আমার পরিচয়তো শুনলেন! এখন চিন্তা করে দেখুন, আমি কি আপনার উপযুক্ত? আপনার এত ভালবাসার মুল্য কি করে আমি দেব? আপনি বিরাট বড়লোকের মেয়ে। আমার মত দীন-হীনকে ভালবেসে সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভাসবেন। আমি বিবাহিত ছেলেমেয়ের বাবা। সেটা সবচেয়ে বিরাট বাধা বলে আপনার মনে হওয়া উচিত। আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন শুনে আমার অন্তর গর্বে ফুলে উঠতো, যদি আমি আপনার উপযুক্ত হতাম। তবে আপনার ভালবাসার কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। কুল ব্রেনে আপনাকে জানাচ্ছে, আমি আপনার কোনো উপকারে আসব না। একটা কথা আপনাকে বলি শুনন, আমার জানাশোনা আপনাদের সমপর্যায়ভুক্ত অনেক ভাল ছেলে আছে। আপনার ভালবাসার মুল্য বাবদ তাদের একজনের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ করে দিতে পারি। এই কয়েকদিনের মধ্যে আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে করে আপনার মনের মত ছেলে চয়েস করে দিতে আশা করি পারব। মনে হয় তাতে ঠকবেন না। বাকিটা আপনার তকৃদির। মানুষ সুখ-শান্তির জন্য যত চেষ্টাই করুক না কেন, সব কিছুর চাবিকাঠি সেই উপরওয়ালার হতে।
ঠিক আগের মত আদেশের স্বরে সেলিনা বলে উঠল, থামুন, আমি আর ঐ সমস্ত কথা শুনতে পারছি না। আশা করি, আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে?
আপনি যদি কথা না বাড়ান, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেলিনা বলল, বারটা বেজে গেছে, ডিনার খাওয়া যাক বলে কলিং বেলে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন?
বললাম, এখানে কিছু খাব না; বাসায় গিয়ে খাব।
এমন সময় বেয়ারা এলে তাকে সেলিনা দুপ্লেট মুরগীর বিরানী অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যেতে বলল, প্রতিদিন তো বাসায় খান, আজ আমি আপনাকে আমন্ত্রণ করে এনেছি, এখানে খেতেই হবে, কোনো কথা শুনবো না।
আবার কি করতে কি করে বসবে ভেবে কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম।
বেয়ারা খাবার নিয়ে এলে তাকে সেলিনা গাড়ির নাম্বার ও কালারের বর্ণনা দিয়ে বলল, এই গাড়ি যদি গেটে থাকে, তাহলে ড্রাইভারকে খেয়ে নিতে বলুন। তারপর তাকে আরও কি সব অর্ডার দিয়ে নিজের প্লেট থেকে এক টুকরো মাংস আমার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, নিন শুরু করুন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অল্প কিছু খেলাম। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। আবার কি বলবে না কোথাও যাবে এইসব মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম।
আমাকে অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়া শেষ করতে দেখে সেলিনা বলল, আপনি এত তাড়াতাড়ি খান কি করে? আপনার ঠিকমত হজম হয়?
কেন? আমাকে দেখে কি পেটের অসুখের রুগী বলে মনে হয়?
না তা হয় না, তবে খাবার সময় ধীরে সুস্থে খেতে হয়।
তা ঠিক, তবে আমার জীবনের অভিধানে স্লো বলে কোনো কথা লেখা নেই। শুধু নামাযের বেলায় এর ব্যতিক্রম হয়।
কেন নামাযের সময় ব্যতিক্রম হয় কেন?
