প্রায় বছর দুই আগে একদিন ইউনির্ভাসিটির দুটি ছাত্রী বই কিনতে আসে। কথায় কথায় একজন হঠাৎ আমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করল। আমি আমার ঠিকানা বললাম। যাওয়ার সময় তাদের একজন কাগজে কিছু লিখে আমার হাতে দিয়ে বলল, ঠিকানা দিলাম, সময় করে একদিন বেড়াতে আসবেন।
কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখি, উনি জনৈক জর্জের মেয়ে, ঠিকানা ধানমন্ডি। ওরা চলে যাওয়ার পর কাগজটা হাতের মধ্যে গুলি পাকিয়ে ড্রেনে ফেলে দিই। চিন্তায় এমনই ডুবে ছিলাম যে, গাড়ি পৌঁছে কখন থেমে গেছে বুঝতে পারিনি। সেলিনা যখন গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, কই, নামুন তখন খেয়াল হল। দেখলাম, একটা চারতলা বিল্ডিং এর করিডোরে গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নামতে আমাকে উপরের তলায় নিয়ে গেল। সিঁড়ির মাথা থেকে গোটা বারান্দায় কার্পেট বিছান। পরপর চারটে দরজায় ভেলভেটের ভারি পর্দা। বারন্দার শেষ মাথায় দুটি দরজায় পর্দা নেই। উপরে উঠে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপে এগোচ্ছি। প্রথম দরজা পার হয়ে দ্বিতীয় দরজার কাছে এসে সেলিনা পর্দা সরিয়ে বলল, ভিতরে আসুন। ভিতরে ঢুকবো কিনা চিন্তা করে ইতস্ততঃ করছি দেখে সেলিনা আমার একটা হাত ধরে একেবারে খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার দুহাত ধরে একরকম জোর করে বসিয়ে দিয়ে বলল, একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।
আমাকে যে খাটে বসাল সেটা ডবল বেডের স্প্রীংএর তাতে খুব নরম গদী থাকায় আমার শরীরের কিছু অংশ দেবে গেল। মনে হল জীবনে এত নরম বিছানায় কোনোদিন বসিনি। ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সত্যিই এরা খুব বড়লোক। ঘরের মেঝেতেও কার্পেট বিছান। জানালা গুলোতে ভারী পর্দা ঝুলছে। একটা বুককেসও মেহগিনি কাঠের একটা বড় আলমারী রয়েছে। আলমারীর একটা পুরো পাল্লায় বেলজিয়াম গ্লাস। আমি যেখানে বসেছিলাম তার সোজাসুজি আলমারী থাকায় আয়নায় নিজের ছবি দেখতে পেলাম। আমার পোশাক দেখে এই পরিবেশের সঙ্গে বেমানান মনে হল। ড্রেসিংটেবিলের পাশে একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার দুপাশে দুটো চেয়ার রয়েছে। ভাবলাম, চেয়ারে না বসিয়ে খাটে বসাল কেন? চেয়ারে বসাই ভাল। এই মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেলাম, একজন মধ্যবয়স্কা সুন্দরী স্বাস্থবতী মহিলা পর্দা সরিয়ে আমার দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই বললেন, কে তুমি? এখানে কেন এসেছ? বেরিয়ে যাও। আবার যদি কোনো দিন আসতে দেখি, তাহলে পুলিশের হাতে তুলে দেব। স্কাউড্রেল, বদমাশ, জোচ্চোর, লোফার, শিঘ্রী বেরিয়ে যাও।
আমি লজ্জায়, ঘৃণায় ও অপমানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আর সেলিনার বোকামীর জন্য ওর উপর খুব রেগে গেলাম।
আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মহিলাটি আবার বললেন, যাবে? না পুলিশে ফোন করব?
আমি তখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। নিজেকে কঠোরভাবে সংযত করে বললাম, দেখুন, কাউকে সাজা দেওয়ার আগে সত্যি সে অপরাধী কিনা সেটা অনুসন্ধান করা এবং তাকে তার অপরাধ জানিয়ে দেওয়া উচিত।
স্টুপিড, আই সে গেট আডট, বলে ভদ্রমহিলা টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন।
থামুন, পুলিশ ডাকতে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি! এই কথা বলে যখন আমি দরজার কাছে এসেছি, সেই সময় সেলিনা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বলল, আপনি যাবেন না। তারপর ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মা, তুমি কাকে কি বলছ? আমি যে ওঁকে অনেক সাধ্য সাধনা করে এখানে এনেছি; আর তুমি অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছ?
আমি একটও অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে এগোলাম, তখনও সেলিনা বলছে, আম্মা, তুমি ওঁকে যেতে মানা কর, তোমার পায়ে পড়ি আম্মা। তুমি না ডাকলে উনি ফিরে আসবেন না। আমি ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এসে একজন রোগামতো বুড়োকে গাড়ি মুছতে দেখলাম।
গাড়ির কাছে পৌঁছেছি, তখন সেলিনা ছুটে এল। আমি বাধা দেওয়ার আগেই আমার একটা হাত ধরে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে জোর করে আমাকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে নিজেও উঠে আমার পাশে খুব ঘনিষ্ট হয়ে বসল। তারপর সেই বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদু, নিউমার্কেট চলুন।
আমি সরে বসে বললাম, আমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দেবেন।
সেলিনা তখনও কাঁদছিল। বলল, না দাদু, বরং রমনা রেস্টুরেন্টে চলুন। কথাটা শুনে খুব রেগে গিয়ে তার দিকে তাকালাম, তার করুণ অবস্থা দেখে রাগটা আপনা থেকেই কেন যেন পড়ে গেল। বললাম, আমাকে আপনার বেডরুমে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, ড্রইংরুমে বসাতে পারতেন।
আপনাকে কখনও আমি ড্রইংরুমে বসাতে পারব না! বিশ্বাস করুণ, আম্মা যে আপনার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
গাড়ি রমনা রেস্টুরেন্টের গেটে থামার পর আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় সেলিনা ড্রাইভারকে বলল, দাদু, আপনার কোনো কাজ থাকলে সেরে আসুন। আমার ফিরতে ঘন্টা দুই দেরি হবে। কেবিনে ঢুকে সেলিনা বেল টিপে বেয়ারাকে দুগ্লাস লস্যির অর্ডার দিল। দুতিন মিনিটের মধ্যে বেয়ারা লস্যি নিয়ে এলে তাকে বলল, আমারা এখানে ঘন্টা দুই পরে ডিনার খাব। এর মধ্যে তোমাকে আসতে হবে না। দরকার হলে বেল বাজাব, আর যাওয়ার সময় বখশিস পাবে।