আমি না পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের কাগজ?
সেলিনা বলল, উইল মোতাবেক গতকাল থেকে আমি ব্যাংকের টাকার স্বত্বাধিকারী হয়েছি। আমি যখন তোমার, তখন আমার সবকিছুও তোমার। এই সিগনেচার ব্যাংকে যাবে। দরকার মতো তুমিও টাকা তুলতে পারবে। আর যদি দয়া করে অনুমতি দাও, তাহলে সমস্ত টাকা তোমার একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেব, তুমি যা বলবে তাই হবে।
তার কথাগুলো শুনে মনে হল, কেউ যেন সীসা গরম করে আমার কানে ঢেলে দিল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বালা করে উঠল। আমি ভীষণ রেগে গেলাম। রেগে গেলে সাধারণতঃ আমার কোনো হুঁশ থাকে না। কিন্তু কেন কি জানি, ঐদিন আমি হুঁশ হারাইনি। শুধু সেলিনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।
আমার অবস্থা দেখে সেলিনা খুব ভয় পেয়ে ছল ছল নয়নে আমার পায়ের কাছে বসে পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। আমার কথা শুনে তুমি এত বিচলিত হয়ে পড়বে জানলে কখনও বলতাম না। উম্মুল মোমেনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) বাসর রাত্রে তাঁর বিপুল ধনরাশী স্বামী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই কথা ভেবে আমি বলেছি।
সেলিনার প্রেমের ও জ্ঞানের গভীরতা বুঝতে পেরে কে যেন আমার রাগের আগুনে পানি ঢেলে দিল। আমি তাকে তুলে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমার প্রেম সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিল। আমি আমার এই দুর্ব্যবহারের জন্য মাফ চাইছি।
সেলিনা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, এভাবে বল না, আমি যে গোনাহগার হব।
না, এতে মোতার গোনাহ হবে না, আমারই ভুল হয়েছে। যাক, তুমি কিন্তু জীবনে আর কখনো এই টাকা নেওয়ার জন্য বলবে না। এটা ছাড়া তুমি যা বলবে, প্রাণ দিয়ে হলেও তা রক্ষা করব। তুমি প্রেমের জোরে আমাকে বিয়ে করেছ। আমিও তোমাকে প্রেমিকার আসনে বসিয়ে বিয়ে করেছি। টাকার কথা তুলে আমাদের পবিত্র প্রেমকে কলঙ্কিত করো না। যদি আর কখনো তোল, তাহলে খুব মর্মাহত হব। মা খাদিজার (রাঃ) কথা যে বললে, তিনি সব কিছু বিলিয়ে দেওয়ার মতো উপযুক্ত স্বামী পেয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো মানুষের তুলনা করা উচিত নয়। তোমার সবকিছু গ্রহণ করার যোগ্যতা আমার নেই। মাঝে মাঝে মনে বড় ভয় হয়, তোমার এত গভীর প্রেমের ভার কতদিন আমি সহ্য করতে পারব? তার উপর যদি তোমার সবকিছু আমাকে দিয়ে দাও, তাহলে হয়তো আমি পাগল হয়ে যাব।
কান্নাভেজা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আর কখনও এই কথা বলব না। তবে স্বাধীনভাবে এই টাকা খরচ করার অনুমতি তুমি আমাকে দাও।
বললাম, তোমার টাকা তুমি খরচ করবে, তাতে আমি কোনো দিন বাধা দেব না। কথাটা চিন্তা না করে বলেছিলাম। তাই পরবর্তী কালে যখন ও আমার পিছনে টাকাগুলো পানির মত খরচ করত তখন যদি বলতাম, শুধু শুধু আমার পিছনে এতটাকা খরচ করছ কেন? আমাকেও তোমার পিছনে কিছু খরচ করতে দাও তখন সেলিনা কুপিতভাবে লত, তুমিই তো আমাকে খরচ করার অনুমতি দিয়েছ। আর তোমার টাকা আপামনি ও ছেলেমেয়েদের জন্য খরচ করলে আমি বেশি খুশী হব। এমন সময় ড্রইংরুমের ঘড়িতে রাত বারটা ঘোষণা করল।
সেলিনা কাগজপত্রগুলো তুলে রেখে আমার কাছে এসে বলর, ঘুমাবে না?
না, আজ ঘুম নয়, শুধু আনন্দ। কি রাজি তো?
লজ্জায় সেলিনা দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
আমি তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বিছানায় গেলাম।
পরের দিন নাস্তার পর বেলা সাড়ে নটার সময় আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে বলল, তুমি আমার বইয়ের কালেকসান দেখে আরও কিছু লিষ্ট তৈরি কর। আমি ততক্ষণে ফিরে আসব।
সেলিনা চলে যাওয়ার পর তাকে একটা চিঠি লিখলাম। তারপর বই এর লিষ্ট করে সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করলাম, সেলিনা কোথায় গেল? কেমন যেন সন্দেহ হতে আমার ব্রীফকেসটা খুলে দেখি, টাকাগুলো নেই। আমি চেয়ারে বসে মুজতবা আলির শবনম বইটি পড়তে লাগলাম।
সেলিনা ফিরে এসে চুপি চুপি আমাকে চেয়ারের পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি আমার দেনমোহরের টাকাগুলো আমার প্রেমিকের একাউন্টে জমা দিয়ে এলাম। আশা করি, উনি তার প্রেমিকার এই ধৃষ্টত্তা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
মনে ব্যাথা পাবে ভেবে কিছু না বলে শুধু একটু হাসলাম। এরকম যে কিছু একটা করবে, তা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাকে সামনে এনে বললাম, কাউকে কিছু দান। করলে দক্ষিণাও দিতে হয়। আমি দানের চেয়ে দক্ষিণার প্রত্যাশী বেশি।
সেলিনা আমার কোলে বসে সারামুখ চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, এর বেশি আমি দিতে পারছি না। আরো বেশি কিছু পেতে চাইলে তোমাকে নিজে সেটা নিতে হবে বলে লজ্জায় আমার বুকে মুখ লুকাল।
আমিও কিছু প্রতিদান দিয়ে বললাম, দক্ষিণা অল্প একটু হলেই চলে। তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। আমি অল্পে সন্তুষ্ট থাকি। কারণ হাদিসে আছে, অল্পে সন্তুষ্ট ব্যক্তি বিরাট সম্পত্তির মারিক।যারা অল্পে সন্তুষ্ট হয় তারা বিপদে বা দুঃখকষ্টে সহজে মুষড়ে পড়ে না।
সেলিনা বলল, আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আল্লাহপাকের রহমতে ও তোমার দোয়ার বরকতে আমি ফাষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছি। এই দেখ বলে খবরের কাগজটা আমার সামনে ধরে তার রোল নাম্বার দেখাল।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে কংগ্রাচুলেশন দিয়ে বললাম, তাহলে তো আমার প্রিয়তমাকে কিছু উপহার দিতে হয়। বল কি পেলে তুমি খুশী হবে? এই বলে তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে সারা মুখ আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে দোয়া করলাম-হে পরওয়ার দেগার রাহমানুর রহিম, তুমি আমার প্রিয়তমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল পরীক্ষায় এই ভাবে সম্মানের সাথে পাশ করিয়ে দিও।