ওর সব কিছু শুনে আমার খুব মায়া হল। বললাম, আমারও কোনো বোন নেই। আপনি আমার ছোট বোন হলে আমিও খুব খুশী হব।
সেলিনা আমার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে বলল, সত্যি বলছেন?
আমি বললাম সত্যি বলছি।
তখন সেলিনা আবার বলল, তাহলে আমরা আর আপনি করে সম্বোধন করব। ওটাতে দূরের সম্পর্ক বোঝায়। এখন থেকে তুমি আমার নাম ধরে ডাকাবে। আর আমি তোমাকে আপামনি বলে ডাকব।
সেলিনার কথায় যেন যাদু আছে। তার সরল ব্যবহারে আমি খুশী হয়ে বললাম, তাই হবে।
তাহলে চল সম্পর্কটা পাকা করে ফেলি।
কোথায় আবার যাব? আমার স্বামী এক্ষুনি এসে আমাদের খোঁজ করবেন।
সে ব্যবস্থা আমি করছি বলে ড্রাইভারকে ডেকে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, আজ থেকে আপনার আর একটা বোন বাড়ল। সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করার জন্য আমি সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি এখানে বসুন। লক্ষ্য রাখবেন, একজন ভদ্রলোক এসে এদের খোঁজ করলে সব কথা বলে এখানে বসিয়ে গল্প করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ফিরে আসব। তারপর সায়ফুল্লাহকে বুকে তুলে আমাদের সবাইকে নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিউমার্কেটে এসে প্রথমে মিষ্টি খাওয়াল। তারপর সকলের জন্য কাপড় ও মিষ্টি কিনে পার্কে নিয়ে এল। তার পরের ঘটনা তুমি তো জান।
আমি বললাম, যাই হোক, কাপড় নেওয়া তোমার উচিত হয় নি।
আমার স্ত্রী বলল, আমি অনেক আপত্তি করেছি। কিন্তু সেলিনা শুনেনি। বলল, আমি তোমর ছোট বোন। আপামণিদের ছোট বোনদের অনেক অন্যায় আবদার সহ্য করতে হয়। এই সব করে যদি আমি একটু শান্তি পাই, তাতে তুমি বাধা দিও না আপা। এই কথা বলে চোখ মুছল। এত সামান্য কথাতে তার চোখে পানি দেখে মেয়েটাকে সত্যিই খুব দুঃখী মনে হওয়ায় আর আপত্তি করতে পরিনি।
.
এই ঘটনার পর সেলিনা প্রায় বলত, আবার কবে তোমার বাসায় যাব অথবা তাদেরকে আমাদের বাসায় করে নিয়ে আসবে? এখন নয় পরে বলে আমি কাটিয়ে দিতাম।
চাকরি ছেড়ে ব্যাবসা আরম্ভ করার পর কমলাপুরে বাসা ভাড়া নিই। সেলিনাকে বাসার কাছে একজন ডাক্তারের ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলাম, দরকার হলে এই নাম্বারে ফোন করবে। ডাক্তার সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন দাদুও সেলিনাকে নিয়ে এসে ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম, কোনো ইমারজেন্সী খবর থাকলে ফোনে অথবা দাদু এসে ডাক্তারকে জানাবেন। ডাক্তার আমারও সেলিনার ব্যাপাটা আগের থেকে জানতেন।
ব্যাবসার কাজে চিঠি পেয়ে হঠাৎ করে আমাকে সিলেট যেতে হয়। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হয়েছিল। সেলিনার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারিনি। তবে ফোনে সে কথা জানিয়ে ছিলাম। যেদিন ফিরে আসি, সেদিন রাত্রি আটটায় ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হতে বললেন, ড্রাইভার গত পরশু এসেছিল। সেলিনা ভাবি এ্যাকসিডেন্ট করে মেডিকেলে আছে। অবস্থা খুব খারাপ। আমি গতকাল গিয়ে দেখে এসেছি। এই নিন ওয়ার্ড ও বেড নাম্বার।
সংবাদটা আমাকে বিদ্যুৎ পৃষ্টের মত সর্ট করল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।
ডাক্তার আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আল্লাহপাকের রহমতে ভাবি ভালো হয়ে যাবেন। নিন ধরুন বলে ঠিকানা লেখা কাগজটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।
আমি কাগজটা নিয়ে লুংগি ও পাঞ্জাবীপরা অবস্থায় একটা রিক্সায় উঠে মেডিকেলে গিয়ে পৌঁলাম। স্পেশাল পাশ বের করে সেলিনার ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম, শুধু নাক, মুখ ও হাত ছাড়া তার সমস্ত শরীর ও মাথা প্লাষ্টার করা। তখনও জ্ঞান ফিরেনি। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল।
বেডের পাশে জরিনা ও আম্মা ছিল। জরিনা আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলে বলল, আপা গত পরশু এ্যাকসিডেন্ট করেছে। আজ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরেনি। প্রচুর রক্ত গেছে। আপাকে বাচাতে হলে আরো অনেক রক্তের দরকার। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। মাত্র দুবোতল পাওয়া গেছে। ডাক্তার বলেছে কালকের মধ্যে রক্ত জোগাড় না হলে আপাকে বাঁচান যাবে না।
আমি রুমালে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, এ্যাকসিডেন্ট হল কি করে?
জরিনা বলল, আমি ও আম্মা গাড়ি নিয়ে গুলশান গিয়েছিলাম। আপা বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ ফোন পেলাম আমাদের আয়া বলছে, মেডিকেল থেকে ফোন এসেছে আপা এ্যাকসিডেন্ড করে সেখানে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে ইমারজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে আপার কাছে আসি? ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম, মালিবাগের মোড়ে একটা ট্রাক, আপা যে রিক্সায় ছিল সেটাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। আপা রিক্সা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর একটা প্রাইভেট কার আপার উপর দিয়ে চলে যায়। এইসব কথা ডাক্তার রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে শুনেছেন। তাকেও মেডিকেলে আনা হয়েছিল। সে অল্প আঘাত পাওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আজ কেবিনের ব্যবস্থা করা গেছে। আপাকে এক্ষুনি কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার সেই ব্যবস্থা করতে গেছেন।
এমন সময় একজন ডাক্তার দুজন নার্সসহ এসে ট্রলিতে করে সেলিনাকে কেবিনে নিয়ে গেল।
আমি ডাক্তারকে পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা রক্ত পাব কোথায়? তার চেয়ে আমার রক্ত টেষ্ট করে দেখুন, চলবে কি না?
ডাক্তার যখন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখন জরিনা ও আম্মা আমাদের সাথে এল। যেতে যেতে আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম সেলিনা বাচবে তো?