আমি বললাম, আপনার আসল কথাটা কি স্পষ্ট করে বলুন।
সেলিনা আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আজ তিন বছর আগে থেকে ভালবেসে আসছি।
তার কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠি। তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেম-ভালবাসা এই শব্দগুলোর ডেফিনেশান জানেন?
ডেফিনেশান টেফিনেশান আমি বুঝি না। যা বললাম তা ধ্রুব সত্য। এর মধ্যে কোনো বাচালতা নেই। বাচালতাকে আমি ঘৃণা করি। সোজা পথে চলি। বাঁকা পথ চিনি না। আমার বিবেক যখন প্রেমকে এই বলে বোঝাতে চেয়েছে, একজন অজানা অচেনা লোককে ভালো লাগলেও তার সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে কিছুতেই আবদ্ধ হওয়া যায় না। তখন আমার প্রেম বিদ্রোহ করে বলেছে, প্রেম কোনোদিন পাত্র বিচার করে না। যে পাত্রের বিচার করে, সে আসল প্রেম থেকে বঞ্চিত। আসল প্রেমিক অনল জেনেও তাতে ঝাঁপ দেয়, যদিও সে জানে অনলে ঝাপ দিলে পুড়ে যাবে তবুও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার প্রেম সত্য। একদিন না একদিন তার জয় হবেই হবে। কথা শেষ করে চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তার কথা শুনতে শুনতে হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকেই চেয়ে ছিলাম। চোখে, চোখ পড়তে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলাম। ভাবলাম, এই সমস্ত কথা ও শিখল কোথায়? নিশ্চয় আউট বই অনেক পড়েছে। গত কয়েকদিনের ব্যবহারে এবং আজকের ঘটনা দেখে মনে হল, তার মধ্যে কোনো মিথ্যা বা অভিনয় নেই। হয়তো, সত্যিই অনেকদিন থেকে আমাকে ভালবেসে আসছে। কখাটা চিন্তা করে আমার খুব দুঃখ হল। কারণ সে অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেছে। আমার দিক থেকে সবচেয়ে প্রথম এবং বড় বাঁধা, আমি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। দ্বিতীয়তঃ আমি একটা লাইব্রেরীর সেলস ম্যানেজার। মাত্র পাঁচশো টাকা বেতন পাই। যদিও আমার একটা সাইড বীজনেস থেকে মাসে এক হাজার টাকা আসে। তবুও এদের সঙ্গে আমার কোনো তুলনা হয় না। আমার স্ত্রী স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র মেয়ে। সে সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। আমাদের দাম্পত্য জীবনে এতটুকু অশান্তি নেই। আমরা উভয় উভয়েকে খুব ভালবাসি। তাকে ছাড়া জীবনে অন্য কোনো মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিনি। আমার স্ত্রীর মধ্যে এমন কোনো খুঁৎ নেই, যেটা নিয়ে আমি অন্য মেয়ের দিকে চেয়ে তুলনা করব। আমার দেহের গড়ন একহারা হলেও খারাপ না। ছেলেবেলা থেকে আমি খুব কর্মঠ, মাঠে ফসল ফলিয়েছি। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ এবং বিয়ের চার বছর পর পর্যন্ত ব্যায়ামবীর মনোতোষ রায়ের ছাত্র ছিলাম। এই সর্ব প্রথম সেলিনাকে ভালো করে দেখার ইচ্ছা হওয়ায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম। দেখতে সুন্দরী, কিন্তু গুণবাচক নয়। রংটা বেশ ফর্সা। মনে হল আঠার বিশ বছরের মেয়েরা যে সমস্ত কারণে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, তার সব কয়টা গুণ তার শরীরে আছে। আমার কাছে সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল তার চোখ। যেন কত গভীর প্রেম ঐ চোখের চাহনীর মধ্যে রয়েছে। আমি সেই চোখের দিকে চেয়ে প্রেমের সাগরে বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।
সেলিনা আমার দিকে চেয়ে চোখের ভাষা পড়ে নিচ্ছিল। সে নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, আপনি এতক্ষণ ধরে কি ভাবছেন? কিছু বলুন। আমার কথা আমি বলেছি, আপনার কথা শোনার পর আরও কিছু বলব।
আমি কি বলব চিন্তা করতে করতে ঘড়ি দেখলাম, বেলা এগারটা।
আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে সেলিনা বলল, আমার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে, আপনাকে নাস্তা খাওয়ান হয়নি।
তার আর দরকার নেই। নাস্তা আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। এখন কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আমার মধ্যে কি এমন জিনিস দেখলেন, যার ফলে প্রেমে পড়ে গেলেন? আমি দেখতে তেমন সুন্দর নই, স্বাস্থ্যও খুব ভাল নয়, যা মেয়েদেরকে সর্ব প্রথম আকর্ষণ করে। তাছাড়া আমি দোকানের একজন সামান্য : কর্মচারী, তাতেই নিশ্চয় বোঝেন আমার আর্থিক অবস্থা।
আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কিছুক্ষণ আগে বলেছি। আবার যদি শুনতে চান তাহলে ঐ একই কথা বলব।
আর কোনো প্রশ্ন না করে প্রায় আদেশের স্বরে বললাম, আমার পরিচয় বলছি, মন দিয়ে শুনুন। তারপর চিন্তা করে দেখবেন, কি করবেন।
আমি আপনার পরিচয় শুনতে চাই না।
ধমক দিয়ে বললাম, আপনি শোনতে না চাইলেও আমি শুনাব। কারণ আমার। পরিচয় জানা আপনার একান্ত কর্তব্য। আমি আপনার এত কথা শুনলাম, আর আপনি আমার সামান্য পরিচয়টুকুও শুনতে চান না? সেলিনা আর কোনো আপত্তি না করায় বলতে আরম্ভ করলাম।
১৯৬৫ সালে আমি একজন রিফিউজী হিসাবে পশ্চিম বাংলা থেকে স্বস্ত্রীক ঢাকায় আসি। আমি ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী শুরু করি। আর নাইট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে থাকি। সে বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সতের দিনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার কয়েক মাস পর আমার ছোট বোনের স্টুল পরীক্ষা করার জন্য তার স্বামীর সঙ্গে গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কলিকাতার এক বড় ডাক্তারের কাছে যাই। আমাদের গ্রাম থেকে কলিকাতার দূরত্ব পঁয়ত্রিশ মাইল। কলেজ স্ট্রীটের মোড়ের এক দোকান, থেকে সিগারেট কেনার সময় এক ভদ্র লোককে ডাক্তারের ঠিকানা দেখিয়ে লোকেশানটা জিজ্ঞেস করলাম। এমন সময় সেখানে কয়েকজন গুণ্ডা ধরনের লোক এল। তাদের মধ্যে একজন আমাকে লক্ষ্য করে বলল, শালা নেড়ে এখনও পাকিস্তান যায় নি? এই কথা বলে আমাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে একটা বড় বাড়ির আঙ্গিনায় একধারে দাঁড় করিয়ে বলল, শালা নেড়েকে কেটে ফেলব। ঐ দেশের হিন্দুরা মুসলমানদেরকে সাধারণতঃ নেড়ে বলে বিদ্রুপ করে থাকে। আমার তখনও দাড়ী ছিল। জীবনের প্রথম থেকেই দাড়ী রেখেছি। তার উপর পাজামা। পাঞ্জাবী পরেছিলাম। তাই তারা আমাকে সহজে মুসলমান বলে চিনেছিল। আমার ছোটবোনের স্বামী ধুতি ও শাট পরেছিল বলে তাকে সন্দেহ করে নি। যাই হোক, রাখে আল্লাহ মারে কে? হঠাৎ কোথা থেকে চার পাঁচজন ছাত্র ধরনের ছেলে এসে তাদের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করে দিল। তাদের মধ্যে থেকে একজন আমার হাত ধরে গেটের বাইরে এনে বলল, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। দেখলাম, তখনও ছোট বোনের স্বামী করুণ দৃষ্টিতে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। আসার সময় ভিতরের ঘটনা তাকে বললাম। সেদিন স্টুল পরীক্ষা না করেই আমরা বাড়ি ফিরে আসি। তারপর সবাইকে জানালাম; আমি আর এখানে থাকব না, পাকিস্তান চলে যাব। কারণ জিজ্ঞেস করলে সবাইকে উক্ত ঘটনা বলতাম। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। আমি বাপের বড় ছেলে। ছোট ভাইটি তখন ক্লাস টেনে পড়ে। বোনেদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের সংসার মোটামুটি স্বচ্ছল। চাষের ধান ও তরি-তরকারী, পুকুরে মাছ এবং ঘরের গরুর দুধ কোনোটারই অভাব ছিল না। কিছুদিন আগে থেকে আম্মা আব্বাকে বলে আসছিল, খোকার বিয়ে দিয়ে বৌ আন। আমি আর কত দিন তোমাদের সংসারের ঘানি টানব? শুধু আব্বা আম্মা -আমাকে খোকা বলে ডাকেন। আব্বা তখন বললেন, পঁচিশ বছরের নিচে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া উচিত না। আমার বয়স তখন বিশ বছর। আমি যখন (পুর্ব পাকিস্তানে) বর্তমানে বাংলাদেশে চলে আসব বললাম। তখন হঠাৎ করে আব্বা তার ফুপাতো ভাইয়ে সঙ্গে শলা পরামর্শ করে একরাতে তার মেয়ের সঙ্গে আমার জবরদস্তি বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দুঘন্টা আগেও তাদের পরামর্শের কথা জানতাম না। আমি খুব ছেলেবেলা থেকে ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। আমার দাদাজী বলতেন, ভাই, জীবনে কোনোদিন কোনো কারণেই নামায রোযা ত্যাগ করো না। আর আব্বা বলতেন, অনেষ্টী ইজ দা বেষ্ট পলিসি। আমি তাদের উপদেশ সামনে রেখে সব সময় চলে আসছি। তাই মনে হয় আল্লাহপাকের রহমতে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হইনি। আমার বিয়ে দিয়েও তারা আমাকে ধরে রাখতে পারলেন না। সুযোগমতো স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসি। সব কথা বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে, তাই সংক্ষেপে বললাম। এখানে আসার পর থেকে এই লাইব্রেরীতে চাকরি করছি।