ঠিক আছে মেমসাব বলে বেয়ারা চলে গেল!
আমি তখন চিন্তা করছি ওর কথা শোনার পর ফাইনাল বোঝাপড়া করে নিতে হবে, ভবিষ্যতে যেন আমার সঙ্গে কোনোরকম সম্বন্ধ না রাখে।
সেলিনা হঠাৎ উঠে এসে মেঝের উপর বসে পড়ে আমার দুপা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমার বোকামীর জন্য আপনি খুব অপমানিত হয়েছেন, সেজন্য আমি মাফ চাইছি। বলুন আমাকে মাফ করেছেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভীষণ আশ্চর্য হলাম। তারপর রাগতস্বরে বললাম, পা ছাড়ুন, উঠুন। চরম গুরুজন ছাড়া কারও পায়ে হাত দেওয়া উচিত না।
আপনি আগে বলুন, মাফ করে দিয়েছেন?
বললাম, পাগলামি করবেন না; পাগলামিরও একটা সীমা আছে। তবু যখন পা ছাড়ল না তখন আমি দাঁড়িয়ে ওর দুটো হাত ধরে জোর করে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বললাম, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এক্ষনি চলে যাব, যে কথা বলার জন্য এনেছেন বলুন।
সেলিনা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কি করব বুঝতে না পেরে চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, যা গত হয়ে গেছে তাকে নিয়ে আপনি অত মন খারাপ করছেন কেন? সেটা ভেবে বরং আমারই বেশি রাগ ও মন খারাপ হওয়ার কথা। আপনাকে আমি অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। নচেৎ আপনার সঙ্গে এখানে আসতাম না। মায়েরা সন্তানদের ওরকমভাবে অনেক বকাঝকা করে। আমি সে জন্য মনে কোনো কষ্ট নিইনি। তবে আপনার নির্বুদ্ধিতার জন্য সে সময় আপনার উপর খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। কারণ আপনি যে কাজ করেছেন, সেটা যে মস্তবড় অন্যায়, এই জ্ঞানটাও আপনার নেই।
সেলিনা উঠে গিয়ে বেসিন থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আমার দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে চুমুক দিল। তারপর বলল, ব্যারিষ্টার মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে চেনেন?
নামটা শুনেই মনে হোঁচট খেলাম। তখন প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা আমার মনের পাতায় ভেসে উঠল।
১৯৭০ সালে ব্যারিষ্টার সাহেব প্রথম যেদিন আমাদের দোকানে আইনের বই কেনার জন্য আসেন তখন সালওয়ার কামিজ পরে এই মেয়েটিও সঙ্গে ছিল। উনি সেদিন অনেক বই কিনেছিলেন। দেরি হচ্ছে দেখে আমি মেয়েটিকে একটি চেয়ার দিয়ে বলেছিলাম, খুকি, তুমি এখানে বসো। তারপর থেকে মেয়েটি ব্যারিষ্টার সাহেবের সাথে প্রায় আসত।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিনা আবার বলল, উনি আমার আব্বা।
বললাম, ওঁকে আমি খুব ভালভাবে চিনি। প্রায় এক বছরের বেশী হয়ে গেল দেখিনি।
৭১ সালে পাক হানাদাররা আব্বাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এই বলে সেলিনা আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
ওঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমিও খুব দুঃখ পেলাম। বললাম, মাফ করবেন, না জেনে আপনার মনে ব্যাথা দিলাম। সেলিনা কাঁদছিল। আমার তখন অনেক কথা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ব্যারিষ্টার সাহেব সেদিন দোকানে এসেই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের ম্যানেজার সাহেব কে?
একজন সহকর্মী আমাকে দেখিয়ে দেয়। আমি তখন একজন কাষ্টমারের বই মেমো করছিলাম। উনি আমার নিকটে এসে একটি লিষ্ট দিয়ে বললেন, দেখুন তো এই বইগুলো আপনার দোকানে আছে কিনা? কথাগুলো এমনভাবে বললেন, যেন আমি লিষ্ট দেখার উপযুক্ত না।
আমি লিষ্টটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, অর্ধেক বই আছে, আর বাকিগুলো অন্য লেখকের আছে। উনি সব বইগুলী দুইভাগে নামাতে বললেন। ওঁর কথামত বইগুলো কাউন্টারের উপর নামালাম। কাজটা করতে আমার দুতিন মিনিট লেগেছিল।
অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতদুর লেখাপড়া করেছেন?
বললাম, অল্পকিছু করেছি।
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, বিদেশ থেকে নতুন বই এলেই আমাকে অনুগ্রহ করে জানাবেন। সেই থেকে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। এইসব ভাবছিলাম, সেলিনার কথায় সম্বিত ফিরল।
ও তখন বলছে, আমি যখন প্রথম দিন আব্বার সঙ্গে আপনাদের দোকানে যাই তখন আপনাকে দেখেই প্রেমে পড়ি। কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তবে প্রেম কি জিনিস তখন আমি জানতাম না। শুধু আপনাকে দেখতে, আপনার কথা শুনতে খুব ভালো লাগত। সেই জন্য আব্বা যখনই মার্কেটে যেতেন, আমিও যেতাম! অনেক সময় আব্বা মার্কেট থেকে কাপড়-চোপড় কিনে যখন বাসায় ফিরতেন, সেই সময় আপনাকে দেখার জন্য মন খুব ছটফট করত। ঐ দিন যখন আপনি আমাকে চেয়ার দিয়ে বললেন, খুকী এখানে বস, তখন আমি চমকে উঠি। ভাবলাম, আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? কারণ, আমার ডাক নাম খুকী। সেদিন আমারও কয়েকটা বই কেনার দরকার ছিল। একটা লিষ্টও আপনার হাতে দিয়েছিলাম। লিস্ট দেখে আপনি বললেন, আমাদের দোকানে স্কুলের বই নেই। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। আব্বা তখন বললেন, খুকীকে একটা ভালো গল্পের বই দিন। আপনি মোসলেম পঞ্চসতী বইটি আব্বার হাতে দিয়ে বললেন, বইটি খুব ভালো। এতে। রিলিজিয়াস জ্ঞান অনেক আছে। আব্বা খুশি হয়ে বলেছিলেন, ছাত্র ছাত্রীদের এই রকম বই পড়া খুব দরকার। বইটা তখন আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাসায়। এসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যতই পড়তে লাগলাম ততই ভালো লাগল। মুসলমান নারীদের মধ্যে যে ঐ রকম আদর্শ চরিত্রবতী নারী ছিলেন, তা আমি এর পূর্বে কখনও শুনিনি। বইটি পড়ে ধর্মের অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয় এবং বুঝতে পারলাম আপনি ধার্মিক। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আম্মার সঙ্গে আমি ও আমার ছোট বোন জরিনা আপনার কাছে গল্পের বই কেনার জন্য গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছে আপনি আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেছেন। পরে সে ভুল। ধারণা আমার ভেঙে যায়। সব সময় আমি আপনার প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলাম। আপনি একবারও ভালো করে আমার দিকে তাকালেন না। তারপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে বই কেনার জন্য গিয়ে লিষ্টটা আপনার হাতে দিলাম! আপনি অন্য একজনকে লিষ্টটা দিয়ে বইগুলি দিতে বললেন। মেমো করে যখন টাকাটা আমার কাছ থেকে নিচ্ছিলেন তখন আমি ইচ্ছা করে আপনার হাতের সঙ্গে আমার হাত ঠেকিয়ে দিলাম। এই প্রথম আমার প্রেমিকের ছোঁয়া পেয়ে আমি শিহরিত হই। আপনার দিকে ভীরু চোখে তাকালাম। কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। এতক্ষণ কথা বলে সেলিনা চুপ করল।