খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালই হয়েছিল। তখন বর্ষাকাল। দুপুরের পর মুষলধারে বৃষ্টি নামল। জোহরের নামায পড়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে যাওয়ার সময় জামান স্ত্রীকে বলল, তোমরা দুজনে গল্প কর, আমাদের কাছে এসে ডিষ্টার্ব করো না। আমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কিছু কথা। আছে। তবে এমন বর্ষামুখর দিনে মাঝে মাঝে ছোলা-কড়াই ভাজা আর চা পাঠালে খুব খুশী হব। তারপর ড্রইংরুমে এসে দুজনে মুখোমুখি সোফায় বসে সিগারেট ধরালাম।
প্রথমে আমিই বললাম, তুই কি যেন তোর জীবনের ঘটনা বলবি বলেছিলি?
জামান বলল, বলব, তবে তার আগে তোকে কথা দিতে হবে, এটাকে নিয়ে তুই একটা উপন্যাস লিখবি। তোর ফুটন্ত গোলাপ ও বিদেশী মেম বই দুটো তো খুব হীট করেছে। আশা করি, আমারটাও করবে।
বললাম, তোর ইচ্ছা পুরণ করার চেষ্টা করব।
তাহলে আরম্ভ করছি শোন–
.
বেলা তখন দুটো। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের আধাআধি। জোহরের নামাযের পর খাওয়ার পর্ব শেষ করে দোকানের সামনের আঙ্গিনায় রোদ পোহাচ্ছি। সে বছর শীত বেশ জোরে সোরে পড়েছিল। যখনকার কথা বলছি, তুই তো জানিস তখন আমি ঢাকা গভঃ নিউমার্কেটের একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলস ম্যানেজার ছিলাম। অন্যান্য দোকানের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছি। এমন সময় আমার একজন সহকর্মীর ডাকে আমি দোকানে গেলাম। তিনজন ছাত্রীকে দেখিয়ে সে বলল, ইনারা দুটো বই ফেরত দিয়ে অন্য বই নিতে এসেছেন।
ওদের মধ্যে একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, দয়া করে এই দুটো বই চেঞ্জ করে দিন। তারপর একটা বই কাউন্টারের উপর রেখে বলল, এটার ভিতরের দুটো পাতা ছেঁড়া। আর ওরা গতকাল এখান থেকে যে বইটা কিনেছিল, সেটা না দিয়ে আপনারা ভুল করে অন্য বই প্যাকেট করে দিয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় বইটাও কাউন্টারের উপর রেখে বলল, বইয়ের ভেতরে মেমো আছে।
শীতের রোদ থেকে আসতে এমনি বিরক্ত লাগছিল, তার উপর বই চেঞ্জের কথা শুনে আরো বেশি বিরক্ত বোধ করে সহকর্মীকে তাদের মেমো মোতাবেক বইটি দিতে বললাম। যে ছাত্রীটি আমার সঙ্গে কথা বলছিল, তার বইটা ছিল ইন্টারমিডিয়েটের ইংলিশের নোট। আমি ঐ বইটার অন্য এক কপি তাকে দিলাম। তারপর ফেরৎ বইটার ছেঁড়া পাতা খুঁজতে গিয়ে সেখানে এক টুকরো কাগজ ভাঁজ করা দেখলাম।
কাগজটা ছাত্রীটিকে ফেরৎ দিতে গেলে সে আস্তে করে বলল, ওটা আপনাকে দিয়েছি, পড়ে দেখবেন।
প্রথমে কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, হলুদ রঙ এর জাপানি সিফনে আবৃত দেহ থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে। দীর্ঘায়ত চোখে অপূর্ব কোমলতা।
চার চোখ এক হতে মেয়েটি স্নিগ্ধ কণ্ঠে শুধাল, আমাকে চিনতে পারছেন না?
আমি একটু চিন্তা করে বললাম, এখানে আমার চেনা জানা কোনো মেয়ে নেই। তবে আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
মেয়েটি তখন মিনতি সুরে বলল, আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা আছে। এই চিঠিটা পড়ে সেইমতো আমার সঙ্গে দেখা করলে খুব উপকৃত হব।
কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না
মৃদু হেসে মেয়েটি জওয়াব দিল, দয়া করে তর্ক করবেন না। প্লীজ, মনে করুন এটা একটা আপনার খুব আপনজনের ঐকান্তিক মিনতি।
আমি কিছু বলার আগে তার সঙ্গিনীরা তাকে ডেকে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটির স্পর্ধা দেখে যদিও রাগে আমার আপাদমস্তক রি রি করে উঠল, তবু কাগজটায় কি লেখা আছে তা জানার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে দোকানের ভিতরে গেলাম। সেখানে অফিসিয়াল কাজের জন্য টেবিল, চেয়ার, লাইট, ফ্যান সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। বইয়ের আলমারী দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। কাগজটা খুলে পড়লাম
মাননীয় ম্যানেজার সাহেব, আপনি যদি আগামী সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল আটটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসেন, তাহলে আমি খুব বাধিত হব।
ইতি-সেলিনা।
প্রথম থেকেই মেয়েটির কথা বার্তায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সবকিছু যেন গায়ে-পড়া ভাব। তারপর এই চিঠি পড়ে বেশ অসন্তুষ্ট হলাম। কারণ আমি ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। অন্য যে কোনো লোক হলে হয়তো রোমান্টিক কিছু অনুভব করত। এই রকম চিন্তা করা যে পাপ, তা আমি জানতাম। সিগারেট ধরিয়ে কাগজটা পুড়িয়ে ফেললাম। মনে হলো সব অসন্তোষ দুর হয়ে গেল। তারপর বেমালুম সব কিছু ভুলে গেলাম।
আমি যে দোকানে চাকরি করতাম সে দোকানের মাঝখানের দেয়াল ভেঙ্গে দুটোকে একটা করা হয়েছে। আমি ছাড়াও তিনজন সেলসম্যান ছিল। কর্মদক্ষতায় সকলের চেয়ে সিনিয়ার ছিলাম। আর ঠিকমতো নামায রোযা করতাম। সেই জন্য আমার সহকর্মীরা আমাকে খুব সমীহ করে চলতো। আমি তাদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম। এই দোকানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ ও আইনের দেশী-বিদেশী এবং নানারকম ধর্মীয় পুস্তক ছিল।
দোকানের অর্ডার লিষ্ট তৈরির কাজে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ঐ চিঠির কথা হয়তো কোনো দিন আর মনেই পড়ত না। কিন্তু বিধির বিধান অন্য রকম। উক্ত ঘটনার দিন পনের পর একদিন মার্কেটের ভিতরের একটি ঘড়ির দোকানে আমার রিষ্ট ওয়াচটা ওয়েলিং করতে দিয়ে ফিরছি, হঠাৎ ঐ মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। বলল, আমার সঙ্গে একটু আসুন।