নাস্তা খেয়ে মামা কোর্টে চলে গেলেন।
ড্রইংরুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি সিগারেট খাচ্ছি। মনের মধ্যে তখন নানা রকম চিন্তা এসে ভীড় করছে। সমস্ত চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাববার চেষ্টা করছি। পিঠে কারুর নরম হাতের মৃদু স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দেখি, সেলিনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় তার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে গেছে। আমি তার লজ্জা কাটাবার জন্য সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?
সেলিনা সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, ভালো আছি। লজ্জা করছিল বলে এতক্ষণ আসতে পারিনি, কিছু মনে করনি তো?
লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা নেই তার ঈমানও নেই। তারপর বললাম, বায়তুল-মোকাররম যাব, যাবে নাকি?
যাব, একটু অপেক্ষা কর, এক্ষনি আসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাপড় পাল্টে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমার জন্য কিছু কিনবে?
বললাম, তুমি তো আমার মনের সব কথা জান।
সেলিনা আমার দুটো হাত ধরে বলল, কিন্তু পেমেন্ট আমি করব। আজকের এই অনুরোধটা তোমাকে রাখতেই হবে।
আজ তোমাকে কিছু দিতে মন চাইছে। পেমেন্ট তুমি করলে আমার তো আর তোমাকে কিছু দেওয়া হল না।
তাহলে সামান্য কিছু দিও।
সে দেখা যাবে বলে আমরা বায়তুল মোকাররমে ঐ বন্ধুর দোকানে গিয়ে অর্ডার দেওয়া গহনা দিতে বললাম।
উনি তিনটে বাক্স এনে খুলে দিয়ে সামনে রাখলেন। একজোড়া কংকন, একজোড়া কানের দুল ও একটা টায়রা।
চেকে পেমেন্ট দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পছন্দ হয়েছে?
সেলিনা আমার হাত থেকে বা তিনটে নিয়ে বলল, আমার মনের মত হয়েছে। আমি নিজেও বোধ হয় এত ভালো ডিজাইন চয়েস করতে পারতাম না। গাড়িতে উঠে সব পরে ফেলল।
বললাম, বিয়ের সময় ওগুলো পরতে হয়।
সেলিনা বলল, এখনই তো আমাদের বিয়ে হবে।
ড্রাইভার দাদুকে বললাম, গ্যানিসে চলুন। গাড়ি ততক্ষণে গুলিস্তানে চলে এসেছিল। দাদু গাড়ি ঘুরিয়ে গ্যানিসের সামনে পার্ক করল।
সেলিনার জন্য গাঢ় লাল রং এর জাপানি সিফনের একটা শাড়ী, ওড়না, গোলাপি রং এর সার্টিন কাপড়ের একসেট সালওয়ার কামিজ, দুটো রুমাল ও একজোড়া ব্রা কিনলাম। তারপর বাটায় গিয়ে তার জন্য জুতো কিনে ফেরার পথে বললাম, এগুলোর মধ্যে তোমার ইচ্ছামতো বিয়ের সময় পরবে।
যথা সময়ে ঠিকমত সব কাজ মিটে গেল। সন্ধ্যার পর সেলিনাদের ভাড়াটিয়া দারোগা সাহেব স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। বিয়ের পর খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলেন। জরিনা তাদের সঙ্গে এসেছিল, সে থেকে গেল। বিয়েতে কোনো আত্মীয়-স্বজন আসেনি। সবশেষে জোহরা ও জরিনা যখন আমাকে বাসর ঘরে দিয়ে গেল তখন রাত্রি এগারটা।
দেখলাম, সেলিনা খাটের উপর বসে আছে। মাথার ওড়নাটা মুখের উপর একটু নামান। আমি ঘরের দরজা জানালা আটকে দিয়ে পর্দাগুলো টেনে ঠিক করে চেয়ারে এসে বসলাম।
সেলিনা ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
আমি দাঁড়িয়ে তাকে দুহাত দিয়ে তুলে বুকে জড়িয়ে প্রথমে মাথায় তারপর দুগালে শেষে অধরে অধর ঠেকিয়ে চুমো খেয়ে দোয়া করলাম-হে রাব্দুল আলামিন, তুমি আমাদের দাম্পত্য জীবনে শান্তির ধারা বর্ষণ কর। আমাদের ঈমানকে তোমার পথে দৃঢ় রেখ। আমাদের প্রেমকে কোনো দিন লাঞ্ছিত করো না।
সেলিনার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছিল। বললাম, তোমার অযু আছে?
সেলিনা মাথা নেড়ে জানাল আছে।
তাহলে এস আল্লাহপাকের দরবারে দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ি।
সেলিনা খুব আস্তে আস্তে বলল, আমাকে এই নামাযের নিয়েত ও নিয়ম শিখিয়ে দাও।
তাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে দুজনে শোকরানার নামায পড়লাম। তারপর তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে আদর করে খাটে শুইয়ে দিয়ে বললাম, তুমি ঘুমাও, আমি একটু পরে ঘুমাব।
আমি চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে সিগারেট ধরালাম। মনের মধ্যে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। কিছুতেই নিজেকে সম্বরণ করতে পারছিলাম না। কেবলই মনে হতে লাগল, আমি আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম।
সেলিনা যখন আমার পায়ে হাত দিল তখন সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখলাম, আমার দুপা জড়িয়ে কাঁদছে। আমি সব চিন্তা দূর করে দিয়ে তাকে তুলে কোলে বসিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ব্যবহারে কী তুমি ব্যাথা পেয়েছ?
সেলিনা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, অমন কথা বল না। বরং আমিই চিন্তা করছি, আমার সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে অশান্তির মধ্যে ফেলে দিলাম না তো? আমার জন্য তুমি অশান্তি ভোগ করবে, সেটা যে আমি সহ্য করতে পারছি না।
দেখ, আমরা পুরুষ, আমাদেরকে অনেক কিছু বিপদ-আপদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতে হয়। আজ ঐসব কথা বলে আনন্দের রাত্রিকে নিরানন্দ করে লাভ নাই। চল ঘুমাবে চল।
তুমি একটু বস বলে সেলিনা নিজের সুটকেস খুলে একটা অটোমেটিক ওমেন্স ঘড়ি বের করে এনে আমার হাতের ঘড়িটা খুলে নিয়ে পরিয়ে দিল। আর আমার ঘড়িটা নিজের হাতে পরে নিল। তারপর বলল, তুমি আমাকে তোমার মনের মত করে গড়ে নিও। হয়তো অনেক সময় অন্যায় করে ফেরব, সেজন্য যা মনে চায় শাস্তি দিও, কিন্তু রাগ বা অভিমান করে কখনও আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে না বল?