ডাক্তাররা চলে যাওয়ার পর মেজ মামা আমাকে বললেন, শুধু একটা কথা বলব, তোমার উপরেই সেলিনার ভালো মন্দ নির্ভর করছে। এখন আমি আসি। পরে এক সময় তোমার সঙ্গে কথা বলব।
সকলে চলে যাওয়ার পর সেলিনার ঘরে এসে খাটের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে জরিনাকে হরলিক্স তৈরি করতে বললাম।
সেলিনা বলল, ডাক্তাররা বুঝি আমাকে শুধু খাওয়াতে বলেছেন?
ডাক্তাররা যাই বলুক না কেন? আমি তোমাকে যেভাবে যখন পথ্য ও ওষুধ খেতে বলে যাব, ঠিকমত সেগুলো খাবে। জরিনার কাছ থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে কখন কি খাবে তার একটা চার্ট তৈরি করে জরিনাকে বললাম, তুমি তোমার আপাকে চার্টমত খাওয়াবে। যদি কোনো রকম ওজর আপত্তি করে, তাহলে আমি আগামীকাল এলে জানাবে।
জরিনা হরলিক্স তৈরি করে ওকে চামচে করে খাওয়াল। তারপর বলল, জানেন, আজ একমাস আট দিন পর আপা এই প্রথম কিছু খেল ও কথা বলল। এতদিন শুধু পানি খেয়ে ছিল।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আপাকে দেখাশুনা করে কে?
জরিনা বলল, আমি ও মা। একজন নার্সও রাখা হয়েছে। নিজের প্রয়োজনে। কিছুক্ষণ আগে সে বাইরে গেছে।
আমি আসরের নামায পড়ে সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নামায পড়বে না?
কি করে পড়ব? আমি যে খুব দুর্বল। উঠতে পারি না। যতদিন সামর্থ ছিল পড়েছি।
তোমার তো উঠার দরকার নেই। জেনে রেখ, মেয়েদের প্রাকৃতিক অসুবিধে ও পাগল ব্যক্তি ছাড়া কারুর জন্য নামায মাফ নেই। যে কোনো অবস্থা হোক না কেন নামায পড়তেই হবে। তারপর জরিনাকে প্লেটে করে কিছু শুকনো ভালো মাটি আনিয়ে দিতে বললাম।
জরিনা তাদের কাজের মেয়েকে মাটি আনতে বলল। কাজের মেয়েটি যখন মাটি নিয়ে ফিরল তখন নার্সও এল।
আমি জরিনা ও নার্সকে বললাম, প্রত্যেক নামাযের সময় সেলিনাকে এইভাবে তাইমুম (অযু) করিয়ে দেবেন বলে মাটিতে দুহাত ঘসে প্রথমে আমি আমার সমস্ত মুখমন্ডল এবং পরে আবার মাটিতে হাত ঘসে দুহাতের কনুই পর্যন্ত মুছলাম। নার্স তাকে সেইভাবে তাইমুম করিয়ে দিল। তারপর আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা দুজনে ওকে ধরে পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে পা করে শুইয়ে দিন।
আমার কথামত তারা সেলিনাকে শুইয়ে দিল।
আমি তাকে বললাম, তুমি এবার চিৎ হয়ে শুয়ে চোখের ঈশারায় নামায পড়।
আমি যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ কেউ আমার অনুমতি ছাড়া ঘরে আসেনি। এক সময় আমি সেলিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে বললাম, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে সেদিন পার্কে ঐ অবস্থায় ফেলে এসে এতদিন যে কি যন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা একমাত্র উপরের মালিকই জানেন। সত্যি ত্যি তোমাকে যে আমি এত, গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছি, তা এই ঘটনার আগে বুঝতে পারিনি। তার সুন্দর সুডৌল আপেলের মত গাল দুটো হাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে তা লক্ষ্য করে আমার গলা ধরে এল।
সেলিনা তা বুঝতে পেরে আমার হাতটা দুহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কাদ কাদ স্বরে বলল, আমার জন্য তুমি যে কত কষ্ট এতদিন পেয়েছ এবং এখনও পাচ্ছ, তা সবকিছু আমি অনুভব করতে পারছি। আমার এখন মনে হচ্ছে, আমার মত সৌভাগ্যবতী মেয়ে সারা দুনিয়ায় নেই।
রাত দশটায় এশার নামায পড়ে সেলিনাকে বললাম, এবার আমাকে আজকের মত বিদায় দাও।
আমার কথা শুনে তার পাড়ুর মুখটা আরও মলিন হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে ছলছল নয়নে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
বললাম, প্রতিদিন তো আসব, মন খারাপ করছ কেন? তারপর একবার তার মাথায় ও মুখে হাত বুলিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে আসি।
এরপর কোনো দিন সকালে অথবা রাত্রে যখনই সময় পেতাম তখনই গিয়ে ওর কাছে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতাম। যাওয়ার সময় নানারকম ফল ও মিষ্টি নিয়ে যেতাম। দশবার দিনের মধ্যে সেলিনা বেশ সুস্থ হয়ে উঠল।
আরো দুতিন দিন পর সেলিনা আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, এতে কিছু টাকা আছে। যদি তুমি মনে কিছু না করে এটা নাও, তাহলে খুব খুশী হব।
তাকে খুশী করার জন্য খামটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? হঠাৎ আমাকে টাকা দিলে কেন?
তুমি আমার জন্য এত খরচ করছ, ভাবলাম, তোমার যদি টাকার টান পড়ে।
আল্লাহপাকের রহমতে আমার টাকার টান পড়বে না। চাকরি ছাড়াও আমার একটা সাইড বিজনেস আছে। তা থেকে যা পাই, তার অল্পকিছু ছাড়া প্রায় সবটাই ব্যাংকে জমা হচ্ছে। তোমার দেওয়া টাকা আমি নিলাম, কিন্তু ভবিষ্যতে এ রকম আব্দার আর করবে না। এখন এই টাকাগুলো আমি আমার প্রেমিকার কাছে গচ্ছিত রাখছি, সময় মত চেয়ে নেব। এই বলে টাকার খামটা তার হাতে ফেরৎ দিলাম।
সেলিনা নির্বাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চোখের পানি গোপন করার জন্য মাথা নিচু করে নিল।
আমি তার চিবুক ধরে তুলে বললাম, আমাকে তুমি ভুল বুঝ না। আমার এই ব্যবহারে যদি তুমি মনে কষ্ট পেয়ে থাক, তবে মাফ চাইছি।
টপ টপ করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেলিনা বলল, তোমার কোনো অন্যায় হয়নি, বরং আমি ভুল করে দয়া দেখাতে গিয়ে চরম অন্যায় করে তোমার মনে ব্যাথা দিয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
বললাম, ভুল মানুষ মাত্রেই করে। আর সেই জন্য আল্লাহপাকের রাসুল(দঃ) বলেছেন, মানুষ ভুল করবে বলেই আল্লাহপাক ক্ষমা রেখেছেন। যদি তারা তা স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চায়। তাহলে আল্লাহপাক তাদের ক্ষমা করে দেন। এর কয়েদিন পর তাকে বললাম, প্রতিদিন আসতে আমার অসুবিধে হয়। তুমি তো এখন ভালো হয়ে গেছ। তুমি বরং মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করো। তাকে আমার দোকানের ও পাশের দুতিনটে দোকানের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, যে কোনো একটাতে ডায়েল করে আমাকে চাইলেই পাবে।