বললাম, তথাস্তু।
সেলিনা সালাম দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।
নিউমার্কেটের রূপালী ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তুললাম। দুপুরে সাহেবকে ফোন করে একসপ্তাহের ছুটি চাইতে তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন।
বেলা দুটোর সময় ফেব্রিক্স হাউসের সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় সেলিনাকে আসতে দেখলাম। সাদা ধবধবে সালওয়ার কামিজ পরেছে। আর ঐ একই কাপড়ের রুমাল ও ওড়না দিয়ে মাথা, বুক ও পিঠ ঢেকে দিয়েছে। মনে হল গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে মার্কেটের আঙ্গিনা দিয়ে একটা বেহেস্তের হুর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি সবকিছু ভুলে তন্ময় চিত্তে তার দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, এই নিস্পাপ হুরের মত, মেয়েটার তুমি কি উপযুক্ত? কথাটা চিন্তা করে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
আমার কাছে এসে সেলিনা সালাম দিয়ে বলল, চল, বোরখা কিনব।
আমি চিন্তার মধ্যে এমনিই ডুবে ছিলাম যে, তার কোনো কথা আমার কানে গেল না। অপলক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকলাম।
আমাকে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেলিনা আমার একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি এত চিন্তা করছ?
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, কি যেন বলছিলে?
আগে বল, তুমি এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছিলে?
আমার প্রিয়তমার কথা।
কিন্তু আমার মন বলছে, তার সঙ্গে আরো কিছু যেন ভাবছিলে।
সবটা শুনলে তুমি যদি আবার কিছু মনে কর।
আমি কিছু মনে করব না, প্লীজ বল।
চল যেতে যেতে বলছি। তারপর যেতে যেতে বললাম, তোমাকে আসতে দেখে বেহেস্তের হুর বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তুমি কি এই হুরের উপযুক্ত? কথাটার সত্যতা চিন্তা করে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
সেলিনা দ্রুত আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে বলল, কথা দাও, আর কখনও এ রকম কথা ভাববে না।
হেসে ফেলে বললাম, মন কি কারো কেনা গোলাম যে, হুকুম করলেই মেনে চলবে? তবে তোমার কথাটা রাখার জন্য মনকে কড়া শাসন করে দেব, যাতে করে ভবিষ্যতে আর এ রকম চিন্তা যেন না করে।
তারপর আমরা একটা দোকানে গিয়ে বোরখা কিনলাম। সেলিনা দোকানের একজন কর্মচারীকে আমার জন্য পাজামা পাঞ্জাবী দেখাতে বলে আমাকে কালারটা বলতে বলল।
আমি বললাম, আমার এখন কোনো কিছু কেনার দরকার নেই।
তোমার দরকার না থাকলেও আমার আছে। এই বলে তাকে ট্যাট্রনের সাঁদা পাজামা এবং ঘীয়ে রং এর নক্সা করা সূতীর পাঞ্জাবী দিতে বলল। কেনাকাটা শেষ করে সেলিনা বলল, অনেক কাজ বাকি আছে, এখন আমাকে যাওয়ার অনুমতি দাও। ইনশা আল্লাহ আগামীকাল দেখা হবে।
বললাম, চল না একটু নভেলে রেষ্ট নেবে। তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
সেলিনা বলল, ঠিক বলেছ, চল একটু গলা ভিজিয়ে নিই।
আমরা নভেলে গিয়ে বসলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, কি দিতে বলব?
সেলিনা বলল, তোমার যা মন চায়
আমি বেয়ারাকে ডেকে দুই পীস ফ্রুটকেক ও দুটো ফান্টা দিতে বললাম।
তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে সেলিনাকে গাড়িতে তুলে দিলাম।
সেলিনা বোরখার সঙ্গে আমার জন্য কেনা পাজামা পাঞ্জাবীর প্যাকেটটাও নিয়ে চলে গেল।
রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বললাম, কোম্পানীর কাজে আগামীকাল ঢাকার বাইরে যাব, ফিরতে তিন দিন দেরি হবে।
এই পর্যন্ত বলে জামান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই হয়তো ভাবছিস, আমি একজন মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। এটাই ভাবা স্বাভাবিক। এই কথা চিন্তা করে আমিও তখন আমার বিবেকের কাছে খুব ছোট হয়ে গেছি। কিন্তু স্ত্রীকে সত্য ঘটনা বলে তাকে অশান্তির আগুনে জ্বালাতে চাইনি। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সারাজীবন তার মনে অশান্তির আগুন লাগতে দেব না। সে জন্য যত স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় করবো। যত তিতিক্ষা সহ্য করতে হয় করব। তাই পরবর্তী। জীবনে সেলিনাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেও আমার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কোনো দিন এতটুকু খারাপ ব্যবহার করিনি।
ঐ দিনটির কথা আমার চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সেই দিন আমার স্ত্রী নাস্তা খাইয়ে কাপড়-চোপড় ব্রীফকেসে গুছিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে কদমবুসি করল। আমার মনটা তখন ব্যাথায় টনটন করে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক রেখে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
ঠিক আটটার সময় কোর্ট হাউস স্ট্রীটে সেলিনার মেজ মামার বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম।
ওর মামাতো বোন জোহরা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। আমাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ভালো আছি।
জোহরা আমার হাত থেকে ব্রীফকেস ও মিষ্টির বাক্স নিয়ে বলল, আসুন। আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে জোহরা চলে গেল। সেখানে তার ছোট দুই ভাইবোন। খেলা করছিল। আমি টফির বাসটা একজনের হাতে দিয়ে বললাম, তোমরা দুজনে ভাগ করে নেবে। টফির বাসটা আর খেলনাগুলো নিয়ে তারা চলে গেল। একটু পরে সেলিনার মেজ মামা এলে আমি সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলাম।
সালামের উত্তর দিয়ে মামা বললেন, ভালো আছি। তারপর বললেন, তোমাকে খুকী বোধ হয় সবকিছু বলেনি। ঠিক সাড়ে এগারটার সময় তোমরা ঐ জজের ঘরে যাবে, যেখানে তোমাদের এ্যাপ্লিকেশন এফিডেভিট হয়েছিল। কোর্টের কাজ শেষ হওয়ার পর কোথাও যাবে না। রাত্রে এখানে সামাজিক প্রথায় তোমাদের বিয়ে হবে।