নামায হল মোমেনদের (বিশ্বাসীদের) মেরাজ স্বরূপ। অর্থাৎ স্কুল মোখলুকাতের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দিদার। তাঁর স্ততি গেয়ে নিজের অপরাধ ও অপারগতা স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে করুণা ভিক্ষা করা। এই কাজ কি আর তাড়াতাড়ি করা যায়? হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যারা অনেক ধন দৌলত চুরি করে, তারা বড় চোর নয়। বরং তারাই বড় চোর, যারা নামাযের সবকিছু আদায় না করে তাড়াতাড়ি নামায পড়ে।
সেলিনা খাওয়া বন্ধ করে আমার কথা শুনল। তারপর লজ্জায় হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক আর খেল না।
খাওয়া শেষে হওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, চলুন উঠা যাক। আশা করি, আপনি আমার কথা চিন্তা করে আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবেন।
সেলিনা বলল, আপনার বলার পর আমি কিছু বলব বলেছিলাম; কিন্তু আপনি যে রকম তাড়াহুড়া করছেন, বলতে সাহস পাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে আগামী ছুটির দিনে এখানে আসবেন।
এখানে আসবার আর কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া প্রত্যেক ছুটির দিন আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সপ্তাহে মাত্র একদিন ছুটি পাই, সংসারে নানা রকম কাজ কর্ম থাকে।
মিনতি স্বরে সেলিনা বলল, শুধু আর একটা দিন। পরে আর কোনো দিন অনুরোধ করব না।
একটু ভেবে বললাম, এই কথা যেন মনে থাকে। আর আগামী ছুটির দিন। নয়, তার পরের সপ্তাহের ছুটির দিন পার্কের দক্ষিণ দিকের গেটে বিকেল তিনটেয় আসব।
আমরা কথা শুনে তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর চোখ দুটো পানিতে ভরে গেল। ফেরার সময় সেলিনা বিলের সঙ্গে বেয়রাকে দশ টাকা বখশিস দিল। তারপর আমার কথামতো আমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
বাসায় ফেরার জন্য রিকশায় উঠলাম। মনের মধ্যে তখন নানা রকম চিন্তা হতে লাগল। বাসায় এসে স্ত্রীকে বললাম, হোটেলে খেয়ে এসেছি, শরীরটা ভাল লাগছে না, আমি এখন ঘুমোব। ঘুমোতে গিয়ে চোখ বন্ধ করা সার হল। শুধ সেলিনা ও তার মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল। মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হতে বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলাম। তারপর লুংগীর উপর পাঞ্জাবী চড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন আমি বাংলা বাজারে থাকতাম। সবকিছু অস্বস্তি লাগছিল। কেবলই মনে হতে লাগল স্ত্রীর কাছে যেন কত বড় অন্যায় করে ফেলেছি। হাঁটতে হাঁটতে সদর ঘাটে নদীর ধারে গিয়ে একটা নৌকা ভাড়া করে মাঝিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে যেতে বললাম। নদীতে কত রকমের নৌকা, ষ্টিমার, লঞ্চ দেখতে দেখতে মন থেকে চিন্তা দুর করার চেষ্টা করলাম। তাতে বিশেষ ফল হল না। আসরের আজান শুনে পাটুয়াটুলির বড় মসজিদে নামায পড়ে আল্লাহপাকের দরবারে ক্ষমা চেয়ে শান্তি প্রার্থনা করলাম। মনটা বেশ হালকা হল; কিন্তু বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারলাম না। তাকে দেখে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। আমার স্ত্রী শরীরের কথা জিজ্ঞেস করতে বললাম, শরীরটা ভালো না। সেইজন্য মনটাও খারাপ। কিছু যেন ভালো লাগছে না। এই কথা বলার পর অস্বস্তি ভাবটা আরও বেড়ে গেল। স্ত্রীর কাছে কখনও মিথ্যা বলিনি। আজ মিথ্যা বলে নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে গেলাম। এই অস্বস্তি ভাবটা দুতিন দিন ছিল। শেষে চিন্তা করলাম, যে ভাবেই হোক সেলিনাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দুরে সরিয়ে দিতে হবে, তাহলে আমি আবার শান্তি ফিরে পাব।
২. নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময়
নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বললাম, আমার ফিরতে হয়তো একটু রাত হতে পারে, তুমি কোনো চিন্তা করো না।