সেলিনা বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আমার পাতেই খেতে বসল। আমি কিছু বললাম না, বরং খুশী হলাম। খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করলাম, এ বেলা কোথাও যেতে হবে নাকি?
সেলিনাকে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, ভুলে গেছি। জান, আমি খুব ভুলা। অনেক সময় অনেক দরকারি জিনিসও ভুলে যাই। তারপর তাকে হাসাবার জন্য বললাম, আজ রাত জাগতে হবে এখন ঘুমিয়ে নাও। আমিও তোমার সঙ্গে একটু কমপিটিশন দেওয়ার চেষ্টা করব। তবুও যখন হাসল তখন দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ওকে দুহাতে তুলে খাটে এনে শুইয়ে খুব আদর করলাম। সেলিনা হাঁপাতে লাগল। বললাম, কি, মন থেকে চিন্তা দূর হয়েছে? সে আমার বুকে মুখ লুকাল। তারপর আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
দরজায় আওয়াজ হতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সেলিনাকে জাগিয়ে বললাম, দেখ, কে যেন দরজায় নক করছে।
সেলিনা গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলে দিল।
জরিনা ট্রেটেবিলে নানা রকম ফুল ও মিষ্টিসহ চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, আম্মা এগুলো পাঠিয়েছে। আর হোটেলের খাবার খেতে নিষেধ করেছে।
সেলিনা ছলছল নয়নে বলল, না, তুই এগুলো নিয়ে যা। আর আমরা হোটেলের খাবারই খাব।
জরিনাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি বললাম, তুমি কার কথা শুনবে? তোমার আপার, না আমার? জরিনা কিছু বলার আগে আমি আবার বললাম, তুমি নাস্তা রেডী কর, আমি তোমার আপাকে ম্যানেজ করছি। সেলিনাকে ডেকে কাছে বসিয়ে বললাম, মুরুব্বিদের, বিশেষ করে পিতা-মাতার দোষ। কোনোদিন ধরতে নেই। ওঁদের পায়ের তলায় সন্তানদের বেহেস্ত। কুরআন পাকের মধ্যে আল্লাহ এরশাদ করেছেন। আর তোমার পরওয়ার দিগার আদেশ করিয়াছেন। যে, তোমরা তাহাকে ব্যতীত অন্য কাহারো ইবাদত করিও না, এবং তুমি মা বাপের সহিত সদ্বব্যহার করিও, যদি তোমার সম্মুখে তাহাদের একজন কিংবা উভয়। বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাহদিগকে উহ পর্যন্ত বলিও না (১)। প্রত্যেক পিতা মাতা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তবে অনেক সময় পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের মনের মিল হয় না। সেজন্য পিতা-মাতার উপর রাগ করে থাকা সন্তানদের মোটেই উচিত নয়। এরপর শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলাম। বললাম, আমি যখন রাগ না করে খেতে চাচ্ছি, তখন তোমার আর অমত করা উচিত নয়। কথাটা মন্ত্রের মত কাজ করল।
সেলিনা বলল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
জরিনার দিকে চেয়ে বললাম, কি ছোট গিন্নী, নাস্তা খাওয়াবে? না আপার কথায় ফিরে যাবে? বলে জীব কেটে ফেললাম।
ওরা দুজনেই তখন হাসতে আরম্ভ করেছে।
বললাম, আমারও ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। তুমি যেন আবার কিছু মাইণ্ড করে বস না। আসল কথা কি জান? তোমাকে যে কি বলে ডাকব সেটা ভেবে ঠিক করতে না পেরে হঠাৎ করে ঐ সম্বোধনটা বেরিয়ে গেছে। নাম ধরে ডাকলে যদি আবার কিছু মনে কর। তার চেয়ে কি বলে ডাকলে তুমি খুশী হবে বলে দাও। তোমাদের এ্যারিস্ট্রোকেটি সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ।
জরিনা হাসতে হাসতে বলল, আপনার যা খুশী তাই বলে ডাকবেন, কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই।
সেই থেকে তাকে কখনো নাম ধরে, কখনো মিস আধুনিকা, আবার কখনো ছোট গিন্নী বলে ডাকতাম।
এমন সময় দরজার বাইরে থেকে জোবেদা বলল, আসতে পারি?
