সেলিনা রুমালে চোখ মুখ মুছে বাদাম ওয়ালার দিকে গেল। আমি লেকের। পানিতে অজু করে ঐখানেই ঘাসের উপর আসরের নামায পড়লাম। সেলিনা ফিরে এসে আমার নামায পড়া দেখছিল। নামায শেষ করে টুপিটা পকেটে রেখে বললাম, যাবেন না বসবেন?
কিছু না বলে সেলিনা বসে পড়ল। তারপর বাদামের ঠোঙাটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, নিন খান।
বাদাম নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা নামায পড়েন?
আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে না।
আসরের নামায পড়বে না?
কথাটা শুনে সেলিনা প্রথমে চমকে উঠল। তারপর আমার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে কেমন করে পড়ব? বাসায় গিয়ে পড়ব।
তার চমকে উঠার কারণটা বুঝতে পারলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে নামায পড়ছ?
যখন থেকে আপনার প্রেমে পড়েছি।
প্রেমের সঙ্গে নামাযের কি সম্পর্ক?
তা বলতে পারব না। শুধু এইটুকু মনে হয়েছে, নামায পড়া আল্লাহপাকের হুকুম। তার হুকুম পালন করলে আপনি নিশ্চয় খুশী হবেন। তাই আমার প্রেম নামায পড়তে বলেছে।
মেয়েদের মাথায় কাপড় বা রুমাল দিয়ে চুল ঢেকে রাখাওতো আল্লাহপাকের হুকুম।
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনা শাড়ীর আঁচল মাথায় দিল। তারপর থেকে তাকে কোনোদিন মুহুর্তের জন্যও খালি মাথায় দেখিনি। তারপর বললাম, চল উঠা যাক, নচেৎ তোমার আসরের নামায কাযা হয়ে যাবে। কেউ যদি ইচ্ছা করে এক ওয়াক্ত নামায কাযা করে (না পড়ে), তবে তাকে আশী হোকবা দোজখে জ্বলতে হবে। (এক হোকবা সমান দুই কোটি অষ্টআশী লক্ষ বছর)।
সেলিনা, উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে বলল, একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।
এতক্ষণ যে সম্বোধনে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সব সময় সেই সম্বোধনে বললে খুব খুশী হব।
চিন্তা করলাম, সে আমার অন্তরের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। ফলে মনের অজান্তে তাকে এতক্ষণ তুমি করে সম্বোধন করেছি। আর সেই কারণে সেলিনা বোধ হয় তখন চমকে উঠেছিল।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবেন?
বললাম না, আমার মাথার মধ্যে তখন চিন্তার পোকাগুলো কিলবিল করতে আরম্ভ করেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, সেলিনা বুঝতে পেরেছে যে, সে আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে। নিজের উপর খুব রাগ হতে লাগল এবং তার সূত্রটা খুঁজতে গিয়ে সেলিনাই দায়ী বলে মনে হল। তখন সমস্ত রাগটা তার উপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। কারণ রাগের সঙ্গে কিছু বললে, তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। আর সেলিনার ক্রন্দসী মুখটা আমাকে বড় বেশি ব্যথা দেয়। অনেক কষ্টে সম্বরণ করে নিলাম।
গেটে এসে সেলিনা বলল, আপনাকে কোথায় পৌঁছে দেব বলুন?
আচ্ছা, আপনি আমাকে কি মনে করেন? কোথাও পৌঁছাতে হবে না, আমি নিজেই যেতে পারব। রাগান্বিত অবস্থায় চিন্তিত ছিলাম বলে কথাগুলো একটু রাগের সঙ্গে বলে ফেলেছি। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো বর্ষায় পুরিপূর্ণ। নিজেকে সংযত করে বললাম, আমি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। অন্যমনস্কতায় একটু রেগে বলে ফেলেছি। এবার আসি, আল্লাহ হাফেজ বলে একটা রিকশায় উঠে বায়তুল মোকাররাম যেতে বললাম। সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, আর তার চোখ থেকে শ্রাবণের ধারা ঝরছে। বায়তুল মোকাররামে মাগরিবের নামায পড়ে অনেকক্ষণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে মোনাজাত করলাম
আয় পরওয়ারদেগার রহমানুর রাহিম, তোমার মোবারক নামে শুরু করিতেছি। তুমি অনাদি অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তুমি সর্বত্র সব সময় বিরাজমান, তুমি অসীম করুণাময়, ধৈৰ্য্য ও ক্ষমার আধার। আমি তোমার আঠার হাজার মাখলুকের শ্রেষ্ঠ মাখলুকের একজন নাদান বান্দা। তোমাকে আমার রেজেক যোগাতে হবে, আমার আশা-আকাঙ্খার কথাও শুনতে হবে। সর্ব প্রথম পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর রুহমোবারকের উপর তোমার রহমতের ধারা বর্ষণ কর। তারপর দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর-নারীর উপর তোমার রহমতের দরজা উম্মুক্ত করিয়া দাও। দয়াময়, তুমি আমার মনের খবর জান। এই পাপী বান্দা বিবাহতি হইয়াও একটি নারীর প্রেমে দিন দিন আসক্ত হইয়া পড়িতেছি। তুমি উত্তম ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি উত্তম সৎপথ প্রদর্শনকারী, আমাকে সৎপথে চলার তওফিক দান কর। হে রাব্বল আলামিন, আমি কি করব বলে দাও। একদিকে আমার স্ত্রীর গভীর ভালবাসা, আর অন্যদিকে একটি মেয়ে প্রেমের দাবীতে আত্মহত্যা করতে চাইছে। তুমি উত্তম ফায়সালাকারী, আমি তোমার কাছে ফায়সালা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি ফায়সালা করে দাও। জানি তোমার আইন : অনুযায়ী চারটে পর্যন্ত বিবাহ হালাল। কিন্তু সেটাও তো প্রয়োজনের তাগিদে। আরও জানি তুমি বলেছ বান্দা যদি সব স্ত্রীকে সমানভাবে রাখতে না পারে তবে যেন সে একটাতে সন্তুষ্ট থাকে। হে গাফুরুর রাহিম, তুমি সবকিছু জান, সারা জাহানে যা কিছু হচ্ছে তোমার হুকুমেই হচ্ছে। তুমি আমার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে আমার এই দোয়াকে কবুল কর। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর এবং সমস্ত আম্বিয়া (আঃ)-এর উপর শান্তি বর্ষণ কর। আমিন সুম্মা আমিন।