চিঠি পড়ে বুঝতে পারলাম কাঁদতে কাঁদতে লিখেছে। কারণ চিঠিতে কাঁদার চিহ্ন ছিল। সেদিন ছিল মঙ্গবার, বুধবার বই নিয়ে রাজশাহী যাওয়ার কথা। সাহেবকে বলে সেখানে বৃহস্পতিবার যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। চিন্তা করে দেখলাম, যদি তার কথামত না যাই, তাহলে হয়তো কিছু করে ফেলতে পারে।
পরের দিন ঠিক এগারটার সময় পার্কের নিদিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি সেলিনা চুপচাপ লেকের পানির দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। তার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম একটু আগেও কেঁদেছে। আমি ধীর পদক্ষেপে কোনো সাড়া শব্দ না করে অল্প একটু দূরে বসলাম।
প্রায় পাঁচ মিনিট সেলিনা একই ভাবে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতের ঘড়ি দেখল। তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে এক রকম ছুটে এসে পাশে বসে আমার দুটো হাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফাইন্যাল পরীক্ষা চলছিল বলে তোমার দেওয়া সেই চিঠি এতদিন পড়িনি। গত পরশু পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রাত্রে চিঠিটা পড়ে আজ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুমি আমাকে এভাবে চিঠি লিখতে পারলে? তোমার ঐ চিঠির শর্ত ছাড়া যদি আরও হাজার শর্ত থাকে, সেগুলোও সব আমি মেনে নেব। তবু তোমাকে হারাতে পারব না। আর এতেও যদি তুমি রাজি না হও, তবে আমার গলাটিপে এখানে মেরে রেখে যাও। এইকথা বলে সে হাত দিয়ে আমার হাত দুটো নিজের গলায় বেশ জোরে চেপে ধরল। তার কথায় ও কাজে আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি এখন অপ্রকৃতস্থ। আমার কোনো কথা তোমাকে ভালো লাগবে না। তুমি বাসায় চলে যাও। আর কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। তোমার সঙ্গে যদি আরও কিছুদিন আমার যোগাযোগ থাকে, তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। এইকথা বলে তার গলা থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত চলে আসতে লাগলাম।
সেলিনা ছুটে আমার সামনে এসে পথরোধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি এভাবে আমাকে অন্ধকারে ফেলে রেখে যেও না। তোমার কাছ থেকে আজ আমি স্পষ্ট কিছু শুনতে চাই।
তার কাঁন্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে ফেললাম। তারপর সামলে নিয়ে বললাম, তোমাকে বলার মতো আমার আর কিছু নেই। যা বলার আগেই চিঠিতে সব বলেছি। এখন তুমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালে হয়তো আমি বাঁচতে পারি। নচেৎ আমার যে কি পরিণতি হবে, তা উপরের মালিকই জানেন। শেষের দিকের কথাগুলো আমার নিজের কাছে ভেজাভেজা লাগল। শেষে কি তার কাছে কেঁদে ফেলব মনে হতে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।
গেটের বাইরে ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করল, খুকী ভাইকে কোথায় রেখে এলেন? পরশু রাত থেকে কিছু খায়নি, কারও সঙ্গে কথাও বলেনি? কি হয়েছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
কথাগুলো শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বললাম, আপনার খুকী ভাই লেকের ধারে আছে, আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।
বাসায় এসে স্ত্রীকে খেতে দিতে বললাম।
আমার স্ত্রী বলল, তরকারী হতে একটু বাকি আছে। তুমি জোহরের নামায পড়ে নাও, ততক্ষণে সবকিছু হয়ে যাবে।
অযু করে মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসে খেতে বসে মোটেই খেতে পারলাম না।
আমার স্ত্রী বলল, তুমি যে কিছুই খেলে না!
বললাম, কি জানি খিদে রয়েছে অথচ রুচী নেই।
তোমাকে বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, মাঝে মাঝে তুমি খুব চিন্তিত থাক, অথচ আগে এরকম ছিলে না।
মানুষের মন কি আর সব সময় এক রকম থাকে? কিছুদিন যাবৎ শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।
তাহলে ডাক্তারের কাছে একবার চেকআপ করাও না কেন?
তুমি অত ভেব না, একদিন না হয় ডাক্তারের কাছে যাব। মন থেকে চিন্তা দূর করার জন্য এবং ওকে খুশি করার জন্য বললাম, চল। আজ চিড়িয়াখানা দেখতে যাব। তারপর হোটেলে বিরানী খেয়ে বাসায় ফিরবো।
কথাটা শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশী হল। সেদিন সারা বিকেল চিড়িয়াখানা দেখে হাতীর পিঠে চড়ে কাটালাম। ফেরার পথে ওর জন্য গ্যানিস থেকে একসেট সালওয়ার কামিজ কিনে হোটেলে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।
.
সেলিনাকে সেদিন পার্কে ঐ অবস্থায় ফেলে এসে দিন দিন আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। শত চেষ্টা করেও তা দূর করতে পারলাম না। যখন একমাস পার হয়ে গেল অথচ কোনো খবর পেলাম না তখন মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করলাম। দোকানে এলে এই ভাবটা বেশি হত। একদিন নভেল ড্রিংকের মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যারিষ্টার মঈনুল ইসলামের মেয়ে কি কয়েকদিনের মধ্যে এসেছিল?
উনি বললেন, আপনি জানেন না বুঝি? ব্যারিষ্টার সাহেবের মেয়ে তো আজ এক মাসের মত শয্যাশায়ী। ডাক্তাররা কোনো রোগ ধরতে পারছে না।
খবরটা শুনে খুব মুষড়ে পড়লাম। কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে পারলাম। শুধু মনে হতে লাগল, তার এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। প্রত্যেক নামাযের পর তার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করতে লাগলাম। এই অস্থিরতার মধ্যে আরও চার পাঁচ দিন গত হয়ে গেল।
আমাকে বেশি চিন্তিত দেখে আমার স্ত্রী ভয় পেয়ে একদিন বলল, আজ দোকানে গিয়ে কাজ নেই। চল, আমিও তোমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাব। তার ধারণা হয়েছিল আমার কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে।
বললাম, তোমাকে যেতে হবে না, আজ মার্কেটে একজন ডাক্তারকে দেখাব। আমার মন এত খারাপ হয়েছিল যে, সেটা সহকর্মীদের চোখ এড়ায়নি।