আমি বললাম, নিশ্চয় আসবেন।
জোবেদা দুজন মেয়েকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, আমাদের আত্মীয়া আসমা ও রাবেয়া, দেশ থেকে বেড়াতে এসেছে।
আমি সালামের জওয়াব দিয়ে সবাইকে বসতে বললাম।
জরিনা সকলকে নাস্তা পরিবেশন করল।
হঠাৎ জরিনা বলে উঠল, দুলাভাই, আপনি সিনেমা দেখেন?
আমি সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাদের কি মনে হয়?
সেলিনা বলল, আমাকে আবার জড়াচ্ছ কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছি না কি?
বললাম, জরিনা না পারলে তুমিই বলে দাও।
জরিনা বলল, অত কথার দরকার নেই, দেখেন কি না বলুন।
দেখিনি বললে মিথ্যা বলা হবে! আজ পর্যন্ত যে কটা ছবি দেখেছি, তা আঙ্গুলে গোনা যাবে। সিনেমা বলতে কি বোঝায় তা জানার জন্য দেখেছি।
জরিনা আবার জিজ্ঞেস করল, কি জানলেন?
সিনেমা দেখে কিছু জ্ঞান লাভ করা যায় সত্য। কিন্তু সে রকম দর্শকের সংখ্যা কম। আর বর্তমানে যে সমস্ত ছবি দেখান হয়, তাতে করে সিনেমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জনের জন্য পর্দায় বহু ন্যাকেট ও অশ্লীল দৃশ্য দেখান হয়। এগুলো উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। এতে করে সমাজের নৈতিক চরিত্রের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এই কারণে ইসলামের দৃষ্টিতে সিনেমা দেখা কঠোরভাবে নিষেধ। খাওয়া পরা, কাজ-কর্ম, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি যে কোনো ব্যাপারে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ যেখানে বেশি, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্য সেই সমস্ত জিনিস হারাম করেছেন। যেমন মদ। মদ মানুষের অল্প কিছু উপকার করে, কিন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে মদ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তাই আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন।
আসমা নামে নূতন আগত মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে আপনার কি মত?
বললাম, আমার মতামতের এক পয়সাও দাম নেই। আমি সব সময় সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর রাসূল (দঃ)-এর পথে নিজেকে এবং অপরকে চালিত করার চেষ্টা করি। আর যা কিছু বলি কুরআন হাদিস মোতাবেক। নারী স্বাধীনতার কথা আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তবু অল্প কথায় বলার চেষ্টা করছি। আমরা জানি প্রত্যেক জিনিসের একটা সীমা আছে। আর যে কেউ সেই সীমার বাইরে যাবে নিশ্চয় তার বিপদ হবে। যেমন কেউ তার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করলে সে যে ক্রমশঃ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে একথা সকলেই স্বীকার করবে। কেউ পাহাড়ে উঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যদি সে পাহাড়ের বাইরে পা বাড়ায়, তাহলে কি হবে সে কথাও আমরা জানি। তাই মুসলিম নারী হিসাবে তাদের জানা উচিত, আল্লাহ নারীদের কতটা স্বাধীনতা দিয়েছেন। বর্তমান যুগে আমাদের দেশের নারীরা সেই সব না জেনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে স্বাধীনতার যে সমস্ত বুলি আওড়িয়ে নারী স্বাধীনতার প্রয়াস চালাচ্ছে, ইসলামে তা নিষিদ্ধ। নারী স্বাধীনতার ফলে হয়তো। কিছু সংখ্যকের উপকার হয়েছে। সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিছু সংখ্যকের ব্যক্তিগত সুবিধা সারা বিশ্বের সমস্ত নারীদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। যেমন ধরুন একজন অথবা কয়েকজন ব্যক্তি খাদ্যাভাবে মারা যেতে বসেছে, সে বা তারা তখন হারাম জিনিস খেয়ে জান বাঁচাতে পারে। তার বা তাদের জন্য ইসলামে এটা জায়েজ। তাই বলে সুস্থ, সবল ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য তা হারাম।