সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো এভাবে বলে কখন কোথাও যাওনি? মনে হচ্ছে এই কদিন যেন কিছু ভাবছ?
আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, পাগলী, তোমাকে কি করে সুখী করব সেই কথা ভাবছি। এই অকাট্য মিথ্যা বলতেই আমার মনের মধ্যে সুঁচের মতো বিঁধল।
আদরের প্রতিদান দিয়ে আমার স্ত্রী বলল, আমি এর চেয়ে বেশি সুখ চাইনি। তোমার হাসি মুখ দেখলেই শান্তিতে আমার মন ভরে যায়। আল্লাহপাক যেভাবে রেখেছেন তাতেই আমরা শোকর করে থাকব। আমার জন্য তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।
স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনটের অনেক আগেই পার্কের গেটে পৌঁছলাম। ইচ্ছা ছিল পার্কটা একটু ঘুরে দেখব। কিন্তু রিকশা থেকে নেমেই সেলিনাকে একটি মেয়ের সঙ্গে গেটের ভিতর কথা বলতে দেখলাম। তাদের সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোকও রয়েছেন।
আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে আমাকে সালাম দিয়ে বলল, এখন আড়াইটা বাজে। আমি জানতাম, আপনি ঠিক তিনটেয় আসবেন। কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবুজ রং এর শাড়ী ও ব্লাউজে খুব সুন্দর মানিয়েছে।
চোখে চোখ পড়তে সেলিনা বলল, কি দেখছেন? কথা বলছেন না কেন?
বললাম, ওরা কারা?
ভদ্রলোক আমার খালু, আর মেয়েটি খালাতো বোন। গতকাল সিলেট থেকে আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওরা পার্ক দেখে কোথায় যেন যাবে। আমাকে সঙ্গে থাকতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। বলেছি একজনকে তিনটের সময় এখানে। আসতে বলেছি, তার সঙ্গে বিশেষ দরকার আছে। রেষ্টুরেণ্টে যাই চলুন।
না, বরং কোনো নির্জন জায়গায় বসা যাক। হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে আড়াল দেখে ঘাসের উপর দুজনে পাশাপাশি বসে পড়লাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, চিন্তা ভাবনা করে কি ঠিক করলেন?
সেলিনা লেকের পানির দিকে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে চেয়ে রইল। তারপর ঘুরে আমার মুখোমুখি বসে বলল, আমি আমার ফাইন্যাল মতামত বলছি শুনুন, মরে গেলেও আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারব না। আমাকে কোনো কারণ দেখিয়ে ভুলাতে পারবেন না। আমি আপনাকে ভালবেসেছি, আপনার পরিচয়কে নয়। সে জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় করব, যত দুঃখ সহ্য করতে হয় করব, তবু আপনাকে হারাতে পারব না।
অবাক হয়ে বললাম, আপনি পাগলের প্রলাপের মত কথা বলছেন। কোনো সুস্থ মানুষ এই রকম কথা বলতে পারে না। আমার কাছ থেকে আপনি দৈহিক, মানষিক ও আর্থিক কোনো দিক থেকেই এতটুকু সুখ-শান্তি পাবেন না, বরং পাবেন শুধু অবহেলা আর অশেষ দুঃখ। আপনি ধনীর দুলালী, এইসব সহ্য করতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো মেয়েই প্রেম দিয়ে এইগুলো ক্রয় করতে চাইবে না। অনেকে শত দুঃখ সহ্য করতে পারলেও স্বামীর অবহেলা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
সেলিনা আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, আপনি এইসব কথা বলবেন না। পৃথিবীর মেয়েরা প্রেম দিয়ে কি খরিদ করে তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, প্রেম দিয়ে প্রেম খরিদ করব। সে জন্য আপনি আমাকে যত দুঃখ দেন, যত অবহেলা করুন না কেন, সবকিছু আমি নীরবে সহ্য করব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে আমি প্রেম দিয়ে একদিন না একদিন জয় করবই করব। পৃথিবীর কোনো বাধাই আমি মানব না। প্রয়োজন হলে চির কুমারী থাকব। যদি তা না পারি অন্যের অঙ্কশায়িনী হওয়ার আগে আত্মহত্যা করব। জানব, এটাই আমার তকৃদির। দেশী বিদেশী অনেক বই পড়েছি। জেনেছি, প্রেম মানেই দুঃখ। লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স। সুতরাং দুঃখের কথা বলবেন না। আমাকে বিয়ে করতে হয়তো আপনার অনেক বাধা থাকতে পারে। অথবা আমাকে নষ্ট চরিত্রের মেয়ে ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরে যেতে পারেন। তবু আমি আমার প্রেমকে চিরকাল বাচিয়ে রাখব। তাতে অক্ষম হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেব।
ভাবলাম, ও আমাকে এত বেশি ভাল বেসে ফেলেছে যে, যদি আমাকে না পায়, তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে ফেলবে। খুব চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে। আমি আপনাকে একটা চিঠি দেব, তার উত্তর পাওয়ার পর ভবিষ্যতে কি করব জানব। কথাগুলো বলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার মুখের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ সেলিনা আমার ডান হাতটা দুহাতে ধরে প্রথমে চুমো খেল, তারপর নিজের দুগালে ঘষতে লাগল।
আমার হাত তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল। আমার কাছ থেকে নাম মাত্র আশ্বস পেয়ে সেলিনা আনন্দ অশ্রু ফেলতে লাগল। তার গভীর প্রেমের পরিচয় পেয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। অনুভব করলাম, আমি তার গভীর প্রেমের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি? পরক্ষণে আমার স্ত্রীর মুখ মনে পড়তে স্বজ্ঞানে ফিরে এলাম। হাতটা টেনে নিয়ে বললাম, ইসলাম এইজন্য মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছে। আর নির্জনে যুবক যুবতীর সাক্ষাৎও হারাম। করেছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কখনও কোনো বেগানা মেয়েকে স্পর্শ করি নি। জানি না, আল্লাহপাক আমাকে ক্ষমা করবেন কি না। আমি আপনার ডাকে আসতাম না। যদি না আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করতেন। আর এই যোগাযোগ বন্ধ করার জন্যই আজ এসেছি। ভেবেছিলাম, আমার পরিচয় পেয়ে ঘৃণা করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এখন দেখছি সে ধারণা ভূল। আপনাকে আমার সত্য পরিচয় দিয়ে শত বাধা বিপত্তির কথা বলে যতই দুরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি, আপনি ততই প্রেমের জাল বিস্তার করে আমাকে ঘিরে ফেলছেন। উপরের মালিকই জানেন আমার কি হবে?