মেয়েটিকে দেখে তার নাম ও চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। আর তার স্পর্ধার বহর দেখে রাগে চোয়ালটা আপনা হতেই শক্ত হয়ে উঠল। তথাপি নিজেকে সংযত করে সৌজন্য রক্ষা করার জন্য বললাম, আমার এখন সময় নেই।
মিনতি ভরা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আপনার বেশি সময় নষ্ট করব না। দয়া করে যদি আসেন, তাহলে দুএকটা কথা বলেই ছেড়ে দেব।
আমাকে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অন্যান্য দোকানের পরিচিত কয়েকজন সেলসম্যান আমাদেরকে বিশেষ ভাবে যে লক্ষ্য করছে, তা আমি এদিক ওদিক তাকাতেই বুঝতে পারলাম। বললাম, ঠিক আছে চলুন।
সেলিনা আমাকে নভেল ড্রিংক রেষ্টুরেণ্টের দোতলার একটি কেবিনে বসিয়ে বলল, কি খাবেন? ঠান্ডা না গরম?
কোনো কিছুই এখন আমি খাব না, যে জন্য ডেকেছেন বলুন।
আপনি যদি কিছু না খান, তবে ভাববো আমার উপর খুব রেগে আছেন।
বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠান্ডা।
তাহলে আপনিই অর্ডার দিন।
যদিও তখন শীতকাল তবু বেয়ারাকে ডেকে রাগের চোটে চারটে ঈগলু দিতে বললাম। বেয়ারা চলে যেতে ওকে বললাম, আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।
আপনি যেভাবে রেগে আছেন, তাতে কিছু বলতে সাহস হচ্ছে না।
তাহলে বলার দরকার নেই, চললাম। দয়া করে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করবেন না। এই কথা বলে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
তখন সেলিনাও দাঁড়িয়ে আমার একটা হাত খপ করে ধরে বলল, প্লীজ, যাবেন না। একটু বসুন।
আহ, কি করছেন, হাত ছাড়ুন। সেলিনা লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে দিতে আমি বসলাম। এমন সময় বেয়ারা দুটো ঈগলু টেবিলের উপর রাখল। তাকে বললাম, তুমি কেমন মেসিয়ার? অর্ডার দিলাম চারটে, আর দিলে দুটো। অথচ অন্যেরা খদ্দেরকে বেশি খাওয়াবার চেষ্টা করে।
বেয়ারা কিছু বলার আগেই সেলিনা বলল, আমরা যখন এখানে আসি তখন দোকানের মালিক দেখেছেন। উনি জানেন আমি ঈগলু খাইনা। তবু যখন আমার কাছ থেকে অর্ডার গেছে তখন কম করে দিয়েছেন।
বুঝতে পারলাম দোকানের মালিকের সাথে সেলিনার ঘনিষ্ঠতা আছে। বললাম, আপনি ঈগলু না খেয়ে অন্য কিছু খান।
আগে কখনো না খেলেও এবার থেকে খাব বলে সেলিনা খেতে আরম্ভ করল। তারপর বলল, আজ তো আপনার সময় নেই। তাই আপনাকে আগামী ছুটির দিন কিংবা যেদিন আপনার সময় হবে সেদিন আমার সংগে এক জায়গায় যেতে হবে। বিশেষ জরুরী কিছু কথা আমি আপনাকে বলতে চাই। গত ঐ ছুটির দিন আমি সকাল আটটা থেকে বেলা বারটা পর্যন্ত আপনার জন্য মার্কেটের গেটে অপেক্ষা করেছিলাম।
কথাটা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যে আসবো সেটা আপনি ভাবলেন কি করে? একজন অপরিচতি লোককে একটা চিঠি লিখে আসতে বললেই সে যে আসবে, সেটাই বা বিশ্বাস করলেন কেমন করে?
জানি না, তবে আমার বিশ্বাস ছিল আপনি আসবেন। আর আমি আপনার কাছে অপরিচিতা হলেও আপনাকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি।
সেলিনার উত্তর শুনে আরও অবাক হয়ে বললাম, কি কথা। এখানে বলা যাবে না?
সে অনেক কথা, এখানে অত কথা বলা সম্ভব নয়।
একটু চিন্তা করে বললাম, একটা শর্তে যেতে রাজি আছি।
একটা কেন, যদি শত শর্ত দেন, সবগুলো মানতে রাজি।
আপনি এরপর ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আর কোনো রকম যোগাযোগ করবেন না।
ভবিষ্যতের কথা আল্লাহপাক জানেন, তবে আপনার শর্ত মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করব।
আগামী ছুটির দিন বেলা নটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসব বলে দোকানের মালিকের নিকট বিল দেওয়ার জন্য গেলাম। উনি বললেন, বিল আগাম দেওয়া আছে। চলে আসার জন্য ঘুরে দেখি, সেলিনা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সঙ্গে কোনো কথা না বলে দোকানে চলে আসি।
.
ছুটির দিন বেলা নটায় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি, সেলিনা একটা প্রাইভেট কারের ডাইভিং সিটে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়িটার নাম কার্ডিলাক। সবুজ রং এর সুন্দর গাড়িটা খুব দামী বলে মনে হল।
আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিয়ে বলল, আপনি রাইট টাইমে এসেছেন। এ দিন সে প্রথম আমাকে সালাম দেয়।
আমি সালামের জওয়াব দিয়ে বললাম, মানি, টাইম এন্ড ক্যারেক্টার এই তিনটি জিনিষ খুব মূল্যবান। মনিষিরা বলেন, মানি ইজ লষ্ট, নাথিং ইজ লষ্ট; টাইম ইজ লষ্ট, সামথিং ইজ লষ্ট; বাট ক্যারেক্টার ইজ লষ্ট, এভরীথিং ইজ লষ্ট। আর ইসলামের আইন অনুযায়ী এই গুলি অমূল্য রতনচরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই ইসলামী জিন্দেগীর সারকথা। প্রত্যেক মানুষের উচিত, এই তিনটি জিনিসের মর্যাদা দেওয়া। যদি পৃথিবীর মানুষ এইগুলির অপব্যবহার না করত, তাহলে তাদেরকে কোনো অশান্তির আগুন স্পর্শ করতে পারত না।
সেলিনা মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনল, তারপর আসুন বলে নিজে ড্রাইভিং সীটে বসে পাশের গেট খুলে দিয়ে আমাকে বসতে বলল।
বললাম, আমি পিছনের সীটে বসব।
কক্ষনো না, আপনাকে সামনের সীটে বসতেই হবে।
তার কথার জোর দেখে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলাম, তারপর আর কিছু না বলে মাঝখানে বেশ ব্যবধান রেখে বসে পড়লাম।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, আপনি স্বচ্ছন্দে সিগারেট খেতে পারেন। তাতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না।
বেশ অবাক হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবলাম, মেয়েটা অন্তর্যামী না কি? কারণ সত্যিই ঐ সময় আমার সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। হঠাৎ চিন্তা হল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে আর কি কথাই বা বলবে? গাড়ি, পোশাক পরিচ্ছদ ও চাল-চলন দেখে মনে হচ্ছে খুব বড় লোকের মেয়ে। বন্ধুদের কাছে বড়লোকের মেয়েদের অনেক খামখেয়ালীর গল্প শুনেছি। তখন আর একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ল।