নিশ্চয় বলে সেলিনা প্রথমে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইল। তারপর দুহাতে আমার মুখ ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
.
১৯৭৬ সালে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসা আরম্ভ করি। ব্যাবসার কাজে বাংলাদেশের সব জেলাতে আমাকে ঘুরতে হয়েছে। ঢাকাতে মাসের মধ্যে বড় জোর আট দশ দিন থাকতাম। সেলিনাও প্রায় সব সময় আমার সঙ্গে ট্রেনে, বাসে অথবা, প্লেনে করে গিয়েছে। যাবতীয় খরচ সেলিনাই বহন করত। আমার টাকা মোটেই খরচ করতে দিত না। যেখানে যা পছন্দ হয়েছে নিজের জন্য, আমার জন্য, তার আপামনি ও ছেলেমেয়েদের জন্য কিনেছে। আমি অনেকবার এতবেশি খরচ করতে নিষেধ করেছি। কিন্তু সে কোনো কথা শুনত না। বলত,খরচ করে একটু আনন্দ পাই, তাতে তুমি বাধা দিও না। তার মনে ব্যথা লাগবে ভেবে পরে আমি আর কিছু বলতাম না। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি যে আমার সঙ্গে ঢাকার বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আম্মা কিছু বলেন না?
সেলিনা বলল, আসবার সময় শুধু আম্মাকে বলে আসি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। বিয়ের পর থেকে আম্মা আমার কোনো খবর বড় একটা রাখে না। জরিনাকেও আমার সঙ্গে কোথাও যেতে দেয় না।
সে জন্য তুমি মন খারাপ কর না। তোমার তো খোঁজ খবর নেওয়ার একজন লোক হয়েছে, তাই প্রয়োজন বোধ করেন না।
ব্যাবসা আরম্ভ করার পর, বছর খানেক বেশ কাটল। একদিন চট্টগ্রামে সফিনা হোটেলে তাকে রেখে ব্যাবসার কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দরজায় নক করতে খুলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেলিনা ফুঁপিয়ে উঠল।
আমি তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?
সেলিনা বলল, পাশের রুমে স্বস্ত্রীক একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তাদের সঙ্গে কি সুন্দর একটা তিনচার বছরের ছেলে রয়েছে। ছেলেটা যখন তার মাকে আম্মা বলে ডাকছিল তখন থেকে ঐ ডাক শোনার জন্য আমার মন ভীষণ উতলা হয়েছে। কিছু ভালো লাগছে না। চল অন্য কোনো হোটেলে যাই।
বললাম, বেশ তো এক্ষুনি সে ব্যবস্থা করছি। তারপর আমরা অন্য হোটেলে গিয়ে উঠলাম।
চট্টগ্রাম থেকে ফেরার কয়েকদিন পর সেলিনা বলল, তুমি বুদ্ধি করে কিছু একটা উপায় বের কর। যেভাবে হোক আমি আপামনি ও ছেলেমেয়েদের একবার দেখব।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, তাদের সবাইকে নিয়ে এক দিন আমি পার্কে বেড়াতে যাব। তুমি লেকের ধারে সেই জায়গায় থাকবে। কিন্তু একটা কথা খুব খেয়াল রাখবে, এমন কথা বা এমন ব্যবহার আমার সঙ্গে করবে না, যাতে করে তোমার আপামনি বুঝতে পারে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কারণ তোমার আপামনি ভীষণ চালাক।
সেলিনা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা কিস দিয়ে বলল, তোমার বুদ্ধির তারিফ করার ভাষা আমার নেই। তোমাকে আর বেশি কিছু বলতে হবে না। তুমি তোমার কর্তব্য ঠিক করবে আর আমার দিকটা আমি দেখব। তবে তুমি যদি তাদেরকে পৌঁছে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সেখান থেকে চলে যাও, তাহলে খুব ভালো হয়।
আমিও তাকে আদর করে বললাম, সে দেখা যাবে।
সপ্তাহ খানেক পরে সেলিনার সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করে আমি স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে রমনা পার্কে একদিন বেড়াতে গেলাম। আমার বড় ছেলের বয়স তখন আট, মেয়ের পাঁচ, আর ছোট ছেলের দেড় বছর। বেড়াতে বেড়াতে নির্দিষ্ট জায়গার কাছাকাছি একটা ঢালাই করা বেঞ্চে সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। তারপর বাদাম ভাজা কিনে এনে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললাম, তুমি ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাদাম খাও, আমি গেট থেকে একটু আসছি। এক বন্ধু ঠিক এই সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটে আসবে বলে কথা দিয়েছে। বেশি দেরি করব না।
আমার স্ত্রী বলল, শিঘ্রী ফিরো কিন্তু। তুমি তো আবার বন্ধু পেলে দুনিয়ার সব কিছু ভুলে যাও।
ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখতে বলে আমি গেটের দিকে গিয়ে ঘুরে এসে কিছুটা দূরে আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য রাখলাম।
সেলিনা লেকের ধারে নির্দিষ্ট জায়গায় আগের থেকে ড্রাইভার দাদুর সঙ্গে বসে গল্প করছিল। আমি চলে আসার দুতিন মিনিট পর উঠে গিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছেলেমেয়েদের হাতে কি যেন দিল, আর ওদের খুব আদর করল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর ড্রাইভার দাদুকে ডেকে বেঞ্চে বসিয়ে তাকে কিছু বলে সবাইকে নিয়ে গেটের দিকে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি দাদুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? সব গেল কোথায়?
দাদু বললেন, দুজনে বোন সম্পর্ক পাতিয়েছে। সম্পর্কটা পাকা করার জন্য কোথায় যেন গেল। আপনাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছে। আচ্ছা দুলাভাই, ইনিই বুঝি বড় আপা?
বললাম, ঠিক বলেছেন।
দাদু আবার বলেন, প্রথম দিকে আপনার উপর আমার খুব রাগ ছিল। কিন্তু যতই আপনাকে দেখছি ততই আমিও ভালবেসে ফেলছি। বড় আপা কি এ সব বিষয় কিছুই জানেন না?
না দাদু, জানলে আমরা তিনজনে অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাব। তাই প্রতিজ্ঞা করেছি, সারা জীবন তার কাছে গোপন রাখব। শুধু আপনার খুকি ভাইকে বড় ভয় হয়। কি জানি আনন্দের মধ্যে যদি কিছু বলে বা করে বসে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রায় একঘন্টা পর তারা ফিরে এল। দেখলাম, সেলিনার হাতে কাপড়ের ও মিষ্টির বাক্স। এসেই সেলিনা আমাকে আস-সালামু আলায়কুম দিয়ে বলল, কি দুলা ভাই, কেমন আছেন?