ঐদিন দোকানে আসার পর এক সময় তারা জিজ্ঞেস করল, আপনার কী কোনো অসুখ করেছে? কিছুদিন থেকে আপনাকে খুব মন মরা দেখাচ্ছে।
বললাম, তেমন কিছু হয়নি, তবে শরীরটা কিছুদিন যাবৎ খুব খারাপ যাচ্ছে। বিকেল চারটের সময় ড্রাইভারকে আসতে দেখে দোকান থেকে বের হয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।
আমাকে দেখে ড্রাইভার বলল, আপনাকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে বাসায় যেতে হবে।
বললাম, বাসায় গেলে আবার গোলমাল হবে না তো?
যাকে নিয়ে গোলমাল হবে, সে বোধ হয় আর বাঁচবে না বলে ড্রাইভার রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তারপর আবার বলল, খুকী ভাইয়ের মেজ মামা আর দুজন ডাক্তার বসে আছেন। তারাই আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।
ড্রাইভারকে গাড়িতে যেতে বলে দোকানে ফিরে এসে সাহেবকে ফোন করে বললাম, আমার এক আত্মীয়া মৃত্যুশয্যায়। আমাকে নিয়ে যেতে লোক এসেছে। আমি সেখানে যাচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই। তারপর সহকর্মীদের বললাম, আমি যাচ্ছি। কারণটাতে তোমরা শুনলে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কি হয়েছে?
কি যে হয়েছে ডাক্তাররই রোগ ধরতে পারেনি। পার্কের সেই ঘটনার আগের দিনের রাত থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কিছু খায়নি। কারও সঙ্গে কথা ও বলেনি। এমন কি ডাক্তাররা প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। শুধু প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে। যেন একদম বোবা হয়ে গেছে। আজ মেজ মামা ডাক্তারদের কাছে আপনার ও খুকী ভাইয়ের সম্পর্কের কথা বলায় ওঁরা বললেন, এতদিন কথাটা গোপন রেখে খুব ভুল করেছেন। ছেলেটিকে না হলে চিকিৎসা করে কোনো লাভ হবে না। তাই মেজ মামা আম্মার সঙ্গে রাগারাগী করে আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।
গাড়ি পৌঁছাতে ড্রাইভার আমার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, সোজা উপরে খুকী ভাইয়ের কামরায় চলে যান।
উপরে গিয়ে দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম, দুজন ডাক্তার চেয়ারে আর একজন ভদ্রলোক খাটে বসে আছেন। আমি সালাম দিলাম।
খাটে বসা ভদ্রলোক সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, তুমি এখানে এসে বস বলে খাটে নিজের পাশে ইঙ্গিত করলেন। তারপর ডাক্তারদের বললেন, চলুন আমরা ড্রইং রুমে বসি।
ওঁরা চলে যাওয়ার পর আমি সেলিনার দিকে লক্ষ্য করলাম, একটা পরিস্কার চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা রয়েছে। শুধু মুখাটা খোলা। মাথাটা একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা। চোখ দুটো বন্ধ। শরীর শুবিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। মুখে একবিন্দু রক্ত থাকায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আমি তার কাছে সরে বসে কপালে হাত রাখলাম।
সেলিনা ধীরে ধীরে চোখ খুলে অশ্রুভরা নয়নে আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
তার অবস্থা দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেল। আমার চোখের পানি তার গালে পড়তে সেলিনা কপালে রাখা আমার হাতটা নিয়ে প্রথমে চুমো খেল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, এবার আমার মৃত্যু হলেও কোনো দুঃখ নেই। আমার জীবন সার্থক। আমার প্রেম হেরে যায়নি। একদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রেম দিয়ে তোমাকে জয় করবই। সে প্রতিজ্ঞা আজ আমার পূর্ণ হল। সেইজন্য আল্লাহপাকের কাছে জানাই হাজারো শুকরীয়া।
তার হাতের মধ্যে আমার হাত ছিল। বললাম, তোমার হাতে হাত রেখে বলছি, তোমার প্রেমের কাছে আমি সত্যিই হেরে গেছি। তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব। তুমি শুধু কথা দাও, নিজেকে আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে না। আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছিলাম বলে কি এভাবে মৃত্যুর দিকে এগোতে হয়? আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করছি; তিনি যেন শিঘ্রী তোমাকে সুস্থ করে তোলেন।
তুমি যদি সব সময় আমার কাছে থাক, তাহলে ডাক্তারের চিকিৎসা ছাড়াই আমি ভালো হয়ে যাব।
বললাম, তোমাকে এই রকম অবস্থায় রেখে চলে যেতে আমারও খুব কষ্ট হবে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। তবে কথা দিচ্ছি, আল্লাহ চাহে তো প্রতিদিন এসে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যাব।
বেশ, তোমার ইচ্ছাই আমার কামনা। তবে প্রত্যেক দিন অন্ততঃ একবার আসা চাই
তার কথায় রাজি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, যিনি তোমার কাছে বসেছিলেন ওঁকে যেন চেনা চেনা লাগল।
উনি আমার মেজ মামা। তোমাকে ভালভাবে চেনেন। জর্জকোর্টের উকিল। তোমার কাছ থেকে অনেক আইনের বই কিনেছেন। আমাদের সব ব্যাপার উনি জানেন। আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে একমাত্র উনি এখনও আমাকে ভালবাসেন। ওঁর সাহায্য না পেলে আম্মা অনেক আগেই জহির ভাইয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিত। এতকথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।
আমি তাকে কথা বলতে নিষেধ করলাম। এমন সময় জরিনা এসে বলল, মামা আপনাকে ড্রইংরুমে ডাকছেন। উঠে দাঁড়াতে সেলিনা বলল, আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে যেওনা যেন। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, মাসাধিক কাল আগে রমনা পার্কের সেই ঘটনার দিন সেলিনা আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছিল, আর আজও সেইভাবে কথা বলছে। আচ্ছা বলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম।
মামা নিজে এককাপ চা বানিয়ে বিস্কুটের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, চা খাও।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে ডাক্তারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কি অসুখ হয়েছে?
ডাক্তারদের একজন বললেন, তার আগে বলুন, সেলিনা কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?
বললাম, হ্যাঁ, তবে খুব ক্ষীন স্বরে।
অন্য ডাক্তার বললেন, তবে আর ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা তো মনে করেছিলাম, সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এতদিন আমরা কোনো রোগ ধরতে পারিনি। তারপর সেলিনার মামাকে দেখিয়ে বললেন, ওঁর কাছে আজ আপনাদের দুজনের সম্পর্কের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, কোনো রোগ তার শরীরে নেই। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। অবস্থা যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছিল, আর এক সপ্তাহ এই ভাবে থাকলে মারা যেত। এখন আপনি যদি কথায় ও ব্যাবহারের দ্বারা তার মানসিক যন্ত্রণা দূর কতে পারেন, তাহলে শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে। সব থেকে মুস্কিল হচ্ছিল, কোনো খাবার বা ওষুধ তাকে খাওয়ান যাচ্ছিল না। যদি জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করা হয়, তবে তা মুখে নিয়ে ফেলে দেয়। ওঁকে সুস্থ করার সবকিছু নির্ভর করছে আপনার উপর। ডাক্তাররা বিদায় নেওয়ার সময় আবার বললেন, ভালো করে খাওয়াবার চেস্টা করুন, আর যে ভিটামীনগুলো আছে সেগুলো ঠিকমত খাওয়ান। আশা করি অল্পদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে।