পরদিন সকাল আটটায় সেলিনার কেবিনে গিয়ে দেখি, মামা এবং আরও দুতিনজন উকিল বসে আছেন। আমি আসবার তিন চার মিনিট পর জরিনা ও আম্মা এলেন। সেলিনা নীরবে সকলকে লক্ষ্য করছিল। আমি সেলিনার কাছে গিয়ে বললাম, মামা তোমার কথামতো উইল করে এনেছেন, তুমি সিগনেচার করার পর ওঁরা সাক্ষী হিসাবে সিগনেচার করবেন।
সেলিনা আমার দিকে তাকিয়ে উইলটা পড়তে বলল। মামা পড়তে লাগলেন
আমি (সেলিনা খানম), পিতা মরহুম মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঠিকানা……….. আমার মৃত্যুর পূর্বে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যাংকের সমস্ত টাকা স্বজ্ঞানে খুশীর সঙ্গে আমার স্বামী (…) কে স্বত্বাধিকারী করে গেলাম। ভবিষ্যতে আমার কোনো অংশীদার ঐসব সম্পত্তিতে কোনো রকম দাবি করলে আইনতঃ তাহা আগ্রাহ্য হবে।
এরপর মামা দ্বিতীয় ইউলটাও পড়লেন।
সব শুনে সেলিনা মৃদু হেসে বলল, পরের উইলটা যে তুমি এভাবে করবে, তা আমি জানতাম। তবে টাকাটা তুমি নিজে ভোগ করলে, আমি বেশি শান্তি পেতাম।
আমি বললাম, তুমি নিজের দিকটা শুধু দেখলে, আমার দিকটা দেখবে না?
কয়েক সেকেণ্ড সেলিনা কি যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, তোমার মতই আমার মত। তারপর মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি সিগনেসার করতে পারব না। আপনি আমার হয়ে করে দিন।
তার সম্মতি পাওয়ার পর আমরা সকলে সিগনেচার করলাম।
কিছুক্ষণ পর সেলিনা মামাদের চলে যেতে বলল। ওরা চলে যাওয়ার পর আম্মাকে ডেকে বলল, আমি তোমার অবাধ্য মেয়ে। তোমার কথা না শুনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। জীবিত কালে মাফ না করলেও আমার মরণের পর তুমি আমাকে মাফ করে দিও। পারলে তোমার জামাইকেও মাফ করে দিও। ওর কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার। তারপর জরিনার দিকে চেয়ে বলল, তুই যেন আমার মতো আম্মার মতের বিরুদ্ধে কিছু করে তার মনে কষ্ট দিসনি।
তখন সকলের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।
আমার শাশুড়ী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। একটু সামলে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি তোদেরকে মাফ করে দিয়েছি মা। তোদের দুজনকে বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি, তোরা আমাকে মাফ করে দে।
সেলিনার মুখে বিজয়িনীর মতো হাসি ফুটে উঠল। আমাকে বলল, তুমি আমার হয়ে মাকে কদমবুসি কর।
আমি ওঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উনি মাথায় ও চিবুকে হাত বুলিয়ে ভিজে গলায় বললেন, থাক বাবা থাক, আমাকে আর বেশি অপরাধী কর না, এমনিতেই এতদিন তোমাদের প্রতি যা অন্যায় করেছি, তা যেন আল্লাহ মাফ করেন।
সেলিনা আমাকে ডেকে বলল, আজ তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। শুধু আপামণি ও ছেলেমেয়েদেরকে এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে এস। শেষ বারের মতো আপামণির সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই।
আমার মনে হল ও বুঝি আর বাচবে না। আম্মা ও জরিনাকে তার কাছে থাকতে বলে বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি করে সবাইকে নিয়ে এসে দেখলাম, আম্মা ও জরিনা তার দুপাশে বসে আছে, সেলিনার চোখ বন্ধ।
আমি বললাম, তোমার আপামণি এসেছে।
জরিনা সরে বসলে আমার স্ত্রী সেলিনার কাছে বসল।
সেলিনা চোখ খুলে প্রথমে সকলকে দেখল, তারপর আমার স্ত্রীর একটা হাত ধরে বলল, আপামণি, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রাখলে। এই ঋণ শোধ করার সুযোগ আমাকে আল্লাহপাক দিলেন না। যদি ইসলামে জায়েজ থাকত, তাহলে মরণের পর আমার গায়ের চামড়া দিয়ে তোমার জুতো তৈরি করে দিতে ওসিয়ত করতাম। আমি তোমার কাছে অনেক বড় অন্যায় করেছি। যা কোনো মেয়ে অন্য মেয়েকে ক্ষমা করতে পারে না। তোমার স্বামীকে এ ব্যাপারে কোনোদিন কোনো কিছু বলো না। উনি মানুষ হয়েও ফেরেস্তার মত চরিত্রবান। আমি ওঁকে প্রেমের যাদু দ্বারা পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছি। অনেকবার বহু অনুনয় বিনয় করেছি তোমার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য। শুধু তোমার মনে কষ্ট হবে বলে উনি রাজি হননি। তুমি ওঁর সমস্ত অন্তর জুড়ে রয়েছে। অনেক কষ্টে দুবছর ধরে চেষ্টা করে আমি সেখানে একটু জায়গা করতে পেরেছি। তাতেই আমি বুঝেছি, কত গভীরভাবে উনি তোমাকে ভালবাসেন। এত কথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।
আমি বললাম, তুমি এখন চুপ কর, বেশি কথা বললে তোমার বিপদ হবে।
সেলিনা হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, কথাগুলো আমাকে শেষ করতেই হবে। সারাজীবন তোমার কোনো হুকুম অমান্য করিনি। যাওয়ার সময় তুমি কোনো হুকুম করো না। তারপর তার আপামণির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, শেষকালে অনেক জীদ করে শুধু একটিবার তোমাদেরকে দেখতে চেয়েছিলাম। তাই সেদিন। পার্কে তোমাদেরকে রেখে উনি বাইরে গিয়েছিলেন। তারপর যা কিছু ঘটেছে তা আমি নিজে করেছি। উনি এসবের কিছুই জানতেন না। আপামণি, এসব কথা শুনে তুমি খুব দুঃখ পাচ্ছ, কোনোদিন কথাগুলো হয়তো তুমি জানতেও পারতে না, তোমার কাছে মাফ না চেয়ে মরতে পারছি না, তাই বললাম।
এমন সময় নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, আপনারা কি পেসেন্টকে মেরে ফেলতে চান? যান, সবাই চলে যান। ওঁর এখন কথা বলা একদম নিষেধ।
সেলিনা নার্সকে ধমকের সুরে বলল, সিস্টার, আপনি থামুন, আমাকে বলতে দিন। তা না হলে বলার আর সময় পাব না। তারপর তার আপামণিকে বলল, তুমি তো আমাকে ছোট বোন বলে গ্রহণ করেছ? ছোট বোনের এই অন্যায়টা কি মাফ করে দেবে না? আমি তোমার দুটি পায়ে ধরে বলছি, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। চুপ করে আছ কেন? সহসা মাথাটা একটু তুলেই লা-ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ বলে কাৎ হয়ে গেল।