আমি কোনো রকমে ওয়া আলায়কুম আসসালাম বলে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম।
আমার অবস্থা দেখে সেলিনা ড্রাইভার দাদুকে বলল, আপনি ওঁকে সব কিছু খুলে বলেন নি?
হাসি চেপে রেখে দাদু গাম্ভির্যের সঙ্গে বললেন, বলেছি তো?
প্রথমটা আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও দাদুর উত্তর শুনে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি আপনাদের সম্পর্কের কথা বলেছেন। এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আজ তা হলে আসি?
সেলিনা বলল, দাদু, চলুন আপামনিদের বাসায় গিয়ে মেহমানি করে আসি।
তার কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, ওদেরকে পেয়ে একট বাড়াবাড়ি করবে। কিন্তু বাসায় যেতে চাইবে এতটা ধারণা করিনি। খুব ভয় হতে লাগল। যদি বেতালে কিছু করে বসে, তাহলে সামাল দেওয়া মুস্কিল হয়ে পড়বে।
আমাকে চিন্তিত দেখে সেলিনা বলে উঠল, কি দুলাভাই, আমি আপনাদের বাসায় যেতে চাইলাম, আর আপনি চুপ করে আছেন। ভয় পেলেন নাকি?
আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, এটা তো খুব আনন্দের কথা। ছোট বোন বড় বোনের বাসায় যাবে তাতে দুলাভাই ভয় পাবে কেন? বরং খুশীই হবে! তারপর সবাই গাড়িতে করে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় এসে মাগরিবের নামায পড়ে আমাদের পোষা মোরগটা জবাই করে স্ত্রীকে বললাম, বিরানী রান্না কর।
সেলিনা কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, না আপা, বিরানী খেতে ভালো লাগে না। তুমি বরং জর্দা পোলাও আর গোস্ত আলাদা রান্না কর। এখন থেকে বলে রাখছি, এবার থেকে মাঝে মাঝে আমি আসব। কিন্তু আমার জন্য আলাদা কিছু রান্না। করতে পারবে না, যা হবে তাই খাব। যদি কিছু কর, তবে না খেয়েই চলে যাব।
আমার স্ত্রী বলল, ঠিক আছে ভাই, তাই হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত দশটায় বিদায় নেওয়ার সময় সেলিনা বলল, আজ আমি আমার ঠিকানা দিয়ে গেলাম না। একদিন এসে সবাইকে নিয়ে যাব।
আমার স্ত্রী বলল, এবার আসার সময় দুলামিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
আচ্ছা বলে সালাম দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে সেলিনা গাড়িতে উঠল।
ওরা চলে যাওয়ার পর আমি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার বলত? অমন বড়লোক বোন জোগাড় করলে কি করে?
সে এক আশ্চর্য ঘটনা।
কি আশ্চর্য ঘটনা খুলেই বল না; মেয়েটার ব্যবহার দেখে মনে হল সত্যিই তোমরা যেন মায়ের পেটের বোন।
ঘটনাটা পুরো বলছি শোন
আমাদেরকে পার্কে রেখে তুমি চলে যাওয়ার পর আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাদাম খাচ্ছিলাম। এই মেয়েটাকে ঐ ড্রাইভারের সঙ্গে কিছু দূরে লেকের ধারে বসে গল্প করতে দেখলাম। একটু পরে মেয়েটা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এসে আমাকে সালাম দিয়ে আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল?
আমি সালামের জওয়াব দিয়ে বললাম, আপনাকে তো চিনতে পারছি না বোন?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সায়ফুল্লাকে কোলে নিয়ে খুব আদর করল। তারপর সব ছেলেমেয়েদের হাতে টফি দিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, এই হতভাগীকে চিনে আর কি করবেন? তবে আপনি যখন আমাকে বোন বলে ডেকেছেন, যদি বিরক্ত না হন তাহলে পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
ওকে দেখে খুব বড় লোকের বৌ বলে মনে হয়েছিল। বললাম বিরক্ত হব কেন? বসুন।
মেয়েটা আমার পাশে বসে বলল, আমার নাম সেলিনা খানম। ঠিক আপনার মতো আমারও একটা আপা আছে। কিন্তু আমার এমনই দুর্ভাগ্য যে, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। কারণ আমি ভালবাসা করে বিয়ে করেছি বলে আমার সব আত্মীয় স্বজন আমাকে দেখতে পারে না। এমন কি আম্মা পর্যন্ত কোনো খোঁজ খবর নেয় না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার আব্বাও কি কোনো খবর নেন না?
উনি আমার বিয়ের আগে মারা গেছেন।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্বামী কি করেন? কোথায় থাকেন? আর ঐ বুড়ো লোকটাই বা কে?
আমার স্বামী ব্যবসা করেন। উনি ঢাকাতেই থাকেন! বুড়ো লোকটা আব্বার দূর সম্পর্কের চাচা হন। আমরা দাদু বলে ডাকি। উনি আমাদের গাড়ি চালান আর গার্জেনের মতো দেখাশোনা করেন।
আপনি স্বামীর বাড়িতে থাকেন না?
আমার স্বামী দ্বিতীয়বার আমাকে বিয়ে করছেন। উনি প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন। তার মনে কষ্ট হবে বলে আমাকে নিয়ে যান না। আমি আমার মায়ের। কাছেই থাকি।
সেলিনাকে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ছেলেমেয়েদেরকে খুব আদর করতে দেখে বললাম, কতদিন আপনাদের বিয়ে হয়েছে? ছেলে মেয়ে হয় নি?
সেলিনা কিছুক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে চোখের পানি মুছে বলল, আমি সে ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি আপা। আজ প্রায় পাঁচ বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। এতদিনে যখন আমার ছেলেমেয়ে হল না। তখন আমার স্বামী মেডিকেলে চেক-আপ করিয়েছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, আমার সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই। তারপর সায়ফুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহপাক যদি শুধু এই রকম একটা ছেলে আমাকে দিত, তাহলে মেয়ে জনম সার্থক হত। আমি জীবনে কোনোদিন মা ডাক শুনতে পাব না মনে হলে বুক ফেটে যায় বলে ঝর ঝুর করে কেঁদে ফেলল।
তার কথা শুনে আমার খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, ওরা কত বড় লোক, আর মেয়েটা দেখতেও সুন্দরী। কিন্তু সন্তান না হওয়ায় কত অশান্তিতে আছে। তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম, কি করবেন বোন? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তাঁর মর্জি ছাড়া কোনো কিছু হয় না।
সেলিনা লেকের পানিতে চোখ মুখ ধুয়ে এসে বলল, আপনি যদি ছোট বোন বলে স্বীকৃতি দেন, তাহলে আমি আপনাকে এখন থেকে আপামণি বলে ডাকব। আর আপনার সঙ্গে নিজের বড় বোনের মত কুটুম্বীত করব।