আমি সেখানে একটু জায়গা করতে পেরেছি। তাতেই আমি বুঝেছি, কত গভীরভাবে উনি তোমাকে ভালবাসেন। এত কথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।

আমি বললাম, তুমি এখন চুপ কর, বেশি কথা বললে তোমার বিপদ হবে।

সেলিনা হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, কথাগুলো আমাকে শেষ করতেই হবে। সারাজীবন তোমার কোনো হুকুম অমান্য করিনি। যাওয়ার সময় তুমি কোনো হুকুম করো না। তারপর তার আপামণির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, শেষকালে অনেক জীদ করে শুধু একটিবার তোমাদেরকে দেখতে চেয়েছিলাম। তাই সেদিন। পার্কে তোমাদেরকে রেখে উনি বাইরে গিয়েছিলেন। তারপর যা কিছু ঘটেছে তা আমি নিজে করেছি। উনি এসবের কিছুই জানতেন না। আপামণি, এসব কথা শুনে তুমি খুব দুঃখ পাচ্ছ, কোনোদিন কথাগুলো হয়তো তুমি জানতেও পারতে না, তোমার কাছে মাফ না চেয়ে মরতে পারছি না, তাই বললাম।

এমন সময় নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, আপনারা কি পেসেন্টকে মেরে ফেলতে চান? যান, সবাই চলে যান। ওঁর এখন কথা বলা একদম নিষেধ।

সেলিনা নার্সকে ধমকের সুরে বলল, সিস্টার, আপনি থামুন, আমাকে বলতে দিন। তা না হলে বলার আর সময় পাব না। তারপর তার আপামণিকে বলল, তুমি তো আমাকে ছোট বোন বলে গ্রহণ করেছ? ছোট বোনের এই অন্যায়টা কি মাফ করে দেবে না? আমি তোমার দুটি পায়ে ধরে বলছি, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। চুপ করে আছ কেন? সহসা মাথাটা একটু তুলেই লা-ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ বলে কাৎ হয়ে গেল।

প্রথমে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি, সেলিনা মারা গেছে।

নার্স কয়েক সেকেণ্ড নাড়ী ধরে বলল, সি ইজ ডেড। তারপর একটা চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে দিল।

ওরা সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তখন আমার মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে গেল ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।

এর পরের ঘটনা আর কিছু নেই। জামানের শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। গল্পটা শুনতে শুনতে আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল।

আমাকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখে বলল, কি রে, তুইও কাঁদছিস? সত্যি কথা বলতে কি জানিস, তার কথা মনে পড়লে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না বলে চোখ মুছল।

জিজ্ঞেস করলাম, সেলিনার মৃত্যুর পর তোর শাশুড়ী কী তোর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেন নি?

বললাম, না রাখলেই ভালো হত।

বুঝলাম না!

না বোঝার কি আছে? তিনি এখন আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন, যা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।

সেটাতো আরও বুঝতে পারছি না।

তোর মাথায় গোবর আছে। তুই যে কি করে লেখক হলি, তা ভেবে পাচ্ছি। আরে তিনি আমাদের বাসায় প্রায়ই আসেন এবং আমাদের সঙ্গে এত মধুর ব্যবহার করেন, যেন আপন মেয়ে জামাই ও নাতি-নাতনি।

তাই বল, এটা তো খুব ভালো কথা। আফটার অল তুই তো তার আপন। মেয়েকেই বিয়ে করেছিলি। তা ছাড়া তিনি তার ভুলও বুঝতে পেরেছেন।

হ্যাঁ, তা তো তোরা বলবি। কিন্তু সেলিনা বেঁচে থাকতে যদি এ রকম করত, তা হলে সে যে কত খুশি হত বলে রুমাল দিয়ে আবার চোখ মুছল।

আমি তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম, কি আর করবি বন্ধু? সবকিছু আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছা। তার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করার এতটুকু কারুর ক্ষমতা নেই। সবর কর। দোয়া করি, আল্লাহপাক তোকে সবকিছু সহ্য করার তওফিক দিক। জেনে রাখ, কোনো এক কবি বলেছেন

প্রেমের পবিত্র শিখা চিরকাল জ্বলে
স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।

তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি যেন আড়াই ঘন্টা স্বপ্ন দেখলাম। সত্যি এরকম ঘটনা দুনিয়াতে বিরল। এখন আসরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। চল দুজনের মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।

বৃষ্টি অনেক আগে ছেড়ে গিয়ে সোনালি রোদ উঠেছে। নামায পড়ে এসে চা নাস্তা খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

ফেরার পথে স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, দুবন্ধুতে এতক্ষণ ধরে কি এত গল্প করলে?

বললাম, ও নিজের জীবনের একটা রোমান্টিক ও মর্মান্তিক ঘটনা আমাকে শুনিয়েছে। শোনাবার আগে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে, কাহিনীটা নিয়ে যেন একটা উপন্যাস লিখি।

কাহিনীটা আমাক শোনাবে না?

আগে লিখি, তারপর সেই পাণ্ডুলিপিটা তুমি পড়ো।

Exit mobile version