তারপর থেকে আমি আর তাদের বাসায় যাইনি। মাঝে মাঝে সেলিনা ফোন করে নভেল ড্রিংকে আসতো, আমি সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতাম। আবার কোনো ছুটির দিনে পার্কে যেতাম।
এদিকে আমার স্ত্রী আমাকে যাতে কোনো রকম সন্দেহ না করে সেজন্য স্বাভাবিক জীবন শুরু করলাম। মন থেকে সমস্ত চিন্তা দুর করে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, সেলিনাকে বিয়ে করলেও স্ত্রীর সঙ্গে কোনো দিন কোনো কারণে খারাপ ব্যবহার করব না।
কিছুদিন পর সেলিনা ফোন করে বলল, তুমি আগামী কাল ছুটি নিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় জি, পি, ওর গেটে থাকবে, আমি আসব, বিশেষ দরকার আছে।
দরকারটা এখন বললে হত না?
এখন বলব না, কাল বলব। তোমার কিন্তু আসা চাই। তারপর অনুমতি নিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।
সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিলাম, কিন্তু স্ত্রীকে বললাম না। পরের দিন ঠিক সময় মত জি, পি, ওর গেটে দাঁড়ালাম। দুমিনিট পর সেলিনাদের গাড়ি এসে আমার সামনে ব্রেক করল।
সেলিনা সালাম দিয়ে দরজা খুলে বলল, এস!
আমি সালামের জওয়াব দিয়ে গাড়িতে বসতে তার গায়ে গা ঠেকে গেল।
মৃদু হেসে বলল, ব্যবধান রেখে বসব? না যেভাবে আছি সেভাবে থাকব?
তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখ।
সেলিনা অল্প একটু সরে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাব বলোত?
কি করে বলব? ধনীর দুলালীদের মতলব বোঝা মুশকিল।
তুমি এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমার প্রেমের পর্দায় আঘাত লাগে বলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছল।
এত সামান্য কথায় আঘাত পাবে ধারণা করিনি। বললাম, কথাটা আমি এমনি বলেছি। সিরিয়াসলি বা তোমার মনে আঘাত দেওয়ার জন্য বলিনি। কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললাম, মনে হচ্ছে কোনো অভিসন্ধি এঁটেছ।
সেলিনা বলল, একদিন তো আমাকে সাইকোলজী ও এ্যাসট্রোলজীর ছাত্রী বানিয়েছিলে, আজ যদি আমি তোমাকে সেই কথা বলি?
বল, আমিও বলব, ঐ সব বই পড়িনি। আমার প্রেম আমাকে বলে দিয়েছে। এই কথায় দুজনেই হেসে উঠলাম।
ড্রাইভার দাদু আমাদের কথার মধ্যে এই প্রথম কথা বললেন, প্রেমিক প্রেমিকারা মনের কথা আপনা থেকে জানতে পারে, যদি তাদের প্রেম খাটি হয়। সে জন্য কোনো বই পড়ার দরকার হয় না।
আমি বললাম, দাদু, আপনার কথা হাণ্ডেড পারসেন্ট কারেক্ট।
কোর্ট হাউস স্ট্রীটের একটি দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। সেলিনা আগে নেমে আমাকে নামতে বলল। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে বলল, আপনি এখন চলে যান। দরকার মত ফোন করে ডেকে নেব।
আমাকে যে বাড়িতে নিয়ে গেল, সেটা নিচে চার কামরা ও উপরে চার কামরা। উপরে নিয়ে গিয়ে যে কামরায় বসাল, সেটা উকিলের চেম্বার। ঘরের চারিদিকের আলমারীতে সব আইনের বই। তার মধ্যে অনেক বই আমার চেনা। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার চারপাশে অনেকগুলো চেয়ার। দরজার সোজা একটা মুভিং চেয়ার রয়েছে। আমাকে বসিয়ে এক্ষুনি আসছি বলে সেলিনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মেজ মামার সঙ্গে ফিরে এল।
আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম।
মেজ মামা সালামের জওয়াব দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাকে অনেকদিন থেকে চিনি। তুমিও নিশ্চয় আমাকে চিনতে পেরেছে?
জ্বি হ্যাঁ, সেদিন সেলিনাদের বাসায় চেনা চেনা মনে হতে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।
উনি আবার বললেন, তুমি আমার ছেলের মত, তাই তোমাকে প্রথম থেকে তুমি বলে সম্বোধন করেছি, কিছু মনে করোনিতো বাবা?
আপনি আমাকে এত আপন করে নিয়েছেন জেনে আমি কৃতজ্ঞ।
উনি ড্রয়ার খুলে দুটো স্ট্যাম্প বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, সবগুলো স্টার চিহ্নের পাশে সিগনেচার করে দাও।
আমি একটা স্ট্যাম্প নিয়ে পড়ে দেখি সেটা কোর্ট ম্যারেজের এ্যাপ্লিকেশন। সেলিনা আগেই সই করেছে।
মামীর সঙ্গে দেখা করে আসি বলে সেলিনা চলে গেল।
আমি সিগনেচার না করে বললাম, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।
মামা বললেন, তুমি যা বলবে খুকী সেসব বলেছে। আরও যদি কিছু বলতে চাও শুনব, কিন্তু কোনো কাজ হবে না। কারণ এতকিছুর পর ওকে আর ফেরান যাবে না। ও খুব একরোখা। যা করবে বলবে, তা করেই ছাড়বে। নিজের মতের বাইরে কখনো কিছু করে না। আমার কাছে প্রথম যখন সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে নিজের মতামত জানায় তখন আমি খুব রাগারাগী করেছি। সংসারের জটিল সমস্যার কথা বলে অনেক ভয় দেখিয়েছি এবং বুঝিয়েছিও। ওর মামীমাও অনেক করে ঐসব খেয়াল ছাড়তে বলেছে। কিন্তু ওর ঐ এক কথা, হয় তোমাকে বিয়ে করবে নচেৎ আত্মহত্যা করবে। এই একরোখা স্বভাবের জন্য আমার বোন ওকে একদম দেখতে পারে না। ওকে ওর ছেলেবেলা থেকে জানি বলে নিজের মত বিসর্জন দিয়ে বাঁচাবার জন্য সাহায্য করছি।
সবকথা শোনার পর সিগনেচার করলাম। তারপর অন্য ষ্ট্যাম্পটা পড়লাম। একই জিনিসের দুই কপি অঙ্গিকার পত্র। তাতে আমার দেওয়া বিয়ের শর্তগুলো টাইপ করা। সেগুলোতেও সেলিনার সিগনেচার রয়েছে।
বললাম, ওর মতিগতি বদলাবার জন্য এই শর্তগুলো লিখে চিঠি দিয়েছিলাম। বিয়েই যখন করতে যাচ্ছি, তখন এটার আর কী দরকার?
মামা বললেন, তোমার সেই চিঠি পড়ে আমিও তা বুছেঝি; কিন্তু ওর হুকুম এটাও রেজেষ্ট্রী করতে হবে। তুমি দুটোতেই সিগনেচার করে দাও। নচেৎ ও আমাকে আস্ত রাখবে না।